আশাপূর্ণা দেবীর জন্ম ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি (বাংলা ২৪ পৌষ, ১৩১৫) শুক্রবার সকালে উত্তর কলকাতায় মাতুলালয়ে। তিনি একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং শিশুসাহিত্যিক। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, বিশেষত সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই ছিল তার রচনার মূল উপজীব্য। ব্যক্তিজীবনে নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ আশাপূর্ণা ছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা। বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাষায় তার জ্ঞান ছিল না। বঞ্চিত হয়েছিলেন প্রথাগত শিক্ষালাভেও। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণশক্তি তাকে দান করে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকার আসন।
আশাপূর্ণা দেবী’র প্রথম প্রতিশ্রুতি-সুবর্ণলতা-বকুলকথা উপন্যাসত্রয়ী বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। তার একাধিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। দেড় হাজার ছোটোগল্প ও আড়াইশো-র বেশি উপন্যাসের রচয়িতা আশাপূর্ণা সম্মানিত হয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার সহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কার। ভারত সরকার তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপে ভূষিত করেন।
পারিবারিক পরিচয়
আশাপূর্ণা দেবীর পিতার নাম হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত এবং মাতা সরলাসুন্দরী দেবী । হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন কমর্শিয়াল আর্টিস্ট ; সেযুগের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকাগুলিতে ছবিও আঁকতেন। তার রাজভক্তি ও রক্ষণশীলতার বিপরীতে অবস্থান করতেন মা সরলাসুন্দরী দেবী। সাহিত্যপাঠই ছিল তার জীবনের একমাত্র ‘পরমার্থ’। রাজনৈতিক আদর্শে ছিলেন কট্টর ব্রিটিশ-বিদ্বেষী স্বদেশী।
গুপ্ত-পরিবারের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার বেগমপুরে। যদিও আশাপূর্ণা দেবীর জীবনের সঙ্গে এই অঞ্চলটির কোনও প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। তার ছোটোবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতাতেই, ঠাকুরমা নিস্তারিনী দেবীর পাঁচ পুত্রের একান্নবর্তী সংসারে। পরে হরেন্দ্রনাথ যখন তার আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নিজস্ব বাসভবনে উঠে আসেন আশাপূর্ণার বয়স তখন সাড়ে পাঁচ বছর। কিন্তু বাল্যের ওই কয়েকটি বছর তার মনে গভীর ছাপ রেখে যায়। পরবর্তীকালে সাহিত্যেও নানা ভাবে এঁকেছিলেন ‘দেহে ও মনে অসম্ভব শক্তিমতী’ তার সেই ঠাকুরমার ছবি।
শৈশব ও শিক্ষা
প্রথাগত শিক্ষার সৌভাগ্য আশাপূর্ণার হয়নি ঠাকুরমার কঠোর অনুশাসনে। পরবর্তীজীবনে এক স্মৃতিচারণায় এই প্রসঙ্গে আশাপূর্ণা বলেছিলেন,
“…ইস্কুলে পড়লেই যে মেয়েরা… বাচাল হয়ে উঠবে, এ তথ্য আর কেউ না জানুক আমাদের ঠাকুমা ভালোভাবেই জানতেন, এবং তাঁর মাতৃভক্ত পুত্রদের পক্ষে ওই জানার বিরুদ্ধে কিছু করার শক্তি ছিল না।”
তবে এই প্রতিকূল পরিবেশেও মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে দাদাদের পড়া শুনে শুনে শিখে গিয়েছিলেন পড়তে। বর্ণপরিচয় আয়ত্ত করেছিলেন বিপরীত দিক থেকে। মা সরলাসুন্দরী ছিলেন একনিষ্ঠ সাহিত্য-পাঠিকা। সেই সাহিত্যপ্রীতি তিনি তার কন্যাদের মধ্যেও সঞ্চারিত করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সবুজপত্র, বঙ্গদর্শন, বসুমতী, সাহিত্য, বালক, শিশুসাথী, সন্দেশ প্রভৃতি ১৬-১৭টি পত্রিকা এবং দৈনিক পত্রিকা হিতবাদী তো বাড়িতে আসতই, তাছাড়াও সরলাসুন্দরী ছিলেন স্বনামধন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, জ্ঞানপ্রকাশ লাইব্রেরি ও চৈতন্য লাইব্রেরির সদস্য। বাড়িতে সেযুগের সকল প্রসিদ্ধ গ্রন্থের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডারও ছিল। এই অণুকূল পরিবেশে মাত্র ছয় বছর বয়স থেকেই পাঠ্য ও অপাঠ্য নির্বিশেষে পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করে দেন আশাপূর্ণা। পরবর্তী কালে এই বাল্যকাল সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,
“হিসেব মতো আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে, সংসার ঊর্ধ্বের একটি স্বর্গীয় জগতে। বই পড়াই ছিল দৈনিক জীবনের আসল কাজ।”
ছেলেবেলার দিনগুলি সম্পর্কে আশাপূর্ণা বলেছেন,
“…খুব ডাকাবুকো ছিলাম। ছেলেবেলায় ঘুড়ি ওড়াতাম, মারবেল খেলতাম। ক্যারাম খেলতাম দাদাদের সঙ্গে।”
আবার পিতামাতার সবচেয়ে বাধ্য মেয়ে হওয়ার জন্য তাদের সবচেয়ে প্রিয়পাত্রীও হয়ে উঠেছিলেন। সেদিনের নির্মীয়মান কলকাতা মহানগরী ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। আর প্রিয় ছিলেন দিদি রত্নমালা ও বোন সম্পূর্ণা। তারা তিনজনে ছিলেন, আশাপূর্ণার ভাষায়,
“…একটি অখণ্ড ট্রিলজির অংশ। এক মলাটে তিনখানি গ্রন্থ।”
আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নতুন বাড়িতে উঠে আসার কিছুদিনের মধ্যে এই অখণ্ড আনন্দে বিচ্ছেদের সুর বাজে। বিয়ে হয়ে যায় দিদি রত্নমালার। সেই নিঃসঙ্গতা দূর করতে একদিন আশাপূর্ণা ও সম্পূর্ণা করে ফেলেন এক দুঃসাহসিক কাজ। দুই বোনের সাক্ষরে চিঠি পাঠান রবীন্দ্রনাথকে। আবদার,
“নিজের হাতে আমাদের নাম লিখে একটি উত্তর দেবেন।”
কাঙ্ক্ষিত সেই উত্তর আসতেও দেরি হয়নি। আর এর পরেই বহির্বিশ্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘স্যাঁতস্যাঁতে বাংলাদেশের বিদ্রোহিনী নারী’র।
আশাপূর্ণা দেবী রচিত গ্রন্থাবলি :
- প্রথম প্রতিশ্রুতি
- সুবর্ণলতা
- বকুলকথা
- নিলয়-নিবাস
- দিব্যহাসিনীর দিনলিপি
- সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক
- চিত্রকল্প
- দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে
- লীলা চিরন্তন
- চাবি বন্ধ সিন্দুক
- অগ্নিপরীক্ষা
- আর এক আশাপূর্ণা
- এই তো সেদিন
- অলয় আদিত্যের ইচ্ছাপত্র রহস্য
- গজ উকিলের হত্যা রহস্য
- ভূতুরে কুকুর
- রাজকুমারের পোশাকে
- মনের মুখ
- মধ্যে সমুদ্র
- যাচাই
- ভুল ট্রেনে উঠে
- নিমিত্তমাত্র
- কখনো কাছে কখনো দূরে
- নষ্টকোষ্ঠী
- মজারু মামা
- ষড়যন্ত্রের নায়ক
- চশমা পাল্টে যায়
- বিশ্বাস-অবিশ্বাস
- কাঁটাপুকুর লেনের কমলা
- নেপথ্য নায়িকা
- জনম্ জনম্কে সাথী
- লঘু ত্রিপদী
- বালুচরী
- শৃঙ্খলিতা
- সানগ্লাস
- শুক্তিসাগর
- সুখের চাবি
- সুয়োরানীর সাধ
- সুরভি স্বপ্ন
- যার বদলে যা
- বালির নিচে ঢেউ
- বলয়গ্রাস
- যোগবিয়োগ
- নির্জন পৃথিবী
- ছাড়পত্র
- প্রথম লগ্ন
- সমুদ্র নীল আকাশ নীল
- উত্তরলিপি
- তিনছন্দ
- মুখররাত্রি
- আলোর স্বাক্ষর
- জীবন স্বাদ
- আর এক ঝড়
- নদী দিক হারা
- একটি সন্ধ্যা একটি সকাল
- উত্তরণ
- জহুরী
- মায়াজাল
- প্রেম ও প্রয়োজন
- নবজন্ম
- শশীবাবুর সংসার
- উন্মোচন
- বহিরঙ্গ
- বেগবতী
- আবহ সঙ্গীত
আশাপূর্ণা দেবী রচিত ছোটগল্প-
- পাতাচাঁপা
- সর্ষে ও ভূত
- ডেইলি প্যাসেজ্ঞার
- কামধেনু
- শুনে পুন্যবান
- অভিনেত্রী
- ক্যাকটাস্।
মৃত্যু:
আশাপূর্ণা দেবী ১৩ জুলাই ১৯৯৫ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে ইহজগৎ ত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন:
মাজরুহ সুলতানপুরী [ কবি, গীতিকার ]