এই দেশে এই বেশে নাটকটি এস এম সোলায়মান এর একটি বিখ্যাত নাটাক। এই নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছে ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৮ তারিখে। শেখ মোহাম্মদ সোলায়মান বা এস এম সোলায়মান একজন বাংলাদেশী অভিনেতা। তিনি ১৯৫৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মঞ্চ নাটক পরিচালনা করতেন এবং তাতে সঙ্গীত পরিচালনাও করতেন। তাকে বাংলাদেশের থিয়েটারের জগতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি।
এই দেশে এই বেশে নাটক – ১ম পর্ব:
![এই দেশে এই বেশে নাটক - এস এম সোলায়মান 2 এই দেশে এই বেশে ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান](https://actinggoln.com/wp-content/uploads/2023/04/এই-দেশে-এই-বেশে-১ম-পর্ব-নাটক-এস-এম-সোলায়মান-300x157.jpg)
প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক
প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা
কুশীলব
নানা : মিজান মুহাম্মদ শাহীন
নাতি : জন মার্টিন
রাজা : মাসুম আজিজ
তথ্যমন্ত্রী : কাজী আমিনুর
রাষ্ট্রমন্ত্রী : শামসুল আলম শাহীন
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : মিজানুর রহমান
হাজাম : মোস্তফা হীরা
হুরমত : গোলাম মোস্তফা
রবীন্দ্রনাথ : নাসিমুল হক রিপন
নজরুল : শেখ শানে মাওলা
শরৎচন্দ্র : শাহ আলম কবীর
বৃদ্ধা : রোকেয়া রফিক বেবী
চিকন আলী : নাদের চৌধুরী
বেগম রোকেয়া : মাহবুবা হক কুমকুম
জহির রায়হান : দেবাশীষ ঘোষ
কোৱাস : স্বপন সৈয়দ, কাজী শফিকুল ইসলাম, আরিফ শাহরিয়ার রিন্টু, নিশান, আবদুর রকীব রেজা, খন্দকার ইসমাইল, অপু, রোমিও- জন গোমেজ
কলাকুশলী
নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান
মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ
বিশেষ দৃশ্যনির্মাণ : হাবিবুর রহমান
গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান
পোশাক : অশোক কর্মকার, শিউলি রহমান
সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক : ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ
প্রধান সমন্বয়কারী : গোলাম কুদ্দুছ

এই দেশে এই বেশে ১ম পর্ব
(মঞ্চের পিছনে উৎসবমুখর পরিবেশ। বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের আয়োজন। প্রসেনিয়ামের সামনে গম্ভীরা গানের নানা নাতি ও কোরাস দল। পেছনে উট, খেজুর গাছ ইত্যাদি।)
[এই দেশে এই বেশে ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
নাতি
(গান) আমি বিহা করবো বলে এলুম ঢাকা শহরে
আমি মনের মতো কনে দেখে কিনে নিমু আহা রে
নানা হে।
হেই নানা। কুনঠে গেলি রে? ইশশিরে কতো মানুষ আইসাছে ইখানে
এত মানুষ আইসলো কুনঠে থেইকে? এখন হামি কি করি? বৌ চুড়ি না
নানা চুড়ি? নানা। হেই নানা নানারে
নানা
ইশ শালা মাথা মোটা বেয়াক্কেল। ষাঁড়ের মতন চিল্লাচ্ছিস কেনে? এটা কি তোর গাও পেয়েছিস যে বলদের মতন হাম্বা হাম্বা চেঁচাবি?
নাতি
এ্যা? চেঁচাবো না? এই যে বিহা করার কথা কহে গাঁও থেইকা নিয়া আসলি, তো কহ বউহু কই?
নানা
বউহু কই!
নাতি
হ্যাঁ ৷ কহ, বউহু কই?
গান
নামে ঢাকা কাজে ফাঁকা আজব এই শহরে
আমরা নানা নাতি ঘুরি বিহা করার মোহে রে। নানা হে
নানা করলো দশটা বিহা, নাতির বেলায় খইয়ের মোয়া
আসল কথা কহতে গেলে গায়ে উঠে জ্বর হে
নানা
হাঁ বে। আসল কথা যে কহলি, সেটা কি?
নাতি
কেনে জি। তুই বুঝিস নি?
নানা
না।
নাতি
বুঝিস নি?
কহনু তো লয়।
নাতি
তোর চরিত্র খারাপ হইয়া গ্যাছে রে। তুই বিহা কইরাছিস দশটা। আসলে তোর আরো একটা বিহা করার সখ চাইপাছে। হাঁরে দেখিয়ে তুই বউ ঠিক করবি আর কাজের বেলায় হেরে ভাগিয়ে নিয়ে যাবি।
নানা
হু। যাবো।
নাতি
যাবি? তুই পারবি এই কাজ করতে?
নানা
উ পারলে হামি পারবে না কেনে?
নাতি
উটা ফের কে রে? তোর বউছ বুঝিস নি?
নানা
আবে শালা। তোর বিশ বছরের মর্দা শরীর ছাইড়া তোর বউ যদি সত্তর বছরের বুড়ার সাথে ভাঁজ খায়, তাইলে বুড়ার দোষটা কি?
নাতি
এইটা কেমন কইরা সম্ভব নানা।
নানা
সম্ভব। তা এই শহরের নামটা যেন কি?
নাতি
ঢাকা।
নানা
কতোদিন আগে বউ ঢুড়তে এই শহরে আইসাছিস?
নাতি
ধইরা ল দশদিন।
নানা
প্যাডেল মারা রিকসায় চইড়া কয়ডা ছুড়ি দেইখাছিস?
নাতি
দিনে হাজার খানেক।
নানা
কয়টা পছন্দ হয়েছে?
নাতি
সবটি।
নানা
হাঁর একটাও হয় নি।
নাতি
কেনে নানা?
নানা
হাঁর মনে হইয়েছে সব ভাইগা যাওয়ার তালে আছে।
নাতি
ঐ বুড়া, তোর সাথে?
নানা
আবে না। ভয়ে।
নাতি
ভয়ে? কার ভয়েরে নানা?
নানা
সেটা এখন কহা যাবে না।
নাতি
তাইলে হার বিহার কি হইবে? এই যে এতো গুলান নাতি –
নানা
নানার সাথে আইলি। চল। গাঁয়ে চইলে যাই।
নাতি
না জি। গাঁয়ে যাওয়া যাইবে না। গায়ে সবাইকে কহে এসেছি বিহা করে বউ লিে যাব। এখন কি হইবে রে নানা?
নানা
চিন্তা করছি।
গান
বউ ছাড়া গেলে গ্রামে মান সম্মান তো থাকবে না।
হে নানা, আর তো পরানে সহে না।
বিহা ছাড়া প্রাণে যে আর বাঁচি না।
নানা
সমস্যা।
নাতি
চল
নানা
কুনঠে?
নাতি
চল প্যাডেল মারা রিকশা করে বউ চুড়ি। এইটে থাইক্যা কি হবে?
নানা
এইটে থাইকা কি হবে। শালা, বিহা তো জীবনে মেলা করবার পারবি। কিন্তু আইজকার মতো একটা দিন পাইতে হইলে তোকে ফের এক বছর বসে থাকতে হবে।
[এই দেশে এই বেশে ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
নাতি
আইজকের মতো দিন বুঝলু না।
নানা
তোরে আইজকে এখানে ক্যান লিয়ে এসেছি? ঘাটায় কহেছিলি, কি জানি কি একটা হইবে।
নাতি
শালা, অশিক্ষিত, বর্বর। এই নানা, তুই গাইল দিচ্ছিস?
নানা
না তো কি চুমা দেবো? জানিস, এখানে কত বড় অনুষ্ঠান হইবে? এই যে, ইনারা সব বইয়া আছেন। শিক্ষিত, জ্ঞানী-গুণী। তোর চৌদ্দ পুরুষের সৌভাগ্য, এমন একটা অনুষ্ঠান দেখবি ।
নাতি
সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু অনুষ্ঠানটা কি?
নানা
বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব।
নাতি
দাঁড়া দাঁড়া নানা কি তেনা কহলি?
নানা
আবে তেনা না তেনা না। চেতনা। চেতনা শব্দের মানে বুঝিস?
নাতি
চেতনা? হ্যাঁ বুঝি ।
নানা
কহ দেখি?
নাতি
চেতনা ৷ চেতা । নানা বুইঝেছি। চেতনা মানে চেইতা যাওয়া। আজকে সব বাঙালি চেইতা যাবে ৷ ঐ যে ১৯৭১ সালে একবার সব বাঙালি চেইতা গিয়া ফাইট কইরাছিল না? আজকেও সব বাঙালি চেইতা যাবে।

নানা
চেতনা । চেইতা যাবে। নাহ! কথাটা একেবারে খারাপ কহিস নি।
নাতি
ঠিক কহলাম?
নানা
হ্যাঁ
নাতি
তাইলে হার একটা কথা আছে।
নানা
কহ ।
[মঞ্চের পেছনে স্বল্প আলোতে রাজা এবং মন্ত্রীদের প্রবেশ।
গান
এ কেমন চেতনা নানা সারা বছর খবর নাই।
একুশ আসলে হঠাৎ জ্বলে দপ করে নিভে যাই।
নানা হে
উনিশ শ একাত্তুর সালে চেতলো সব বাঙালি মিলে
দশ বছরের মাথায় দেখি স্বাধীনতার পাত্তা নাই।
হে নানা, রাজাকারে হলো দেশ বোঝাই
মুক্তিযুদ্ধের নাম গন্ধ নিশানা নাই।
নানা
একেই কহে অর্বাচীন বালক। মুক্তিযুদ্ধ। রাজাকার। ঐ শালা, সংবাদপত্র পড়িস? টেলিভিশন দেখিস? শুনেছিস নিজস্ব আইডেনটিটির কথা? ঐ সব আবেগ ফারেগ দিয়ে হইবে না। একটা জাতীয় ঐকমত্যের জন্য এখন ঐ সব ভুইলা যাইতে হইবে। একথা আজ সবাই কহিছে।
(পেছন হঠাৎ রাজা মন্ত্রীদের দেখে)
নাতি
ওরা আবার কারা রে?
নানা
কুনঠে, কুনঠে? ওরে বাবা। ওরা দেশের রাজা এবং তার পরিষদ। ঘটনা হইছে উৎসব। শুরু হইল বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব। চুপ কইরা বইয়া পড়। চুপ। একদম চুপ।
(পেছনের অংশ আলোকিত)
গান
জয় জয়তু রাজা জয়।
জাতি পিতা তুমি অজেয়।
মোরা মাগি তব বর হে প্রিয়।
তুমি রাজা মহারাজা তু জয়।
আফ্রো এশিয়া ল্যাটিন আমেরিকা তথা তৃতীয় বিশ্বের শক্তিমদ বাহিনীর হে অগ্রনায়ক তু জয়। হিটলার, মুসোলিনি, ইয়াংকি বাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট, হে অধিপতি তু জয় । ললনা কম্পান, উত্থান-পতন, হে বীর বীর্যধারী তু জয়।
শক্তি ভারসাম্য, ডিগবাজী বিশারদ, পরম শ্রদ্ধাস্পদ তু জয় ।
রাজা
জয়’ জয়! জয়’ এ্যাই, কি? জয়? চোপ্। জিন্দাবাদ ।
পর্ষদ
জিন্দাবাদ। জিন্দাবাদ।
নাতি
নানা
নানা
জিন্দাবাদ।
নাতি
হে নানা।
নানা
জিন্দাবাদ ।
নাতি
হইলো কি বুড়া?
নানা
জিন্দাবাদ ।
রাজা
হু। জিন্দাবাদ। প্রিয় পর্ষদবৃন্দ, জিন্দাবাদ এবং ধন্যবাদ। আমি রাজা জিন্দাবাদ এবং ধন্যবাদ। দেশ কার?
পর্ষদ
রাজার।
রাজা
মাটি কার?
পর্ষদ
রাজার।
রাজা
ধান কার?
পর্ষদ
রাজার।
রাজা
ভোট কার?
পর্ষদ
রাজার।
রাজা
জনগণ কার?
পর্ষদ
সর্বশক্তিমান আল্লাহর।
নাতি
হে নানা কহে কি রাজা। দেশ রাজার। ধান রাজার ভোট রাজার। জনগণ কেনে সর্বশক্তিমান আল্লাহর? এটা কেমন কথা হইলো?
নানা
এটাই হচ্ছে তোর আসল কথা। আমাদের রাজা এসেট ভালোবাসে। লাইবেলিটিস ভালোবাসে না।
[এই দেশে এই বেশে ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
তথ্যমন্ত্রী
একটা সাংঘাতিক, দুর্দান্ত, প্রবল পরাক্রান্ত বিশ্ববিজয়ী কাজ সম্পন্ন হতে যাচ্ছে এবং সেটি হচ্ছে উৎসব। বাঙালি চেতনার শতবর্ষপূর্তি উৎসব উৎসবপ্রবণ জাতি আজ মারাত্মকভাবে আন্দোলিত। ধন্য হলো ইতিহাস। আমরা শুনতে পাচ্ছি ইতিহাসের সেই চূড়ান্ত প্রসব বেদনা। একটু অপেক্ষা করলেই দেখবেন কুটুস কুটুস করে জন্ম নিচ্ছে বীর প্রসবিনীর সোনাদানা ।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
ওমা। তাই নাকি?
তথ্যমন্ত্রী
হ্যাঁ, তাই। তেনারা আসছেন ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
আসছে? কোন পথে? থাই এয়ারলাইন্স না সিঙ্গাপুর ?
রাজা
চুপ! ঐ কেস না, মানুষ। সোনার মানুষ।
তথ্যমন্ত্রী
হুঁ। তাও আবার যেই সেই মানুষ না। পরলোকে রীতিমত সেটেল্ড করা মানুষ।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
ওমা তাই? তারা কারা?
তথ্যমন্ত্রী
সম্পূর্ণ লিস্ট এখনো আমাদের হাতে এসে পৌঁছেনি। তবে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ কনফার্ম।
রাজা
অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, এ ব্যাপারে যাবতীয় কৃতিত্বের দাবিদার আমাদের জাতীয় হাজাম কাম ধর্ম উপদেষ্টা, হযরত পীরে কামেল নকশাবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, আজিজিয়া, ফোরকানিয়া, কুতুবে আজম, গাউছে সামদানী ইশকে রব্বানী, হুকুমতে খোমেনি, খুসবু এ বিরানি।
(একজন মাওলানা ঢোকে। সবাই তাকে কদমবুসি করে। ইনি জাতীয় ধর্মগুরু।)
গান
কেমন বাঙালি চেতনা বুঝাও নানা আমারে
বাঙলায় কেন ইরানী বিরানী আর খোমেনী রে
নানা হে।
আমরা যারা বাঙলাবাসী, পহেলা বৈশাখে নাচি।
বৈশাখের উৎসবে কেন আমির সাহেব কাশে রে।
হে নানা, বল, কোথায় মোরে নিয়ে এলে
বাঙালি উৎসব না মিলাদ মহফিলে।
হে নানা, প্রাণে সয় না, এই ছিল কি তোর দিলে
হায় নানা এই ছিল কি তোর দিলে
এই বয়সে আমি হাজামের কোলে।
ধর্মগুরু
জিত রহো ব্যাটা। জিত রহো। আপনাদের এদিককার আয়োজন সব শেষ তো।
সবাই
জি হুজুর।
ধর্মগুরু
কোন অসুবিধা নেই তো?
সবাই
না হুজুর।
ধর্মগুরু
সবার একিন বিলকুল ঠিক তো?
সবাই
হাঁ হুজুর।
ধর্মগুরু
শোকর আলহামদুলিল্লাহ। প্রিয় মুরিদবৃন্দ। আজকে যে কাজটি আপনারা হাতে নিয়েছেন তা এই সময়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের এই দাওয়াতের মধ্য দিয়ে আপনারা ইনসানকে আপনাদের কওমকে সত্যের পথে, ঈমানের পথে ধাবিত করবেন। নানা জাতের নানান ধর্মের ইনসানরা আজ এখানে তাশরিফ নেবেন। তাদের সবাইকে সঠিক পথে চালানোর দায়িত্ব হচ্ছে আপনাদের। আপনাদের একিন যদি ঠিক থাকে, জিহাদের জোশ যদি আপনাদের মধ্যে থাকে, নিশ্চয়ই আপনি আমাদের দোয়া করুন হুজুর আপনারা কামিয়াবি হবেন।

রাজা
বহুৎ খুব। বহুৎ আচ্ছা।
(পিছনে হট্টগোল। রবীন্দ্রনাথ এসেছেন।)
ধর্মগুরু
আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত,
আমরা নতুন যৌবনের দূত
গান
এই লোক কে, হে নানা?
নানা
আরে শালা। চিনতে পারলিনে? ইনিই তো হচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালি সংস্কৃতির প্রবাদপুরুষ। খুব তো চিল্লাচ্ছিল্লি, শালা হঠকারী। ইরানি, বিরানী, খোমেনী, উৎসব, মিলাদ মাহফিল। এখন হইলো তো। খালি বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা। চাইয়া দেখ, বে। বাঙালি সংস্কৃতির আসল মানুষটাকেই তারা আমন্ত্রণ কইরা এনেছে। শালা, নেতিবাচক রাজনীতি কর, না? বুঝলি বে, এই গোটা বাঙালি জাতির উচিত আমাদের সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা। শালা হঠকারী বিপ্লবী।
রাজা
কেমন আছেন কবিগুরু?
কবি
তোমাদের আশীর্বাদে ভাল ।
রাজা
পরিচয় করিয়ে দিই। এরা সব দেশের মন্ত্রীটস্ত্রী। আর ইনি হচ্ছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় জাতীয় হাজাম পীরে কেবলা-
ধর্মগুরু
আসসালামু আলাইকুম।
কৰি
ধন্যবাদ ।
রাজা
আপনার যেমন আছে লক্ষ লক্ষ ভক্ত, উনারও তেমনি আছে লক্ষ লক্ষ মুরিদকূল।
কবি
আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
খুশি হয়েছেন? খুব ভালো। শুধু খুশি না, একবার উনার মুরিদ হয়ে দেখুন না,সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর পদটা-
রাজা
এ্যাই, চোপ। না, ও কিছু না কবিগুরু। গলায় আপনার ওটা কি ঝুলছে?
কবি
যখন বেঁচেছিলাম, তখনকার ছবি। পরলোকে তো মর্ত্যের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তাই চেনার সুবিধার্থে আগের ছবিটাই গলায় ঝুলিয়ে নিলাম ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
খুব ভালো করেছেন। আমাদের এদিকে ইদানিং ভেজালের খুব প্রকোপ চলছে। তা পথে কোন অসুবিধা হয় নি তো?
কৰি
একেবারে হয়নি বললে ভুল হবে। সে যে কী ঝক্কি। পরলোক থেকে বিশেষ যানে মাধ্যাকর্ষণ । মাধ্যাকর্ষণ থেকে বর্তমান। আবার সেখান থেকে বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে সরাসরি ল্যান্ডিং। যাই বলো ভায়া, তোমরা জাতি হিসেবে এত উন্নতি করলে, এতবড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হলো, বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব করতে চলেছ। কিন্তু জাতীয় এয়ার লাইনটাকে একটু টিট দিতে পারলে না। কি যে সব খাবার-দাবার দেয়, কি আর বলবো। এর মধ্যে আমার প্রায় ৩০-৪০ বারের মতন হয়ে গেছে। তা আছে নাকি এ্যান্টি ডিসেন্ট্রি কোন ওষুধ?
ধর্মমন্ত্রী
ও কিছু না । বহুদিন পরে মর্ত্যো এলেন তো। সেই জন্য ।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
হুজুরের পানিপড়া খান, ঠিক হয়ে যাবে। দেবো?
কবি
লাগবে না। ধন্যবাদ ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
অবশ্য আপনি যদি মনে করেন একটু মেডিক্যাল চেকআপ দরকার, তাহলে আমি আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ডা. হুরমত আলী খানকে ডাকতে পারি
কবি
তাই বরং ডাকুন। আমি আবার বিশ্ব সভ্যতায় বাঙালি সংস্কৃতির অবদান শীর্ষক ৬০ পৃষ্ঠার একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ তৈরি করে এনেছি। এতো বড় প্রবন্ধ পড়ার মধ্যে বারবার ঐ কর্মে যাওয়া-আসাটা বড্ডো দৃষ্টিকটু লাগবে। কি খান বললেন যেন?
[এই দেশে এই বেশে ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
রাষ্ট্রমন্ত্রী
ডা. হুরমত আলী খান।
কবি
কেমন ডাক্তার, ভালো তো?
ধর্মমন্ত্রী
ভালো মানে? মেডিকেল সাইন্সের এমন কোন বিষয়টি আছে, যা তার এলেমের মধ্যে নেই? বহুৎ এলেমবাজ নওজোয়ান ।
রাজা
বিশেষ করে সার্জারির ক্ষেত্রে অসম্ভব তার হাত যশ। হার্ট বলেন, লিভার বলেন, ব্রেইন বলেন, আশ্চর্য একটা ট্যালেন্ট। শুধু নিজের দেশেই নয়, সমস্ত বিশ্বের জন্য হুরমত একটা অফুরন্ত সম্পদ।
কবি
বলেন কি? এতবড় চিকিৎসক আছে বাংলাদেশে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
শুধু কি তাই? পোস্টমর্টেমের ক্ষেত্রে হুরমতের সাফল্য সারা বিশ্বের ডাক্তারকূলের জন্য রীতিমতো ঈর্ষণীয় ব্যাপার। মাত্র নয় মাসে হুরমত নিজ হাতে অত্যন্ত দক্ষভাবে এক লক্ষ পোস্টমর্টেম করেছে।
কবি
বলেন কি? নয় মাসে এক লক্ষ পোস্টমর্টেম?
ধর্মমন্ত্রী
জি। নয় মাসে এক লক্ষ পোস্টমর্টেম হিসেব করলে দিনে দাঁড়ায় ২৭৩টি। আট ঘণ্টার ডিউটি রেওয়াজে একদিনে ২৭৩টি পোস্টমর্টেম। তাহলে ২৭৩ ডিভাডেড বাই এইট। ইকুয়েল টু প্রতি ঘণ্টায় ৩৪টি। ৬০ মিনিটে এক ঘণ্টা, মানে দাঁড়াচ্ছে গিয়ে প্রতি দুই মিনিটে একটি করে পোস্টমর্টেম। অগ্র চালনায় কতটুকু কামিয়াবি হলে এ রকম একটি অসম্ভব কাজ –
কবি
বলেন কি! এতো দেখছি রীতিমত অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
কম্পিউটারও ওর কাছে হার মেনে গেছে, স্যার
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
বুঝলেন, স্যার? এই জন্যই হুরমতের বিরুদ্ধে এত চক্রান্ত। একটা সিক্রেট সংবাদ আপনাকে দিই। মেডিকেল সাইন্সে সবচেয়ে জটিল কাজটি হচ্ছে মানবশরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংযোগ অর্থাৎ রগের অপারেশন। এই কাজে পৃথিবীর বাঘা বাঘা সার্জেনরা হার মেনে যায়। কিন্তু আমাদের হুরমত আলী খান, এমন এক চমৎকার টেকনোলজি আবিষ্কার করেছে, সারা পৃথিবী থ। চক্ষের নিমিষে সে রগ কাটাছেঁড়া করে ফেলতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন এজেন্সি স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এই প্রযুক্তি হাত করার তালে আছে। কি করবো। গরীব দেশ। চারদিকে কেজিবি, সিআইএ এজেন্টে ভরে গেছে।
কবি
কী সৌভাগ্য আমার! এমন একজন জ্ঞানতাপসের সাথে পরিচয় হবে আজ। ধন্য স্বদেশ। ধন্য বাঙালি। কখন আসবেন সেই মহাগুণী?
ধর্মমন্ত্রী
এক্ষুণি। এক্ষুণি। ডাক্তার হুরমত আলী খান-
(হরমত আসছে, জন্মাদের মতো চেহারা। হাতে রামদা। চোখে গাঢ় কালো চশমা।)
গান
এ কোন ধাঁচের ডাক্তার নানা ভয়ে তো প্রাণ বাঁচে না
হে নানা দেখ দেখ রামদা ও থানা
আজো লেগে আছে রক্তের নিশানা।
হুরমত
বান্দা হাজির। (কবি ভীতগ্রস্ত)
কবি
আপনি?
হুরমত
ডা. হুরমত আলী খান।
কৰি
মানে?
হুরমত
স্পেসালিস্ট ইন অল কাইন্ড অব ফিজিক্যাল সার্জারি।
রাজা
ডা, হুরমত আলী খান। ইনি হচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
হুরমত
রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কৰি
তার মানে, আপনিই সেই বিশ্ববিখ্যাত ডা হুরমত আলী খান।
হুরমত
ক্যান। আপনের কি সন্দেহ অইতাছে?
কবি
ঠিক তা না।
হুরমত
তাইলে?
কবি
মানে, ইয়ে। আপনি তো ডক্টর অব সার্জারি।
হুরমত
ঐ আর কি। কাটা-ছেঁড়ার কাম
কৰি
একটু আগে ইনারা আপনার খুব প্রশংসা করছিলেন। আপনার নাকি সাংঘাতিক হাতযশ ।
হুরমত
প্রশংসা করছে? করবো না? যে কয়েক হালারে কাটছি। একটাও তো বাঁচতে পারেনাই।
কবি
(আঁতকে উঠে) জি।
হুরমত
জি।
কবি
এটা?
হুরমত
রামদা খুব কুইক কাজে লাগে। মাইনষের হাতের আর ঠ্যাং-এর রগ কাটতে এই জিনিসের কোনো জুড়ি নাই।
ধর্মমন্ত্রী
সমঝে চলো হুরমত। ইনি আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি। ভ্রমণজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন।
হুরমত
আ তা সমস্যাটা কি। কোনখানে ব্যথা, বুকে না মুখে?
কবি
জি না, পেটে।
হুরমত
প্যাডে? নো চিন্তা। এক কোপে প্যাটটা ফাইরা ফেললেই দেখবেন, সব ব্যথা মাথা ভুরভুর কইরা বাইর অইয়া গ্যাছে। খাড়ান। প্যাডটা ফাইরা দেহি, কি অইছে। ইয়াহু ।

কৰি
(ভয় পেয়ে) বাঁচাও! বাঁচাও!
রাজা
আরে আরে কর কি হুরমত দাঁড়াও। নাহ্। তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। কোন পেশেন্টের সাথে কি রকম ব্যবহার করতে হবে এখনো শিখলে না।
হুরমত
(ধর্মগুরুকে) বেশি অইয়া গ্যাছে?
ধর্মমন্ত্রী
হ্যাঁ। ওনাকে নসিহত কর। ভদ্রলোক দিলে চোট পেয়েছেন। একবার তো বলেছিই। রাষ্ট্রীয় অতিথি ।
হুরমত
অ। দুঃখিত। হুনেন ।
কৰি
না ভাই। শুনেটুনে কোনো কাজ নেই। তাছাড়া তেমন বিশেষ অসুবিধা বোধ করছি না। দীর্ঘদিন পরে এলাম তো। ঐ জন্য। ও কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে।
হুরমত
বুঝছি। আপনে আমার রামদাওখান দেইখ্যা ডরাইছেন, খামাকা ডরাইলেন। মানুষ কিন্তু আমি খারাপ না। আপনে পাঁচখান মিনিট আমার লগে কথা কন, বুঝবেন । আমি আবার রাখঢাক কথা পছন্দ করি না। যাই কই সামনা-সামনি।
কৰি
আপনার হাতের এই ভয়ঙ্কর জিনিসটা অন্য কোথাও রেখে আসলে হয় না?
হুরমত
এই একখান জায়গাতে আমি বড় দুর্বল। বড় পেয়ারের জিনিস আমার। এই অনুরোধটা মেহেরবানি কইরা আমারে কইরেন না। এর মতন চমৎকার মাল আর কোথাও পামু না। জিনিস একখান সাংঘাতিক শার্প। এক কোপেই দুই টুকরা। কি. বিশ্বাস করলেন না? তাইলে কই, ছনেন। একাত্তর সালে গণ্ডগোলের টাইমে নাফরমান নালায়েক কমিনাগো পোস্টমর্টেম তো এই রামদাও দিয়াই করছি। হাজারে হাজার। কাতারে কাতার।
হালারা নাকি আবার বুদ্ধিজীবী। মাল একখান। হাড্ডি গুদ্দা বেবাক এক কোপেই ঝুরঝুর বুঝলেন কবিসাব। এক হালা, হে নাকি আবার প্রফেসার। সারা জিন্দেগী আল্লাহ খোদার নাম নেয় নাই। কমিনা বেজাত। নামে মুসলমান। আদতে বেদাত। কি হুঙ্কার। শোলোগান। কি গলা । জয় হিন্দ জয় বাংলা, দুর্গার ঠেং আর মুজিবের করা। এই মিইল্যা জয় বাংলা। হালার পুত হালা, কমিনাডারে চোখহাত বাইন্ধা শোয়াইলাম জমিনের ওপর।
ভিজা ভিজা মাটি, ঝিরঝিরা বৃষ্টি, আর ফুরফইরা বাতাস। আল্লার নাম নিয়া সিনা থেইক্যা প্যাট বরাবর মারলাম এক টান। ফ্যাৎ কইরা আওয়াজ দিয়া ফলি মাছের প্যাডের লাহান গতরটা দুই ভাগ। ফিছিত কইরা বাম হাতটা হান্দাইয়া দিলাম কইলজ্যা বরাবর। টান দিয়া দেখি কইলজা না, হালার হৃৎপিণ্ড উইঠা আইছে পাঁচ আঙুলের খাঁজে। তরতাজা তো ।
তহনো দপদপ করে। নিখুঁত তাল। নিখুঁত লয়। আহহারে। আপনে যদি একবার দেখতেন দাদরা, কাহারবা, ত্রিতাল, বহু তালেই তো গান লেখছেন। এই তালে যদি একখানা গান লিখতে পারতেন, আপনে আবার পুরস্কার পাইতেন। আমরাই দিতাম। হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ। কি ডরাইছেন?
( আতঙ্কে বিস্ফারিত কবির চোখ।)
কবি
জি হ্যাঁ। মানে, না।
হুরমত
ভালো। খুব ভালো। ডরাইয়েন না। আপনারে কিছু করুম না। আপনেতো আর হেগোর মতন না। সুফি মানুষ। এক কাম করেন। আপনে আমগো দলে জয়েন করেন। কি, ব্যথা সারছে?
কবি
জি। একদম সেরে গেছে।
হুরমত
মারহাবা মারহাবা। এই দিকে আহেন। কানে কানে একডা কথা কই।
কবি
বলুন।
হুরমত
কাউরে কইবেন না।
কবি
না।
হুরমত
(রাজাকে দেখিয়ে) এমন কি হেরেও না ।
কবি
জি না
হুরমত
কি না?
কবি
বলবো না।
হুরমত
হ। কইবেন না। কথাডা অইতাছে, ঐ যে আপনের জমিদার বাড়ি –
কবি
জমিদার বাড়ি।
হুরমত
কুষ্টিয়ার শিলাইদহে –
কবি
জি শিলাইদহে।
হুরমত
জায়গাটা খামাকা ফালাইয়া রাখছেন। দুনিয়ার সব বেশরিয়তি কাইজকাম অইতাছে ঐ জায়াগায়। যাওনের টাইমে ঐ বাড়িভিটা আমার নামে লিইখ্যা দিয়া যাইবেন।কি রাজি?
[এই দেশে এই বেশে ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
কবি
জি রাজি।
হুরমত
তাই বইলা এইটা মনে কইরেন না, বাড়িটা নিজের কাজে লাগামু। আমাগো বিপ্লবের লাইগ্যা একখান বাড়তি ট্রেনিং ক্যাম্প দরকার। নিরিবিলি। আপনের বাড়িতে আমাগো মুজাহিদ বাহিনী ট্রেনিং নিবো। তয় আমরা মোনাফেক না। দানের মর্ম বুঝি। ক্যাম্পটা আপনের নামেই চালামু।
কবি
কি। আমার নামে?
হুরমত
আপনের নামে।
কবি
ঐ ট্রেনিং ক্যাম্প?
হুরমত
ক্যান। অসুবিধা আছে? মরা মানুষের নামেই তো এইসব ক্যাম্প-ট্যাম্প চলে।
কবি
কিন্তু আমি তো এই কাজ করতে গিয়ে মারা যাই নি।
হুরমত
তাতে কি? লাগাইয়া দিলেই অইলো। আপনি তো আবার সাহিত্যিক মানুষ। সুন্দর একখান নাম ঠিক কইরা দ্যান তো।
কবি
আমাকে ক্ষমা করবেন।
হুরমত
হুঁ। করুম। উঁ হুঁ, পাইছি। জব্বর একখান নাম। রবীন্দ্রনাথ ট্রেনিং সেন্টার ফর হেদায়েত বাহিনী।
কবি
কি?
হুরমত
জি। ও হ্যাঁ। একড়া কথা। উৎসব করতে আইছেন, ভাল করছেন। এই উৎসব খামাকা করতাছি না। এইডার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে আমাগো কাজে কাজেই কোনো ধরনের বেতাইল্যা কথাবার্তা কইবেন না। যাই কইবেন, লাইনে কইবেন। লাইনটা কি বুঝছেন তো?
কৰি
কিছুটা।
হুরমত
কিছুটায় পোষাইবো না। পুরাটাই বুইঝা নেন। নইলে –
কৰি
জি
হুরমত
লন। বেকতে হুনেন । তিনার ব্যথাম্যথা সব ছাইড়া গ্যাছে, কোন অসুবিধা নাই।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
তিনার তো অসুবিধা নাই, বুঝলাম, কিন্তু আমাদেরও নাই তো?
হুরমত
বিলকুল না
ধর্মমন্ত্রী
ঠিকঠাক মতন টাইট দিয়েছ তো?
হুরমত
একদম টাইট।
ধর্মমন্ত্রী
বেদ্বিনী কথাবার্তা বলবে নাতো?
হুরমত
প্রশ্নই আসে না।
রাজা
বহুৎখুব। মহামান্য কবি আপনি আমাদের বুক ভরা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা গ্রহণ করুন। আজকে আমরা অত্যন্ত গর্বের সাথে উচ্চারণ করতে চাই যে বাংলাদেশকে মৃত্যুর পূর্বে আপনি রেখে গিয়েছিলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সে তার নিজস্ব স্বকীয়তা অর্জন করতে পেরেছে। একটি স্বতন্ত্র দেশ এবং স্বকীয় সংস্কৃতির ধারক জাতির পক্ষ থেকে আপনার জন্য ছোট একটি উপহার।
(ধর্মগুরু কবির মাথায় একটি টুপি পরিয়ে দিচ্ছে কবি পালাবার চেষ্টা করে কিন্তু হুরমতের ভয়ে পারে না। সবাই বিশেষ কায়দায় তার মাথায় টুপি এবং গায়ে প্রিন্স কোট পরিয়ে দ্যায়। নাতির কণ্ঠে আরব দেশীয় সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত)।

নাতি
দূরে কোথায় দূরে দূরে এ এ এ
আমার মন বেড়ায় ঘুরে এ এ এ
নানা
এই বে। এইটা কি কাজ করলি। কোন সুরে গাহিলি রবীন্দ্রসঙ্গীত। শালা, ইয়ার্কি পেয়েছ। ফাজলামো কর বিশ্বকবির সাথে।
নাতি
হ্যাঁ। করি। তোমরা যখন রবীন্দ্রনাথের মাথায় টুপি পরাতে পারলে, আমিও হের গানের মাথায় টুপি পরিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে রহমান-সঙ্গীত বানিয়ে দিলুম।
নানা
হাঁ জি, ভাই দেইখেছেন? ছোড়ার সাহস দেইখেছেন? অরগের সাথে এই ফাটা তেনার তুলনা হয়? অরা হচ্ছে শাসক। ঐ যে কহলো একটা স্বকীয়তার কথা –
নাতি
কি কহলি?
নানা
স্বকীয়তা
নাতি
স্বকীয়তা?
নানা
হাঁ বে। জাতিগত স্বকীয়তা।
গান
জাতিগত স্বকীয়তার অর্থ বোঝাও আমারে
ভাষা ও সংস্কৃতির গোড়ায় ভেজাল কেন ঢালো হে
নানা হে।
বলো তো দেখি হে নানা, কোথায় ঘটছে এই ঘটনা
শুধু ভাষার জন্য হলো খালি কত মায়ের কোল হে, নানা হে।
জয় কে খেলো জিন্দাবাদে, বাউল খেলো ডিসকো ড্যান্সে ।
সভাপতির নাম নায়েবে আমির জনগণ বেরাদন মিল্লাত, হে নানা
এই বুঝি জাতিগত স্বকীয়তা
লজ্জায় কাটা যাচ্ছে বাঙালির মাথা
হেম, নবীন, বিদ্যাসাগর, শহীদুল্লার এই কথা
হে নানা, লাখো শহীদের এই কথা
এই বুঝি বাঙালির স্বাধীনতা।
কবি
আপনারা আমাকে এ কোথায় আমন্ত্রণ করে আনলেন।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
কেন? বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসবে ।
কৰি
এর কি কোন প্রয়োজন ছিল?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
আপনার না থাকলেও আমাদের ছিল। যেমন!
কবি
যেমন?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
যে স্বকীয়তার সন্ধান আমরা করছি, তার জন্য আপনার সমর্থন আমাদের প্রয়োজন।
কৰি
আজকের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের কি আমি দু’একটি প্রশ্ন করতে পারি?
রাজা
শিওর শিওর। করুন।
কবি
আমি যেখান থেকে আসছি এবং যেখানে আমার আসার কথা ছিল, আমি কি সেই জায়গাটাতে আছি?
রাজা
সে জায়গাটিতেই আপনি আছেন।
কবি
এই দেশটার নাম বাংলাদেশ?
রাজা
ঠিক ধরেছেন।
কবি
ত্রিশ লাখ লোকের রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছিল?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
খুব বেশি অতিরঞ্জিত হলেও কিছুটা সত্য।
কবি
পৃথিবীতে শুধুমাত্র ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার বিরল দৃষ্টান্ত এই জাতিই সৃষ্টি করেছিল?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
অস্বীকার করছি না।
কবি
বিরাট এক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের নতুন ধারা তৈরি হয়েছিল?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
চালিয়ে যান।
কবি
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা এই জাতিই দিয়েছিল?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
দিয়েছিল। তবে বেশি বাড়াবাড়ি করলে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের কথা ভাববো ।
কবি
ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ । এবার আমি যাবো।
ধর্মমন্ত্রী
সে কি। কোথায় যাবেন। আজকের উৎসবের উদ্বোধক হচ্ছেন আপনি। আপনি এজাজত দিন। আমরা তাহলে শুরু করতে পারি।
কবি
আমি একটু বাইরে যাবো। অনেক দিন দেখি নি স্বদেশভূমিতে প্রিয় আকাশ। গড়াই নদীর তীর আর তার কূলে বাস করা আমার প্রিয় মানুষ। আপনারা যদি অনুমতি দেন, তবে আমি একটু দেখতে যাবো।
[এই দেশে এই বেশে ১ম পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
রাজা
শিশুর। আপনার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ লাগবে?
কবি
আমি বিশ্বাস করি না আমার স্বদেশে আমার প্রিয় মানুষ, আমার নিরাপত্তার জন্য–হুমকি হতে পারে।
হুরমত
আর এক বেকুবের সর্দার কইছিল এই কথা। চাপে পাইছি, আর লগে লগে ভসকাইয়া দিছি।
কবি
আমি কি যাবো?
রাজা
নিশ্চয়ই, আপনি যান। তবে দয়া করে আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবেন।উদ্বোধনের সময় আপনি না থাকলে নানান জনে নানান কথা বলবে। বুঝেনই তো, ভালো কাজে শত্রুর অভাব হয় না।
কবি
ধন্যবাদ। যাচ্ছি।
হুরমত
যাইতাছেন? যান । মগর ভাইগা যাওনের ভাল কইরেন না, এক্কেরে ফাইরা ফালামু। মনে আছে তো? আপনের কুষ্টিয়ার বাড়িটা সাফ কবলা কইরা দিবেন কইছেন। বাড়িটা খুব দরকার। জবান দিছেন। ঠিক আছে যান। বাতাস খাইয়া আহেন।(কবি দর্শকদের কাছে চলে আসে)।
কৰি
আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি চলে যাচ্ছি। যেখান থেকে এসেছিলাম, সেইখানে। বলতে পারেন পালিয়ে যাচ্ছি। না-না। আপনাদের লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, কারণ আমি নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়েছি। যাবার বেলায় শুধু একটা কথা বলে যাই। আপনাদের ভাইবোনেরা যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের অনেকের সাথে আমার আলাপ পরিচয় হয়েছে। দেশ এবং জাতির জন্যে নিঃশঙ্ক চিত্তে জীবনদানের মতো দুঃসাহস ওঁদেরই ছিল, এই রবীন্দ্রনাথের ছিল না।
আর ছিল না বলেই ওঁরা আমার শ্রদ্ধেয়। আমি জানি ওঁরা অনেক উদ্বেগ, আর প্রত্যাশার চকচকে চোখ নিয়ে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। গেলেই জিজ্ঞেস করবে দেশের কথা, গণতন্ত্রের কথা, বাঙালিত্বের কথা। লজ্জা পাবেন না। এসব কিছুই আমি ওঁদের বলবো না। কারণ এতে শুধু দুঃখের, কষ্টের মাত্রাটাই বাড়বে, আর কিছু নয়।
কারণ একাত্তর সাল একটা জাতির জীবনে একবারই আসে, বারবার আসে না। আর আসে না বলেই তার জন্য নিঃশেষে জীবনদানের ঘটনাও একবারই ঘটে, বারবার তো আর ঘটে না। একটা ছোট প্রশ্ন করি? আজ থেকে কতো হাজার বছর আগে এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? (চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ায়) ক্ষমা করবেন। আর একটু বিরক্ত করবো। আচ্ছা, আপনারা বাঙালিতো?
(প্রস্থান)
নাতি
নানা। কুনঠে গেলি ৷ চইলা যায় তো।
নানা
হু-
নাতি
আবে চইলা যায় তো।
নানা
চইলা যায় তো হামি করবেটা কি।
নাতি
তা বইলে বাঙালির একটা অনুষ্ঠান থেকে একজন খাঁটি বাঙালি চইলা যাবে? এইভাবে?
নানা
চইলা তো গেল। কিন্তু কহে গেল কি শুনেছিস?
নাতি
মুক্তিযুদ্ধের কথা কহলো। শহীদদের কথা কহলো।
নানা
এইসব কথাবার্তা কহে কোন লাভ আছে? আসল কথা হইলো, তোরা সব এক হইয়া গেছিস। তোদের অনুভূতি-ফনুভূতি সব ভোঁতা হইয়া গেছে।
নাতি
তাল মারছিস? আমাদের সব নষ্ট হইয়া গেছে। তোর বুঝি সব ঠিকঠাক আছে বে
নানা
হাঁ বে । আমি হনু বুড়া মানুষ । দিনতো ভোরগো, শরীর তাগড়া আছে। রক্ত গরম আছে। ইচ্ছা হইলো ফুইসা উঠলি, আবার ফুটা বেলুনের মতন চুপসায়া গেলি। এই তো তোরা, আর তোরগো দেশের অবস্থা।
নাতি
ভালো একটা কথা কহেছিস তো নানা।
নানা
ভালো একটা কথা কহেছিস তো নানা। হ্যাঁ, ভালো কথা তো সবাই কহে । কিন্তু ভাল কাজ করে কয়জনে?
নাতি
কেনে জি? সবাই করছে। আমি করছি। তুই করছিস। উনি করছেন। (বক্তৃতা ঢংয়ে) এইসব অত্যাচার আমরা মানি না। ষড়যন্ত্র মানি না। এইসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা পক্ষের সবাইকে আজ ঐক্যবদ্ধ হইতে হইবে।
নানা
শালা । বক্তিমা দিছ। এই শালা, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ কি বে? ত্রিশ লাখ লোক জীবন দিয়া যেই দেশ স্বাধীন কইরাছে, সেই দেশে স্বাধীনতার বিপক্ষ থাকে কেমন কইরা? এই শালারা সারা বছর নাকে তেল দিয়া ঘুমাইবে, কিন্তু যখন হাত আর পায়ের রগ কাটা পড়বে তখন নাকের পানি আর চোখের পানি ফেইলে ফ্যাত-ফ্যাত করে কাইন্দে কাইন্দে কহবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত কর।
গান
এসব কথা কহতে মানা, ভালো কথায় ভাত জোটে না।
যে যার ইচ্ছে মত চলে দেশের খবর নাই হে।
হে নানা এভাবে কি একটা দেশ চলে
ব্যস্ত তুমি আখের গোছাবার তালে ।
(নজরুল এবং শরৎচন্দ্র আসেন উৎসবে যোগ দিতে)
এই দেশে এই বেশে নাটক – ২য় পর্ব:
![এই দেশে এই বেশে নাটক - এস এম সোলায়মান 9 এই দেশে এই বেশে ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান](https://actinggoln.com/wp-content/uploads/2023/04/এই-দেশে-এই-বেশে-২য়-পর্ব-নাটক-এস-এম-সোলায়মান-300x157.jpg)
প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক
প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা
কুশীলব
নানা : মিজান মুহাম্মদ শাহীন
নাতি : জন মার্টিন
রাজা : মাসুম আজিজ
তথ্যমন্ত্রী : কাজী আমিনুর
রাষ্ট্রমন্ত্রী : শামসুল আলম শাহীন
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : মিজানুর রহমান
হাজাম : মোস্তফা হীরা
হুরমত : গোলাম মোস্তফা
রবীন্দ্রনাথ : নাসিমুল হক রিপন
নজরুল : শেখ শানে মাওলা
শরৎচন্দ্র : শাহ আলম কবীর
বৃদ্ধা : রোকেয়া রফিক বেবী
চিকন আলী : নাদের চৌধুরী
বেগম রোকেয়া : মাহবুবা হক কুমকুম
জহির রায়হান : দেবাশীষ ঘোষ
কোৱাস : স্বপন সৈয়দ, কাজী শফিকুল ইসলাম, আরিফ শাহরিয়ার রিন্টু, নিশান, আবদুর রকীব রেজা, খন্দকার ইসমাইল, অপু, রোমিও- জন গোমেজ
কলাকুশলী
নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান
মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ
বিশেষ দৃশ্যনির্মাণ : হাবিবুর রহমান
গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান
পোশাক : অশোক কর্মকার, শিউলি রহমান
সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক : ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ
প্রধান সমন্বয়কারী : গোলাম কুদ্দুছ

এই দেশে এই বেশে ২য় পর্ব
নানা
বন্ধ কর বে। বন্ধ কর চেয়ে দ্যাখ কে এলো।
নাতি
ওরে বাপ। এরা আবার কারা।
নজরুল
বল বীর চির উন্নত মম শির শির নেহারি আমারি নত শির, ঐ শিখর হিমাদ্রীর”
তথ্যমন্ত্রী
আসুন, আসুন। আমাদের তওহিদি অভিনন্দন গ্রহণ করুন, ইসলামী পুনর্জাগরণের মহাকবি নজরুল ইসলাম। বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসবে আপনাকে পেয়ে আমরা ধন্য। কিন্তু ওঁনাকে তো চিনতে পারলাম না।
[ এই দেশে এই বেশে ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]
নজরুল
বলেন কি? ওনাকে চিনতে পারলেন না? উনিই তো অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
রাজা
মোবারকবাদ মোবারকবাদ। আপনার আগমনে আমরা সত্যিই আনন্দিত।
শরৎচন্দ্র
পল্লী বাংলার চিরন্তন আকর্ষণের মোহ কি এতো সহজে ছাড়া যায়? তাই ছুটে এলাম, সত্যিই দাদা আপনারা মহান। নিজের ঐতিহ্য আর কৃষ্টির জন্য এতো আত্মত্যাগ ইতিহাসে একটা বিরল দৃষ্টান্ত দাদা।
নজরুল
তা উৎসব করছেন আপনারা, হঠাৎ করে এই অধমদের ডাক পড়লো কেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
বলেন কি? আপনারা আমাদের মেহমান। উৎসব উদ্বোধন তো আপনারাই করবেন ।
নজরুল
জেনে নিলাম । এদেশকে তো মোটামুটি চিনি। কথায় বলে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। কিছু মনে করবেন না। আমার কোথায় যেন একটা সন্দেহ হচ্ছে।
রাজা
না না। এখানে সন্দেহের কিছু নেই। সব কিছু পরিষ্কার। আমরা কিছু কাজ করেছি। যার জন্য আপনাদের একটু সমর্থন দরকার।
নজরুল
সমর্থন। আমাদের? আমাদেরকে কোনো পার্টি-টার্টিতে জয়েন করাবেন না তো আবার?
ধর্মমন্ত্রী
আল্লার চোখে তিনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ ইনসান, যার বিশ্বাসের ভিত্তিটা প্রগাঢ়। আমি বলি বিশ্বাসটা রাখুন।
নজরুল
বিশ্বাসের কথা বললেন হাজাম সাহেব? তাহলে বলি, আল্লাকে যে বিশ্বাস করে সে কোনো যুক্তিতেই আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে না।
শরৎচন্দ্র
ছি ছি, এসব কি বলছো নজরুল। রগচটা অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারলে না? আফটার অল তুমি এখানকার অতিথি । একটু বুঝেশুনে কথা বলো ।
হুরমত
মালাউন অইলেও জব্বর একখান কথা কইছেন। আহেন আরবি কায়দায় একখানা চুম্বা খাই। (শরৎকে জোর করে হুরমত চুমো খাওয়ার চেষ্টা করে)
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সত্যিই আপনি আপনার গল্প উপন্যাসের মতই উদার। আমি আপনার একজন ফ্যান। আপনার লেখনিতে আপনি যেভাবে বর্ণহিন্দুদের চিত্রিত করেছেন তা তৎকালীন বৃটিশ ভারতের মুসলমানদের সাংঘাতিকভাবে আন্দোলিত করেছে।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
এবং এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, তিনি যেভাবে তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে গোঁড়া হিন্দুদের ধোলাই করেছেন, তাতে একথাই প্রমাণিত হয় উনি হিন্দু ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মুসলমান ধর্মের প্রতি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন ।
ধর্মমন্ত্রী
এটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, তৎকালীন বৃটিশ ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাঁর এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে দ্বীন ইসলামের পথে টেনে আনতে পারেন নি। যদি পারতেন তবে আজকের ইতিহাস হতো ভিন্ন ।

রাজা
তাতে কি হয়েছে? আমরা এখনো তাকে দীক্ষিত করতে পারি।
শরত্চন্দ্র
এ কোন জায়গায় এসে পড়লুম নজরুল। এসব কি কথাবার্তা বলছে?
নজরুল
কেন? তখন তো আসবার জন্য খুব লাফঝাঁপ করছিলে। এখন ঠেলাটা বোঝ
শরৎচন্দ্র
আমার মনে হয় আপনারা কোথাও একটা ভুল করছেন।
রাজা
হুজুরে কামেল, আমার মাথায় চমৎকার একটা বুদ্ধি এসেছে।
ধর্মমন্ত্রী
খোলাসা করো।
রাজা
এখনকার যেই বিতর্কিত রাজনৈতিক অবস্থান আমাদের, তাতে করে শরৎচন্দ্রের মতো লোককে যদি আমাদের পথে দীক্ষিত করতে পারি, দেখবেন সব সমালোচকের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে।
ধর্মমন্ত্রী
মন্দ বলে নি। হুরমত?
হুরমত
বান্দা হাজির। (ধর্মমন্ত্রী ও হুরমত কানে কানে কথা বলে) আহেন শরৎসাব। সিনায় সিনা লাগাই। আপনারে একখান কিসসা কই। পাকিস্তান অগুনের টাইমে আমার এক জানের দোস্ত আছিল। নাম শঙ্কর। কংরোস করতো। মেলা মুসলমান হালায় চক্ষের সামনে জবাই করছে।
মগর আমরা ছিলাম খান্দানি মুসলমান, কোন দিন হে আমাগো অসম্মানী করে নাই। আমিও বহু মালাউন কচুকাটা করছি। মগর কোনোদিন শঙ্করের বাপের লগে বেয়াদবি করি নাই। হাজার হোক সম্মানী মানুষ তো। ঈমানে কই, আপনে দেখতে বিলকুল আমার দোস্ত শঙ্করের লাহান। আছেন আর একখানা চুমা খাই ।
শরৎচন্দ্র
ধৃত। এসব কি করছেন। কিসের শঙ্কর। কিসের কি। এ আমি কোথায় এলাম। আমার ভীষণ ভয় করছে। ভাই, আমি যাবো।
হুরমত
ডরাইয়েন না। ডরাইয়েন না। ঐ রহম ডর প্রথম প্রথম আমারও লাগতো। কামখানা আমিই করতাম। কিন্তু বড় বড় কাটাছেঁড়ার কাম করনের পরে এইসব ছোটখাট কামে মজা পাই না। ঐ যে আমাগো পীর সাহেব, তিনি আবার জাতীয় হাজাম। কামখানা তিনিই সারবেন। টেরই পাইবেন না, কোনদিক দিয়া কি অইয়া গ্যাল। লন যাই।
[ এই দেশে এই বেশে ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]
শরৎচন্দ্র
পীর। হাজাম। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
হুরমত
আরে লন না। গেলেই বুঝবেন। হুজুর, উনি রাজি।
ধর্মমন্ত্রী
আলহামদুলিল্লাহ ।
রাজা
আপনার জন্য একটা সুখবর আছে শরৎ সাহেব। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দীক্ষা শেষ হওয়ার পরে আপনাকে রাষ্ট্রীর কথাশিল্পীর পদমর্যাদায় পাঁচ ভরি স্বর্ণের পদক, ২০ হাজার নগদ টাকা এবং সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে। আশা করি এতেই বুঝতে পারছেন গুণী লোকের প্রাপ্য সম্মান প্রদানে আমরা কতো উদার।
শরৎমন্ত্রী
দাদা। আমার ভয় করছে, ঐ যে কি যেন বললেন? দীক্ষা। ওটা আবার কি?
ধর্মমন্ত্রী
ও কিছু না ।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
জাস্ট ফরমালিটি।
ধর্মমন্ত্রী
চলুন ।
শরত্চন্দ্র
না ।
(হাজাম সাহেব জোর করে শরৎচন্দ্রকে নিয়ে যায়।)

রাজা
তারপর সম্মানিত কবি। আশা করি এরি মধ্যে আপনার মেজাজটা শান্ত হয়ে এসেছে।
নজরুল
হ্যাঁ, আসলে আপনাদের ঐ হাজাম না কি, ওকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল । এই ধরনের উৎসবে ওরা কেন? কিন্তু শরৎ গেল কোথায়?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
একটু কাজে গেছে, এক্ষণই চলে আসবে ।
তথ্যমন্ত্রী
প্রিয় বিদ্রোহী কবি, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমাদের কাছে আপনার মূল্য অপরিসীম।
নজরুল
অপরিসীম?
তথ্যমন্ত্রী
হ্যা।
নজরুল
কেন? ভালোবাসার টানে? না প্রয়োজনে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
উভয়ই আপনি জানেন না, এখনকার সময়টা খুবই বিতর্কিত। আপনার সহযোগিতা আমাদের একান্তই প্রয়োজন।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
যদিও আপনার কিছু কিছু লেখা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল-
নজরুল
মাফ করবেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নয়, ধর্মান্ধ মোল্লাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে।
রাজা
তবে একথা ঠিক, এক অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্তে স্বীয় ধর্মের পক্ষে কলম ধরে আপনি নিজেকে ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
[ এই দেশে এই বেশে ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]
নজরুল
ভুল বললেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তলায়মান মুসলমান সম্প্রদায়ের চেতনা শাণিত করাটাই ছিল আমার লক্ষ্য। ধর্মটা এখানে মুখ্য নয়। মূল টার্গেট ছিল সাম্রাজ্যবাদ
রাষ্ট্রমন্ত্রী
আপনি অনর্থক বিতর্কের সূত্রপাত করছেন। আচ্ছা এটা নিশ্চয়ই আপনি স্বীকার করবেন, এই দেশে আপনার এতো প্রতিপত্তির পেছনে রয়েছে ধর্মীয় আবেগ। একজন মানবতাবাদী কবির জন্য এ যে কতো অপমানজনক এটুকু যদি বুঝতেন।
তথ্যমন্ত্রী
আপনি ইতিহাস ভুলে গেছেন।
নজরুল
ভুলে গেছি?
তথ্যমন্ত্রী
এমন কি আপনি যা যা লিখেছেন তাও ভুলে গেছেন।
নজরুল
বলছেন?
তথ্যমন্ত্রী
হ্যাঁ
নজরুল
তা কি কি ভুলে গেছি একটু স্মরণ করিয়ে দেবেন?

তথ্যমন্ত্রী
আপনার বিখ্যাত একটি পক্তি দিয়েই না হয় শুরু করি। “দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠিছে দ্বীনই ইসলামী লাল মশাল। ওরে বেখবর তুইও জেগে উঠ, তুইও তোর প্রাণপ্রদীপ জ্বাল। ” আপনার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই বিপ্লবের সেই মশাল আজ প্রজ্বলিত এই দেশের ঘরে ঘরে।
আসুন, দেশের সচেতন তাওহিদী জনতা। ইসলামী বিপ্লবের অগ্নিকবির কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে আমরাও বলি, “রহমতের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর। বদনসীব আয়, আয়, গুনাহগার, নতুন করে তওবা কর। হে বাঙ্গালি আয়, আয় নতুন করে তওবা কর।”
রাষ্ট্রমন্ত্রী
হে বেদ্বীন, হে বিপথগামী, তোমরা কি শুনছো না? তোমার মোহাব্বতের কবি, তোমার আশেকের কবি তোমাকে ডাকছেন ইসলামী দাওয়াতের তাশরিক নিতে। তোমার আখিরাতের কবি কেঁদে কেঁদে পেরেশান হয়ে বলছেন।
ঘরে ঘরে জাগো মুজাহিদ হবে হবে মোদের জয়
কতল করো সব বেদ্বীন মুজাহিদ আমার পরিচয়,
নাতি
জাগো নাহি নাহি ভয়, ইয়াহিয়া খান তোর বাপ হয়
নমরুদের ভায়রা সীমার, রাজাকার তোমার পরিচয়।
নানা
ঐ বে এর ভিতরে তুই ঢুকলি কি কইরে? অরণের কাজ ওরা করছে, মাঝখান থেকে তুই বাগড়া দিছিস কেন?
নাতি
বাগড়া না দিয়ে দিয়েই তো আজকে দেশের এই অবস্থা।
নানা
কিন্তু এখানে বাগড়া দেবার কি আছে?
নাতি
কিছু নেই?
নানা
না। আমি তো দেখছি ওরা বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের সাথে কথা কহিছে। হামদ নাত গাহিছে।
নাতি
চুল দাড়ি সবই পাকিয়েছিস, বুদ্ধিটা তোর পাকবে কবে হে নানা। কব্বরে গেলে পরে? দেখছিস না? কবি বারবার কহিছে সে মানুষের কবি। আর হেরা জোর করে তাকে সাম্প্রদায়িক বানাবে?
[ এই দেশে এই বেশে ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]
নানা
চুপ বে, কালকের দিনের ছোকরা, কথা কহে বুড়ার আগে। না হয় একটু বানালোই বা। এতে এমন কোন মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাইবে।
নাতি
আরে শালা বুড়া হাবড়া। এখন তো সাম্প্রদায়িক বানাবে। এর পরেতো কহবে, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম একাত্তর সালে আলবদর বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিল । যেই দেখলো, পিয়ারের দেশ দুই টুকরা হয়ে গেছে অমনি শোকে দুঃখে কবি বাকরুদ্ধ হইয়া পড়ে।
নানা
শালা নাতি আমার বিপ্লবী হয়ে গেছে। পাখি মারা বিপ্লবী আবে শালা। ইতিহাস, বুঝলি, ইতিহাস। কেউ চাইলেই কবিকে জোর করে আলবদর বানাতে পারবে না।
প্রমাণ কই । প্রমাণ ছাড়া কখনো ইতিহাস লিখা যায় না।
নাতি
নানা প্রমাণ ছাড়া ইতিহাস লেখা যায় না? তাইলে, হাঁর একটা কথা আছে রে। কথা হইল, একাত্তর সালে পাকবাহিনী হারগের দেশে কত অত্যাচার কইরেছে। তার কত দলিল দস্তাবেজ আছে। কিছু কিছু ইতিহাসও লেখা হয়েছে। তো কবিজি। সব কিছু জানার পরেও আপনি হাঁরগের দেশে আসলেন কেনে? ফজলি আম খাইতে?
নজরুল
না ভাই, বিশ্বাস করুন, আমার বিন্দুতম ইচ্ছা ছিল না এই দেশে আসি। কারণ এদেরকে আমি যতটুকু হাড়ে হাড়ে চিনি, ততটুকু বোধহয় আর কেউ চেনে নি। অবশ্য একেবারেই চেনে নি বললে বোধহয় ভুল হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরাই তো ধর্মের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করেছে। এই দেশে এই বেশে। আশ্চর্য’ একটা জাতি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যায় সেই তিক্ত ইতিহাস। আপনাকে, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি, আপনিই তো ছিলেন সেই ঘটনার সরব কিংবা নীরব সাক্ষী।
ধন্য মানুষ আপনারা এবং অসাধারণ আপনাদের মহানুভবতা। কানে কানে একটা কথা বলি। দেশ জাতির কথা না হয় বাদই দিলাম। আপনার প্রিয় সন্তানটির কথা অন্তত একবার ভাবুন। ১৯৭১ সালে যার জন্ম, এখন সে বাড়ন্ত টগবগে তরুণ। যে ইতিহাসটি আপনি ভুলে বসে আছেন, সেই ইতিহাসটি আপনার সন্তানকে জানান, না হলে আপনার প্রিয় সন্তানটির হাতেই উঠে আসবে এদেরই দেয়া উদ্ধত কৃপাণ । আর আমার কথা? আগেই তো বলেছি।
সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের কাছে শুধু হিন্দু পুনর্জাগরণের কবি। আর অন্যদের প্রয়োজনে ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি। কম দুঃখে লিখেছিলাম ঐ কবিতা? “তব মন্দির মসজিদে প্রভু নাই মানুষের দাবি, মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি কোথায় চেঙ্গিস, গজনী মামুন, কোথায় কালাপাহাড়? ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার। হায়রে ভজনালয়। তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়। ” ঠিক আছে, ধন্যবাদ, চলি ।
(বিকট চিৎকার করে ঢোকে শরৎচন্দ্র। সদ্য আহত রোগীর মতো লাফাচ্ছে।)
শরৎচন্দ্র
নজরুল। নজরুল। কোথায় তুমি? এ তুমি আমায় কোথায় নিয়ে এলে দাদা। এরা আমার, এরা আমার অঙ্গচ্ছেদ ঘটিয়ে দিয়েছে গো, নজরুল।
নজরুল
এই যে, এখানে আমি, তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসো। -(পালাচ্ছে)
রাজা
আরে আরে যাচ্ছেন কোথায় আপনি? রাষ্ট্রীয় কথাশিল্পী হিসেবে আপনার সোনার মেডেল, নগদ টাকা, সার্টিফিকেট – –
শরৎচন্দ্র
কি বলছে নজরুল?
নজরুল
আরে বোকা শীঘ্রই পালাও। তোমার সাতপুরুষের ভাগ্য যে শুধু মাত্র অঙ্গচ্ছেদের ওপর ফাঁড়াটা কেটেছে। আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালে ওরা তোমার শিরোচ্ছেদ করে ছাড়বে।
[ এই দেশে এই বেশে ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]
(দুজনে পালিয়ে যায়)
তথ্যমন্ত্রী
হায়! হায়! এরা তো মনে হয় পালিয়ে গেল।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
আমি শিওর, রবীন্দ্রনাথও ভেগেছে।
রাজা
তবেই সেরেছে। এখন উৎসবটা উদ্বোধন করবে কে?
গান
এবার আমায় বুঝাও নানা এই সবের অর্থ কি?
চাড়ালের খপ্পরে মিয়া বাড়ির বড় ঝি, নানা হে।
উনিশ শ একাত্তর সালে চাড়ালের দল দলে দলে
চেক করিত লুঙ্গি খুলে স্বকীয়তার সন্ধানে ।
হে নানা, বোঝাও মোরে কি এর মানে
আর কতো যাবো মোৱা পিছনে।
এখন নানা কয় না কথা মুখে জবান নাহিরে
হে নানা, লজ্জায় মুখে কথা নাহি সরে
দেশ আজ এক বিশ্ব হাজামের খপ্পরে।
(অনুষ্ঠান কক্ষে এক বৃদ্ধার প্রবেশ। আপাতদৃষ্টিতে তাকে ভিক্ষুক কিংবা পাগলের মতো লাগছে। বোকা চাহনীর মধ্যেও কোথায় যেন একটা ঘৃণা নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।)
রাষ্ট্রমন্ত্রী
আরে আরে । এই কে তুমি? এখানে ঢুকলে কি করে? এই। কে? তুমি কে?
বৃদ্ধা
আমি।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
আমি আরে আমি কি মানুষের নাম হয়? তোমার নাম কি? (নিরুত্তর) কথা বলে না। তোমার নাম কি? (নিরুত্তর) কানে শোন
বৃদ্ধা
হ
রাষ্ট্রমন্ত্রী
তাহলে নাম বলছো না কেন? কোত্থেকে এসেছ?
বৃদ্ধা
ঐ যে, ঐখান থেইক্যা
রাষ্ট্রমন্ত্রী
মুছিবৎ। তো ঐখানটার নাম কি?
বৃদ্ধা
দ্যাশ থেইক্যা আইছি।
রাজা
এই পাগল নাকি?
বৃদ্ধা
না।
রাজা
তাইলে কি ভিক্ষুক?
বৃদ্ধা
না না।

রাজা
মহামুসিবত তো, পাগলও না, ভিক্ষুকও না। সিকিউরিটি ভেঙ্গে ঢুকলো কিভাবে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্যার। বাদ দেন তো। (স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা)
তথ্যমন্ত্রী
চাওটা কি তুমি?
বৃদ্ধা
জি?
তথ্যমন্ত্রী
এখানে কি চাও?
বৃদ্ধা
দেখুম।
তথ্যমন্ত্রী
কি দেখবে?
বৃদ্ধা
আমার – (টেলিফোন বাজে। ধর্মগুরু টেলিফোন ধরে)
ধর্মমন্ত্রী
হ্যালো, কে বলছেন? জোরে বলুন। শুনতে পাচ্ছি না। হ্যাঁ, কে? ও তুমি (রাজাকে) জ্বিন ।
[ এই দেশে এই বেশে ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]
রাজা
কে?
ধর্মমন্ত্রী
জ্বিন, আমার পালা জ্বিন কথা বলছে। হ্যালো, হ্যাঁ। বলো শুনতে পাচ্ছি। না ভাই, এদিকের খবর-টবর ভালো না। তিনজন অতিথিই পালিয়ে গ্যাছে। সমস্যায় পড়ে গেছি। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার মতন লোক নাই। হ্যালো, কি বললে? তাই না কি? মারহাবা মারহাবা, ঠিক আছে। বহুৎ শুকরিয়া, রাখি খোদা হাফেজ। সুসংবাদ মাধ্যাকর্ষণ থেকে এই মাত্র আরো তিনজন মেহমান মর্ত্যযানে উঠে এখন ঢাকার পথে।
রাজা
তাই নাকি?
ধর্মমন্ত্রী
আরে হ্যাঁ, আমার পালিত জ্বিন নিজে তাদের বর্তাযানে তুলে দিয়েছে। আশা করা যায় পনের বিশ মিনিটের মধ্যে তারা পৌঁছে যাবে।
রাজা
যাক, এ যাত্রা বোধহয় বেঁচে গেলাম । নতুন তিনজন না এলে যে কি কেলেঙ্কারিটা হতো।
তথ্যমন্ত্রী
স্যার! এটা? (বৃদ্ধাকে দেখিয়ে)
রাজা
ও তুমি যাও, চলে যাও।
বৃদ্ধা
না।
রাজা
এখানে দেখার কিছু নেই। যাও।
(বৃদ্ধা কিছু খুঁজছে)
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
এই তুমি কি কিছু খুঁজছো?
বৃদ্ধা
হ
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
কি?
বৃদ্ধা
একডা গুল্লির খোসা, একডা মাথার খুলি, আর একডা –
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
আর একটা কি?
বৃদ্ধা
আর একটা, আর একডা, আর একডা য্যান কি।
রাজা
গুল্লির খোসা, মাথার খুলি। আসলে তুমি কে? কে তুমি?
বৃদ্ধা
(নিজেকেই প্রশ্ন) কিন্তা আমি (স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে) কিডা আমি।
(বিকট ভয়ার্ত চিৎকার দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঞ্চ ত্যাগ করে। টেলিফোন বাজে। ধর্মগুরু টেলিফোন ধরে।)
ধর্মমন্ত্রী
হ্যালো। হ্যাঁ বলো। না, বেশ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। (রাষ্ট্রমন্ত্রীকে) জ্বিন । আমার পালিত জ্বিন আবার টেলিফোন করেছে। হ্যালো! হ্যাঁ বলো কি? কি বললে? সর্বনাশ। ইয়া আল্লাহ্। এখন তাহলে উপায়? না না। নিশ্চয়ই তোমার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ফাঁক ছিল। ঠিক আছে, এদিকে আমরা সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। টাইম টু টাইম যোগাযোগ রাখবে। খোদা হাফেজ।

রাজা
হুজুর! কোনো দুঃসংবাদ?
ধর্মমন্ত্রী
হ্যাঁ।
রাজা
কি?
ধর্মমন্ত্রী
মধ্যাকর্ষণ থেকে বিশেষ মর্ত্যযানে ঢাকায় আসার পথে মর্ত্যযান হাইজ্যাক হয়ে গেছে।
[ এই দেশে এই বেশে ২য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]
সবাই
হাইজ্যাক। সর্বনাশ।
ধর্মমন্ত্রী
হাইজ্যাকার একজনই। বয়সে তরুণ। খালি গা। কিন্তু সমস্ত চেহারা মোবারকে অবিশ্বাস্য ক্রোধ।
রাজা
সে কি কোনো দাবি-টাবি পেশ করেছে?
ধর্মমন্ত্রী
এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে তিনজন জিম্মির সাথে বরাবরই ভালো ব্যবহার করে চলেছে।
তথ্যমন্ত্রী
ব্যাটা এই কান্ডটা ঘটালো কি করে। কে ওকে মধ্যাকর্ষণে পৌঁছিয়ে দিলো? আমেরিকা আর রাশিয়া ছাড়া তো আর কারো নভোযান নেই।
ধর্মমন্ত্রী
আরে না বাবা, হাইজ্যাকার নিজেই পরলোকের অধিবাসী। মাত্র কিছুদিন আগে এন্ট্রি ভিসা নিয়ে ঢুকেছে। যাই হোক। আমাদের ব্যবস্থা আমাদেরই নিতে হবে। জলদি করো বেটা।
তথ্যমন্ত্রী
হুজুর। একটা কাজ বোধহয় করা যায়। আপনি আপনার জ্বিন সাহেবকে বলে মর্ত্যযানটা ক্র্যাশ করিয়ে দিন না।
রাজা
আরে না। এতে অতিথিদের জীবনহানি হবে। এই কাজ করা যাবে না। অন্য কোনো বুদ্ধি ভাবো
তথ্যমন্ত্রী
জ্বিন সাহেব অবশ্য আর একটা কাজ করতে পারেন।
রাজা
কি?
তথ্যমন্ত্রী
তেনারা তো আবার ইচ্ছে মতো রূপ পাল্টাতে পারেন। মর্ত্যযান মাটিতে নামার সাথে সাথে জ্বিন সাহেব পিঁপড়ার রূপ ধরে ভিতরে ঢুকে পড়বেন। তারপর হাইজ্যাকারকে –
রাজা
দ্যাটস্ দি আইডিয়া হুজুর। এটা একটা ভালো বুদ্ধি ।
ধর্মমন্ত্রী
না। সম্ভব নয়। এটি একটি রাজনৈতিক ব্যাপার। আর জ্বিনেরা কখনো রাজনৈতিক ব্যাপারে জড়িত হতে চায় না।
নাতি
নানা! হে নানা। এটা কি কথা হলো?
নানা
ঠিক কথাই তো কহলো।
নাতি
জ্বিনেরা রাজনীতি করে না?
নানা
আবে। জ্বিনেরা যদি রাজনীতি করতো তাইলে তো বে রাজার চাকরিই থাকে না। দেখতি জ্বিন দিয়াই সকলে ক্ষমতা দখল করতে লেগেছে। এই একটা কাজ জ্বিনেরা ভালো করেছে, দেশের রাজনীতিতে তারা জড়ায় নি। না হলে তো বে, এই পাড়ার পীর আর ঐ পাড়ার পীরের পালিত জ্বিনের গুঁতোগুঁতিতে আমরা সবাই মরে ভূত হয়ে গেছিলাম।
নাতি
ঠিক বলেছিস। এটা হলে দেশের পলিটিকসও থাকতো না। দেখতি সব নেতা নেত্রীরা পলিটিকস্ ছাইড়া দিয়ে জ্বিনের সাধনায় লাইগা গেছে।
রাজা
রাষ্ট্রমন্ত্রী, আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করো। যাও।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
আমি এক্ষণই জরুরি নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি স্যার। হুরমত! হুরমত। তুমিও তোমার বিশেষ বাহিনী ছড়িয়ে দাও শহরের আনাচে-কানাচে। খালি গা, ঝাঁকড়া চুল, বয়সে তরুণ এমন কাউকে দেখলে সাথে সাথে –
হুরমত
হাতের পাঞ্জা কাইটা দিমু ।
রাজা
যা হয় করো। কিন্তু একেবারে জানে মেরে ফেলো না।
(হুরমত হুইসেল দেয়। বিশেষ বাহিনী তলোয়ার, রামদা নিয়ে ছুটোছুটি করে)
তথ্যমন্ত্রী
স্যার। এই বৃদ্ধা-
রাজা
জলদি বাইরে পাঠাও।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
স্যার। এটা বোধ হয় ঠিক হবে না। কারণ মহিলা এরই মধ্যে আমাদের বেশ কিছু আভ্যন্তরীণ সমস্যার কথা জেনে গেছে, যা বাইরে গেলে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে।
রাজা
তাহলে এখানেই আটকা থাক।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
আজকের উৎসবের সমাগত অতিথিবৃন্দ। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার জন্য আপনাদের সবাইকে দশ মিনিটের জন্য এই কক্ষ ত্যাগ করতে হবে। মাত্র দশ মিনিটের এই অসুবিধার জন্য আমরা সত্যিই দুঃখিত।
গান
দশ মিনিটের বিরতির কথা হলো নানা ঘোষণা
এই ফাঁকে চলো ঘুরে আসি বিহার কথা ভুলো না
নানা হে।
এই দেশে এই বেশে নাটক – ৩য় পর্ব:
![এই দেশে এই বেশে নাটক - এস এম সোলায়মান 17 এই দেশে এই বেশে ৩য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান](https://actinggoln.com/wp-content/uploads/2023/04/এই-দেশে-এই-বেশে-৩য়-পর্ব-নাটক-এস-এম-সোলায়মান-300x157.jpg)
প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক
প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা
কুশীলব
নানা : মিজান মুহাম্মদ শাহীন
নাতি : জন মার্টিন
রাজা : মাসুম আজিজ
তথ্যমন্ত্রী : কাজী আমিনুর
রাষ্ট্রমন্ত্রী : শামসুল আলম শাহীন
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : মিজানুর রহমান
হাজাম : মোস্তফা হীরা
হুরমত : গোলাম মোস্তফা
রবীন্দ্রনাথ : নাসিমুল হক রিপন
নজরুল : শেখ শানে মাওলা
শরৎচন্দ্র : শাহ আলম কবীর
বৃদ্ধা : রোকেয়া রফিক বেবী
চিকন আলী : নাদের চৌধুরী
বেগম রোকেয়া : মাহবুবা হক কুমকুম
জহির রায়হান : দেবাশীষ ঘোষ
কোৱাস : স্বপন সৈয়দ, কাজী শফিকুল ইসলাম, আরিফ শাহরিয়ার রিন্টু, নিশান, আবদুর রকীব রেজা, খন্দকার ইসমাইল, অপু, রোমিও- জন গোমেজ
কলাকুশলী
নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান
মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ
বিশেষ দৃশ্যনির্মাণ : হাবিবুর রহমান
গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান
পোশাক : অশোক কর্মকার, শিউলি রহমান
সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক : ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ
প্রধান সমন্বয়কারী : গোলাম কুদ্দুছ

এই দেশে এই বেশে ৩য় পর্ব
(মঞ্চে পর্ষদবৃন্দের ব্যস্ততা। ধর্মগুরু বারবার টেলিফোন ঘুরিয়েও লাইন পাচ্ছেন না। পূর্বের বৃদ্ধা ছাড়াও মঞ্চে তিনজন আগন্তুক। সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজমান।)
[এই দেশে এই বেশে ৩য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
গান
কোন ঝামেলায় পড়লো সবাই কারো মুখে কথা নাই
কি হবে উৎসবের এখন ভেবে চোখে ঘুম নাই।
নানা হে।
ঐ দিকে এক বুড়ি এসে গোস্বা করে বসে আছে
কি বলে না বলে তাহার ঠিক-ঠিকানা নাহি পাই
হায় নানা সুখী মানুষ ছিল তারা সবাই।
কি করে যে পড়লো এই ঝামেলায়
হে নানা, জ্বিন সাহেবের পারসোনাল কার হাইজ্যাকারে নিয়া যায়।
হে নানা, হাইজ্যাকারে হলো দেশ বোঝাই
এই দেশে জ্বিনেরও নিরাপত্তা নাই ।
নানা
সমস্যা।
নাতি
কি কহলি হে নানা?
নানা
আবে সমস্যার কথা কহছি। এইটাকেই বলে কপাল। এমন সুন্দর একটা আয়োজনের মধ্যে কি না এই জাতীয় বিড়ম্বনা। কোথায় ঘটা কইরে বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব উদযাপিত হইবে, তা না কেবল টেনশন আর টেনশন।
নাতি
তিনখান প্যাচ লাইগাছে রে নানা।
নানা
তিনখান না রে চারখান।
নাতি
আমি কহি তিনখান।
নানা
তিনখান?
নাতি
হ।
নানা
ঠিক আছে কহ দেখি কি কি প্যাচ?
নাতি
এক নম্বর প্যাচ, ঐ যে সেই দুষ্কৃতকারী যে কিনা হাজাম সাহেবের পালিত বেটার মর্ত্যযান-
নানা
আরে শালা। পালিত বেটা না পালিত জ্বিন।
নাতি
হ। পালিত জ্বিনের মর্ত্যযান হাইজ্যাক কইরাছে, সে ব্যাটা দিব্যি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। অথচ যানের আরোহীরা নিরাপদেই অবতরণ করলো মর্ত্যে। কারো কোনো ক্ষতি হইলো না। মাঝখান দিয়ে সেই ব্যাটা লাপাত্তা। এতো চোখকে ফাঁকি দিয়ে। ব্যাটা যখন একবার মর্ত্যে নাইমাছে, এইবার নিশ্চয়ই একটা ক্যু-
নানা
এ্যাই থুঃ থুঃ
নাতি
থুঃ থুঃ –
নানা
হ্যাঁ ঠিক কহেছিস। এইবার কহ দুই নম্বর প্যাচ।
নাতি
যেই তিনজন মেহমানকে মর্ত্যযান থেকে বাহির করা হয়েছে তারা কেহই পরিচিত নয়। অথচ বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষদেরই আজকে আসার কথা। কথা হচ্ছে যাদের আসার কথা ছিল তারা গেল কুনঠে এবং তাদের জায়গায় এরা কারা?
নানা
ঠিক কহেছিস।
নাতি
এবার কহি তিন নম্বর প্যাচ। ঐ যে বুড়ি অনুষ্ঠানে ঢুকলো, তার ঢোকার পর থেকেই যতো সব দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বুড়ি কে, কুনঠে থেকে এসেছে, এসব কিছুই কহছে না।

নানা
শেষ?
নাতি
হ শেষ।
নানা
শালা আসল প্যাচটার কথাই বলতে পারলি না।
নাতি
আসল প্যাঁচ। মানে তোর চার নম্বর। ঠিক আছে কহ।
নানা
লাইন কাট আপ।
নাতি
কি?
নানা
আরে বে লাইন কাট আপ। ঐ যে টেলিফোনটা দেখছিস না? যেইটা দিয়ে হাজাম সাহেব তার পালিত জ্বিনের সাথে কথাবার্তা কহতেন। তার লাইনটাই নষ্ট হয়ে গ্যাছে ।
নাতি
কি? এতো মহাসর্বনাশের কথা হে। এখন উপায়?
রাজা
কোনো উপায় নেই। কোনো উপায় নেই। অকর্মণ্য। অপদার্থ। সমস্ত সিকিউরিটি ফোর্সের চোখে ধুলো দিয়ে বেটা কেটে পড়তে পারলো, আর আমার সব বাঘা বাঘা নওজোয়ানরা মুখে চুষনি নিয়ে কুরকুর করে গিলছে।
[এই দেশে এই বেশে ৩য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
রাষ্ট্রমন্ত্রী
আপনি স্যার খালি আমাদের ব্যর্থতাই দেখছেন। রাত জেগে জেগে দেখুন গিয়ে একেক জনের কি অবস্থা। মাইক হাতে পাবলিক টিট আর লাঠি হাতে পাবলিক টিট দেওয়া এক কথা নয় স্যার।
রাজা
জ্ঞান দিয়েছ। আমার সোনার বলদেরা আমায় জ্ঞান দিচ্ছে। আরে বেকুবরা মনে করো কি, এ্যা? মনে করো লাঠি আর মাইকের প্রভেন আমি বুঝি না? প্রথমে তো লাঠি হাতেই মাঠে নেমেছিলাম। নাকি? পরে ধরেছি মাইক।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
জি স্যার। বিলকুল ঠিক। সে জন্যই লাঠিটা এখন আর কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ লাঠিধারীরাই এখন মাইক হাতে নেবার জন্য অস্থির হয়ে বসে আছে।
রাজা
তড়পাচ্ছ কেন? এতো তড়পাচ্ছ কেন? মাইক হাতে নেবার সময় তো আর পার হয়ে যাচ্ছে না। একটু ধৈর্য ধরো। আর মজাতো এমনিতেই কম লুটছো না।
তথ্যমন্ত্রী
স্যার, এসব বিষয় নিয়ে পরে আলোচনা করলেও চলবে। এই মুহূর্তে আমাদের সামনে এক মহাকঠিন সমস্যা। দুষ্কৃতকারী নিখোঁজ। অনাহুত তিনজন মেহমান। লাপাত্তা স্বর্গযান।
রাজা
আমার মাথায় এখন কিছুই ঢুকছে না। খালি গা । বয়সে তরুণ। চোখে মুখে ক্রোধ সমস্ত সুখ শান্তিটাই নষ্ট হয়ে গেল আমার। হুরমত আলী খান।
হুরমত
বান্দা হাজির।
রাজা
তোমরা কিছু করতে পারলে?
হুরমত
চেষ্টার ত্রুটি করতাছি না। রামদা, টেটা, বল্লম দিয়া আমাগো বাহিনী খুইজ্যা বেড়াইতেছে। ধরতে পারলেই হাতের পাঞ্জা কাইট্যা দিমু।
রাজা
এখন পর্যন্ত কোনো সংবাদ-
হুরমত
চিটাগাং এর পাহাড়ের ওপর পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বহাইয়া থুইছি, খবর পাইলেই দিয়া দিমু লগে লগে ।
রাজা
একটা সত্যি কথা বলবে হুরমত?
হুরমত
কোনোদিন আপনের লগে মিথ্যা কইছি কন?

রাজা
এই যে তোমাদের এতো আয়োজন। আমার কোনো অসুবিধা করবে না তো?
হুরমত
ছিঃ ছিঃ স্যার । কি যে কন। আর যাই করি স্যার, আমরা মুনাফেক না। দানের মর্ম ভাল কইরাই বুঝি। আমাগো লাইগ্যা আপনি যা করলেন তার তুলনা হয় না। আমরা আপনার লগে আছি। তয় একখান দুঃখ রইয়া গ্যাল স্যার।
রাজা
কি দুঃখ?
হুরমত
সিটিজেনশিপটা এখনো দিলেন না।
রাজা
চুপ চুপ। ঐ সব কথা এখন মুখেও এনো না। সময় আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্যার আমাদের এখনকার উদ্ভূত পরিস্থিতি –
রাজা
ও হ্যাঁ। ঠিক আছে। তবে হ্যাঁ হুরমত, এটা আমাদের অস্তিত্বের ব্যাপার। (স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে) কি যেন বলছিলেন আপনি? ও হ্যাঁ, উদ্ভূত পরিস্থিতি। হ্যাঁ বলেন, কি বলছিলেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
হুজুরের পালিত জ্বিন দিয়ে কি কিছু একটা করা যায় না?
রাজা
হুজুর তো একবারই বলেছেন রাজনৈতিক ব্যাপারে তারা নাক গলাবেন না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
তাই বলে এমারজেনসি টাইমেও না?
রাজা
বললেন তো, না । (বৃদ্ধা নিজে নিজে হেসে ওঠে) এই এক আপদ নিয়েও তো দেখছি মহা মুশকিল হবে।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
কোথায় যেন একটা রহস্য আছে স্যার। একটু ঠাণ্ডা মাথায় এগুলে সব জট খুলে যাবে।
তথ্যমন্ত্রী
আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
রাজা
তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেল
তথ্যমন্ত্রী
বুদ্ধিটা হলো, সেই ব্যাটা তো পালিয়েছে এবং নিশ্চয়ই বসে বসে কোনো প্ল্যান করছে। তাকে যতক্ষণ ধরা না যাচ্ছে ততক্ষণ এই তিনজনকে একটু বাজিয়ে দেখি ।
রাজা
এতে লাভ?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
আমার মনে হয় ওরা সব জানে। একই মর্ত্যযানে চড়ে তারা আসলো। মর্ত্যযান হাইজ্যাক হলো অথচ হাইজ্যাকার ব্যাটা তাদের কিছুই করলো না? ব্যাপারটা খুব রহস্যজনক না? হুরমত এক কাম করেন স্যার। হালাগোরে আমার হাতে ছাইড়া দ্যান। সিলেটে নিয়া গিয়া ফালাই। হাত আর ঠেংএর রগ কাইট্যা দিলে দ্যাখবেন, প্যাড থেইক্যা ভুর ভুর কইরা কথা বাইর অইত্যাছ। (বৃদ্ধার কান্না )
রাজা
ঐ বুড়ি চুপ করবি? চুপ। একদম চুপ
রাষ্ট্রমন্ত্রী
এদের আমার হাতেও দিয়ে দিতে পারেন স্যার। প্রপার ইন্টারোগেশন করে-
তথ্যমন্ত্রী
তবেই হয়েছে। আপনাদের যা সুনাম, ইন্টারোগেশন রিপোর্টের সাথে পোস্ট মর্টেম রিপোর্টও চলে আসবে ।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
শাট আপ। বেয়াদ্দব। জানেন আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন?
রাজা
চুপ করবেন আপনারা? দুর্যোগময় মুহূর্তে কোথায় সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে তা না, কনটিনিউয়াস একে অন্যের পিছনে কাঠি ঘুরিয়ে চলেছে। বাজে কথা রেখে এখন কাজের কথায় আসুন। ঐ যে তিনজন বসে আছে। তাদের মধ্যে পরিচিত বলে কাউকে মনে হয়?
তথ্যমন্ত্রী
না, স্যার। পরিচিত বলে তো মনে হচ্ছে না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
তবে ডান দিকের ঐ লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছি মনে হয়।
রাজা
কোথায়?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ঠিক মনে করতে পারছি না।
রাজা
আসেন সবাই মিলে একটু বাজিয়ে দেখি।
গান
এবার বুঝি লাগবে যুদ্ধ লাগলে কিন্তু থামবে না
হে নানা, নিরপেক্ষতা তোমার টিকবে না
নিরপেক্ষ হয়েও তুমি বাঁচবে না।
হে নানা সময় থাকতে শুরু কর পরে সময় হবে না।
হে নানা, দেরি করলে বাঁচা যাবে না।
দেওয়ালে ঠেকেছে তোমার পিঠখানা ।
রাজা
আপনার নাম?
জহির
জহির।
রাজা
আপনি?
চিকন
চিকন আলী।
রাজা
আপনি?
রোকেয়া
রোকেয়া।
হুরমত
আসতাগফেরুল্লা। মাইয়া মানুষ এইখানে ক্যান?

রোকেয়া
আসতে নেই নাকি ।
রাজা
না না। আসবেন না কেন? নিশ্চয়ই আসবেন। তবে-
হুরমত
আইছেন। আইছেন। কিন্তু বেপর্দা আইলেন ক্যান? বোরখা কই আপনের
রোকেয়া
আমি বোরখা পরি না। আর পর্দা করার সংজ্ঞা আপনার সাথে আমার মিলবে না।
হুরমত
কি দজ্জ্যাইল্যা মাইয়া মানুষ রে বাবা। মুখে মুখে কথা কয়।
রোকেয়া
কথা তো মানুষ মুখেই বলে। নাকি আপনি অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করেন।
[এই দেশে এই বেশে ৩য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
হুরমত
খবরদার, বেশরিয়তি কথাবার্তা এইখানে কইবেন না। ধর্মে নিষেধ আছে।
রোকেয়া
ধর্মটা কি আপনার বাবার হাতে তৈরি যে কথায় কথায় নিজের ইচ্ছা মাফিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন।
রাজা
বাদ দাও তো হুরমত। ঠিক আছে বলুন। কতোদিন ধরে আপনি পরলোকে আছেন?
রোকেয়া
অনেক দিন। সঠিক সময় বলতে পারবো না।
রাজা
আপনার স্ট্যাটাস। পরলোকে আপনার স্ট্যাটাস কি?
রোকেয়া
মানে?
রাজা
মানে, ওখানে কি আপনাকে ডিভিশন দেয়া হয়েছে?
রোকেয়া
জি।
রাজা
আপনি?
চিকন
আমারে কন?
রাজা
আপনাকেই বলছি। কতদিন ধরে ওখানে আছেন?
চিকন
তা, ১৬/১৭ বছর তো অইবেই।
রাজা
ডিভিশন পেয়েছেন?
চিকন
না। আমি তো ফাঁসির আসামি, হের লাইগ্যা নন ডিভিশন।
তথ্যমন্ত্রী
কি? ফাঁসির আসামি, ওরে বাবা। ফাঁসির আসামি এখানে কেন? এ রকম তো কথা ছিল না। হুজুর ও হুজুর। ধ্যান ভাঙুন। দ্যাখেন আপনার পালিত জ্বিন কি করে বসেছে। হুজুর ও হুজুর।
ধর্মমন্ত্রী
কি হয়েছে বেটা?
তথ্যমন্ত্রী
ফাঁসির আসামি।
ধর্মমন্ত্রী
ফাঁসির আসামি। কোথায়? (ধর্মগুরু ভয়ে পালাবার চেষ্টা করে)
তথ্যমন্ত্রী
ঐ যে ।
ধর্মমন্ত্রী
টেলিফোন নষ্ট । কি করে বলি। আল্লাহ ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
এই ব্যাটা খুনির বাচ্চা খুনি। বল, ঠিক ঠিক করে বল। তোকে এখানে কে পাঠিয়েছে। নাইলে বেত মেরে পিঠের চামড়া তুলে নেবো।

চিকন
(স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে) স্যার, আমারে চিনতে পারলেন না? আমি চিকন আলী। ভুইলা গ্যালেন এতো তাড়াতাড়ি?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
আমারও মনে হচ্ছে এর আগে অন্য কোথাও তোমাকে দেখেছি। কোথায় দেখেছি বলো তো?
চিকন
আমি চিকন আলী স্যার।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চিকন আলী কোন চিকন আলী?
চিকন
ঐ যে স্যার যুদ্ধের টাইমের কথা। আমি ছিলাম আপনের একজন নগণ্য প্রজা। মনে পড়ছে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চিকন আলী। যুদ্ধের টাইমের কথা (চিৎকার) চিকন আলী। চিকন আলী, তুমি এখানে কেন? কে? আমি জিজ্ঞেস করছি কে তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে?
রাজা
কি ব্যাপার আপনি হঠাৎ এতো উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কেন? ঘটনা কি? বলুন। লোকটা কি আপনার জন্য ক্ষতিকর কেউ? কি? হলো কি আপনার? কথা বলছেন না যে? লোকটাকে কি আপনার নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
হুমকি? না স্যার।
রাজা
তবে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
না স্যার, ও কিছু না।
রাজা
কিছু না বললে তো হবে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। না হলে ওভাবে চিৎকার করে উঠলেন কেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চিৎকার করেছিলাম?
রাজা
হ্যাঁ, রীতিমত চিৎকার। সাধারণত যা আপনি করেন না। কিন্তু কেন? চেনেন ওকে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চিনি। মানে না স্যার। হ্যাঁ কিছুটা।
রাজা
কে ? ও?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ও?ও হচ্ছে-
রাজা
কে? কথা বলুন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্যার মানে আমার আপনার, মানে আমাদের অতীতটাতো খুব ভালো নয়। তাই বলছিলাম আর কি। অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাটি না করলে কি হয় না? (বৃদ্ধার কান্না )
[এই দেশে এই বেশে ৩য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
রাজা
সমস্ত রহস্যের জট আমাকে খুলতেই হবে। তা হলে চিকন আলীকে আপনি চেনেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
জি স্যার, কিছুটা।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
স্যার, একটা ব্যাপারে আমার খুব খটকা লাগছে।
রাজা
কি খটকা?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
এদেরকে এখানে পাঠানো হলো কেন? একজন বেপর্দা মহিলা, একজন ফাঁসির আসামি, আরেকজন কোথাকার কোন জহির।
তথ্যমন্ত্রী
নিশ্চয়ই। কোথাও না কোথাও একটা ঝামেলা হয়েছে।
ধর্মমন্ত্রী
ইয়া আল্লাহ।
নাতি
নানা। হে নানা।
নানা
কহ।
নাতি
হারও কিন্তু মনে হইলো কোথাও একটা ঝামেলা হয়েছে।
নানা
সে তো বে দেখতেই পাচ্ছি। এমন সুন্দর একটা উৎসবে এতক্ষণে কতো জমজমাট নাচগান হইতো। মণ্ডা মিঠাই আর রসগোল্লার নহর বইয়া যাইতো। ঝামেলার জন্যই তো কিছু হতে পারছে না।
নাতি
একটা কথা কহি নানা ।
নানা
কহ।
নাতি
মারবি না তো?
নানা
না ।
নাতি
এই যে ধর্ম লিয়ে এতো বাড়াবাড়ি, এইটা আল্লাও পছন্দ করছে না বলেই ঝামেলা লাগাইয়া দিছে।
রাজা
(তথ্যমন্ত্রীকে) তোমার এই রকম মনে হওয়ার কারণ?
তথ্যমন্ত্রী
আয়নায় নিজের চেহারাটা মাঝে মাঝে দেখি তো, সে জন্য ।
রাজা
ভণিতা না করে যা বলার সোজাসুজি বলো।
তথ্যমন্ত্রী
বিষয়টা হচ্ছে, আপনি আমি যে ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, তাতে তো অনেক আগেই আমরা ধর্ম থেকে খারিজ হয়ে গেছি।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
ঠিক স্যার। একদম ঠিক। আমি কিন্তু অনেক বার আপনাকে পরামর্শ দিয়েছি। আর যাই করেন না করেন, আল্লার ঘর মসজিদে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলবেন না।
রাজা
এ্যাই চুপ একদম চুপ । কি আমার ধর্মবীর যুধিষ্ঠির পরামর্শদাতা। মাথা ভর্তি গোবর।
ধর্মমন্ত্রী
মাথা গরম করো না বেটা। বালা মুসিবত আসে। আসবে। আবার আপনা-আপনি কেটে যাবে। একিন ঠিক রাখ বেটা। একিন। আল্লাহ্।
রাজা
চিকন আলী। তুমি তা হলে ফাঁসির আসামি।
চিকন
জি স্যার।
রাজা
ঠিক ঠিক দুইটি প্রশ্নের জবাব দেবে। না হলে তোমাকে দ্বিতীয়বারের মতো গলায় দড়ি দিতে হবে। আমার প্রথম প্রশ্ন, মর্ত্যযানের হাইজ্যাকার কে এবং এখন কোথায় । দ্বিতীয় প্রশ্ন, কেন তোমার ফাঁসি হয়েছিল এবং এখানে কিভাবে আসলে।
চিকন
পরথমে কই, ক্যামনে এইখানে আইলাম। হেরা কইলো, যাও চিকন আলী, কিছুক্ষণের জন্য নিজ দেশ থেইক্যা ঘুইরা আস। হাজার হোক নিজের দ্যাশ তো স্যার । ফাল দিয়া উইঠ্যা বইলাম গাড়িতে ঝিমানি আইছিল, আতকা দেখি, একটা পোলা, বয়স বড় জোর ২৩/২৪ অইবো। হে কইলো, হে গাড়ি হাইজ্যাক করছে। বাপদাদার চৌদ্দ গুষ্টির কেউ তো আর লেখাপড়া শিখে নাই। তাই হাইজ্যাক কি বুঝি নাই। ভাবলাম, আমাগো মতনই কেউ অইবো। আবার ঘুমাইয়া পড়লাম। ঘুম ভাঙলে দেখি, আপনের লোকজন আমারে গুতাইতেছে।
তথ্যমন্ত্রী
বোঝা গেল, সত্য কথা বলছে না।
রাজা
এবার বলো। কিভাবে তোমার ফাঁসি হলো।
চিকন
হেইডা কওন যাইবো না স্যার।
রাজা
কেন?
চিকন
কইলে আপনেগোরই অসুবিধা।
রাজা
কি অসুবিধা ।
চিকন
অসুবিধা কি একটা? হাজারটা ।
রাজা
চিকন আলী।

চিকন
খামাকা গরিবের উপর ঝামেলা চাপান স্যার। ক্যান আমার ফাঁসি অইছিল হেইডা কইলে তো আপনের ঐ মন্ত্রী সাবের অন্তত পঁচিশবার ফাঁসি অইবো।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
খবরদার। খবরদার বলছি চিকন আলী। তোমার কোনো ঘটনার সাথে যদি আমাকে যুক্ত করো তবে টান দিয়ে তোমার জিহ্বা ছিঁড়ে নেবো।
রাজা
(ঠাণ্ডাভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে) হয়েছেটা কি আপনার আজকে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সরি স্যার।
রাজা
হ্যাঁ, এবার বলো, কিভাবে তোমার ফাঁসি হলো ।
চিকন
আমি কইতে পারুম না স্যার।
রাজা
চিকন আলী। বলতে যে তোমাকে হবেই।
চিকন
ক্যামনে কই। এতো কষ্ট, এতো লজ্জার কথা ক্যামনে কই?
রাজা
যত কষ্টেরই হোক । বলতে তোমাকে হবেই।
চিকন
স্যার। ঐ যে বুড়ি। হেরে জিগান, হে জানে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
(চাপা চিৎকার) চিকন আলী।
রাজা
বৃদ্ধা। ঐ বৃদ্ধার সাথে এই সবের কি সম্পর্ক?
চিকন
আছে স্যার।
রাজা
এই রহস্যের জট আমাকে গুলতেই হবে। তুমি তাকে চেন?
চিকন
চিনি স্যার
রাজা
(স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে) আপনি তাকে চেনেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
না স্যার।
চিকন
মিছা কথা কইয়েন না স্যার। আপনি তারে চেনেন। ভালো কইরাই চেনেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
(চাপা চিৎকার) চিকন আলী (চিকন আলীর কলার চেপে ধরে) ।
চিকন
রাগ করলেন, স্যার? এরেই কয় কপাল। তাইলে কই। আমার নাম চিকন আলী। তৎকালীন রাজাকার বাহিনীর একজন নগণ্য সদস্য। দেশ স্বাধীন হওনের পরে আমিই একমাত্র রাজাকার বিচারে যার ফাঁসি হয়।
[এই দেশে এই বেশে ৩য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
হুরমত
ও! তুমি। তুমিই সেই শহীদ রাজাকার চিকন আলী আস। কাছে আস ভাই। আরবী কায়দায় একখান চুম্বা খাই। খোরমা আছে, খাইবা?
চিকন
স্যার।
হুরমত
উটের গোশত, একদম খাঁটি, মরুভূমির।
চিকন
না স্যার, হজম অইবো না।
ধর্মমন্ত্রী
(চিকনকে ফুঁ দেয়) জিত রহো বেটা। জিত রহো। শহীদের চিরকাঙ্ক্ষিত পথে তোমার বিচরণ। আল্লাহ তোমাকে বেহেস্ত নসীব করুক।
চিকন
রাজাকার চিকন আলী। চিকন আলী রাজাকার। কইছিলাম না চান কপাল? কেউ ধারে কাটে, কেউ ভারে কাটে। আর যার কিছুই নাই, হে ডুকরাইয়া কান্দে। মনে আছে, স্যার? যুদ্ধের টাইমে আপনের কাছে গেছিলাম কিছু সাহায্য নিতে। ঘরে খাওন নাই। পোলার মুখে দুধ নাই। একখান মাত্তর জমি। হেইডাও তহন মহাজনের প্যাডে আপনের দয়ার শরীর আমারে একখান চাকরি দিলেন। রাজাকারের চাকরি। মাসিক বেতন ১১০ ট্যাহা ।
বিদ্বান লোক আপনি । কইলেন, চিকন আলী একটা কাফের মারতে পারলে ৭০ হাজার সওয়াব পাওন যায়। আপনের কথা অবিশ্বাস করি ক্যামনে? আমার বাপদাদা আজীবন আপনের বাপদাদারে বিশ্বাস কইরা আইছে। নিয়ম ভাঙ্গি ক্যামনে। আমিও আপনেরে বিশ্বাস করছি। আপনি কইলেন, যারা জয় বাংলা কয় হেরা সব কাফের।
অতএব কাফের মাইরা মাইরা সওয়াব কামাও। ১১০ ট্যাহা বেতন আর ৭০ হাজার সওয়াবের নেশায় কাফের আমিও মারছি। করো বাড়ি ঘরে আগুন দিছি। কত্তো মায়ের বুক খালি করছি (বৃদ্ধার কান্না)।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
এই বুড়ি। চুপ করো । চুপ করো বলছি।
রাজা
হ্যাঁ। চিকন আলী, তারপর?
চিকন
হেরপর আর কি। যথানিয়মে দ্যাশ স্বাধীন অইলো। ধরা পইড়া আমি তহন জেলে ।
বিচারের টেরইবুনাল তৈরি অইয়া আছে। আমি তহন স্যার বারি দিয়া আপনেরে খুঁজি । আপনেরে পাইলাম ঐ ট্রেরাইবুনালে। কিন্তু আশ্চর্য কাম। এইডা ক্যামনে সম্ভব? আপনে বিচারক আর আমি আসামি? আমি খালি দ্যাখলাম স্যার, আপনে কেমন গম্ভীর অইয়া বিচারের রায় পড়লেন। সত্তর হাজার সওয়াব না, চিকন আলীর ফাঁসি। সেই আপনি। কইছিলাম না? কপাল, চান কপাল।
কাফের তো আপনিও মারছেন। আমিও মারছি। বাড়ি ভিটায় আগুন আপনেও দিছেন, আমিও দিছি। কিন্তু দ্যাহেন, কি কারবার। ফাঁকতালে আপনি পাইলেন মন্ত্রীর চাকরি, আর আমি পাইলাম একখান ফাঁসির দড়ি। তয় স্যার, গত ১৭/১৮ বছর ধইরা এই একখান কথাই ভাবছি। ক্যান। ক্যান আমি করতে গেলাম এই কাম?
বৃটিশ কন, পাকিস্তান কন, আর বাংলাদেশ কন, আমার কি লাভ? আমি যেই তেনা হেই তেনা। দ্যাহেন গিয়া আমার পোলার অবস্থাও তাই। তাইলে ক্যান করলাম এই কাম? ৭০ হাজার সওয়াব না ১১০ ট্যাহা বেতন। আসলে আমি কি। হিন্দু, বুদ্ধ, খৃষ্টান, মুসলমান?দেখলাম, আমি কিছুই না। পরিচয় আমার একটাই। আমি ছিঁড়া তেনা, গরিব।
হুরমত
ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এই সব কি কথা কও চিকন আলী। এইসব তো হারমজাদা কম্যুনিস্ট গো কথা ৷ একজন শহীদ রাজাকার অইয়া তুমি এইসব কি কথা কও ভাই । বুঝছি। তুমি দিলে বহুৎ চোট পাইছ। অসুবিধা নাই। ঐ মেডিক্যালের লগে যে শহীদ মিনারটা আছে, ঐখান থেইকা হেগো নাম কাইট্যা তোমার নাম বহাইয়া দিমু। কি? এইবার খুশি ত
ধর্মমন্ত্রী
ঠ্যায়রো বেটা, ঠ্যায়রো। একজন ইসলামী আন্দোলনের সৈনিকের মৃত্যুর পরে এভাবে বিপথগামী হওয়াটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পরলোকে তার সাথে সদ্য প্রয়াত কোন কম্যুনিস্ট নেতার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে।
চিকন
না স্যার, কোন নেতার লগে আমার আলাপ পরিচয় অয় নাই। তয় জার্মান মুলুকের এক সাবের লগে দেখা অইছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তিনি নাকি সেনাপতি আছিলেন। এবং কোর্ট মার্শালে তেনার ফাঁসি অয়। তিনি কইলেন, তেনাগো সাধারণ সৈন্যের কিছু অয় নাই। খালি আমাগো দ্যাশে দ্যাখলাম উল্টা কাম। চিকন আলীর হয় ফাঁসি আর যুদ্ধ অপরাধী সেনাপতি অয় মন্ত্রী।
রাজা
চিকন আলী। তুমি একটু বেশিই বুঝে ফেলেছ। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত। কিছুক্ষণের জন্য তোমাকে সংশোধনী সেলে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে একটা রহস্যের জট খুলে দিয়ে যাও। এই বৃদ্ধাকে তুমি চেন?
চিকন
(নিরুত্তর) জবাবটা খুব দরকার, স্যার?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
উত্তর দেয়ার জন্য তুমি বাধ্য নও চিকন আলী।
রাজা
চিকন আলী আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
আমার একটা অনুরোধ
রাজা
রাজা হাইজ্যাকার যতক্ষণ ধরা না পড়ছে, আমাকে সব জানতে হবে। চিকন আলী।
চিকন
চিনি স্যার।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চিকন আলী। চিকন আলী তুমিও….
চিকন
স্যার। পাপ কখনো বাপেরেও ছাড়ে না।
রাজা
এই বৃদ্ধা কে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
আমি তোমাকে মিনতি করছি চিকন আলী।
রাজা
(চিৎকার করে) চিকন আলী।
চিকন
ধমকান ক্যান স্যার। আমি তো আপনের পরজা নই যে ধমকি করবেন? আমি এখন অন্য জগতের বাসিন্দা। ইচ্ছা অইলে কমু, নইলে কমু না।
রাজা
ও। (বৃদ্ধাকে) কথা এইবার তোমাকে বলতেই হবে। বলো নাম কি তোমার। কে তুমি?
বৃদ্ধা
আমি? কিডা আমি । কি যেন ছিল একডা নাম? কতো বছর আগে পঞ্চাশ কিংবা ঘাট?
চিকন
না মা। ১৭/১৮ বছর আগেকার কথা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চিকন আলী।
রাজা
উইল ইউ প্লিজ শাট আপ?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সরি স্যার।
রাজা
হ্যাঁ। এবার বলো। ১৭/১৮ বছর আগের কথা। এক যে ছিল রাজপুত্তুর, আর এক ছিল রাজকন্যা।
বৃদ্ধা
না। রাজপুত্তুর তো ছিল না। রাজকন্যা ছিল। সাত রাজার ধন মানিক রতন একমাত্র রাজকন্যা।
রাজা
তারপর? (নিরুত্তর) বলো। রাক্ষস এলো। রাজাকে মারলো। রাক্ষস। হ। হ। রাক্ষস। ছয়ফুট উঁচা, বিলাই চোখা ইয়া বড় এক রাক্ষস। শোন দৃষ্টিতে গিইলা খাইতো বেবাক। পাখির মতন গুল্লি কইরা মারতো মানুষ। আর কুইরা কুইরা খাইতো মাইয়া মানুষের নরম শরীর। একদিন কি যেন ছিল তার নাম :
চিকন
কর্নেল শেখ
বৃদ্ধা
কর্নেল শেখ একদিন কি এক উছিলায় আইলো আমাগো বাড়ি, লগে …. ।
চিকন
আপনের সোয়ামি । তিনি তখন স্থানীয় শান্তি কমিটির অলিখিত চেয়ারম্যান।
বৃদ্ধা
কর্নেল সাবের দোস্ত তিনি। চোখে মুখে নানান কিছিমের খোয়াব । আমিও সৈয়দ বাড়ির মাইয়া। চল্লিশ বছর বয়সেও মাইনষে কইতো ডানাকাটা পরী। একদিন রাইতে। হেইদিন আমার সোয়ামি বাড়ি নাই। কই জানি গেছে। দেখি একা আসছেন কর্নেল সার। হাতে বন্দুক। তারপর — তারপর (বৃদ্ধার কান্না) পরে হুনছি। বুঝছি। আমার সোয়ামি জানতেন ঐ দিন কর্নেল সাবে আইবেন।
রাজা
তারপর?
বৃদ্ধা
এইভাবে দিনের পর দিন মাসের পর মাস একই বিছানায় গলাকাটা মুরগির মতন ছটফট করছি। সামনে জ্বলজ্যান্ত রাক্ষস। নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসে। মন খুইল্যা যে একটু কান্দুম হেই উপায়ও নাই। ঘিন্নায় নিজের গায়ে নিজে থু থু ছিটাইছি। কতোবার ভাবছি, জীবন দিয়া সোয়ামির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করি। কিন্তু আমার কিশোরী মানিক রতনরে কার হাতে থুইয়া যামু? নিজের জীবন থেইক্যা তার জীবন যে অনেক বড়।
রাজা
তারপর ?
বৃদ্ধা
তারপর একদিন দুপুরে পুকুরে গেছি ওজু করতে। দিনের সূর্য তহনো মাথার ওপর। জোহরের নামাজ সামনে। আল্লার কালাম পইড়া পাক পবিত্র হমু। আল্লার কাছে বালা থেইক্যা পানা চামু। তড়িঘড়ি কইরা ঘরে আইয়া দরজা খুইলা দেহি আমি দেহি, আমার বিছানায় আমার মানিকের রক্তাক্ত শরীর।
মায়ের বিছানায় মাইয়াও মায়ের লাহান গলাকাটা মুরগির মতন ছটফট করে। আপনেগো আল্লার দোহাই। দোহাই পীর পয়গম্বরের বিশ্বাস কইরেন না। বিশ্বাস কইরেন না দুনিয়ায় এতো 1 পাপ থাকতে পারে। আমিও বিশ্বাস করি না দুনিয়ায় কোনো সোয়ামি নিজের বউ মাইয়ারে রাক্ষসের হাতে তুইলা দিতে পারে।
গান
ক্যামনে ভুলি মায়ের কথা, বোনের এত যাতনা
মা বোনের মাতমে নানা হৃদয়ের বাঁধ মানে না
হে নানা।
উনিশ শ একাত্তর সালে আমার বোনের চোখের জলে
খোদার আরশ লড়ে গেল খান সেনার মন গলে না
হে নানা।
এই দেশে এই বেশে নাটক – ৪র্থ পর্ব:
![এই দেশে এই বেশে নাটক - এস এম সোলায়মান 17 এই দেশে এই বেশে ৩য় পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান](https://actinggoln.com/wp-content/uploads/2023/04/এই-দেশে-এই-বেশে-৩য়-পর্ব-নাটক-এস-এম-সোলায়মান-300x157.jpg)
প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক
প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা
কুশীলব
নানা : মিজান মুহাম্মদ শাহীন
নাতি : জন মার্টিন
রাজা : মাসুম আজিজ
তথ্যমন্ত্রী : কাজী আমিনুর
রাষ্ট্রমন্ত্রী : শামসুল আলম শাহীন
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : মিজানুর রহমান
হাজাম : মোস্তফা হীরা
হুরমত : গোলাম মোস্তফা
রবীন্দ্রনাথ : নাসিমুল হক রিপন
নজরুল : শেখ শানে মাওলা
শরৎচন্দ্র : শাহ আলম কবীর
বৃদ্ধা : রোকেয়া রফিক বেবী
চিকন আলী : নাদের চৌধুরী
বেগম রোকেয়া : মাহবুবা হক কুমকুম
জহির রায়হান : দেবাশীষ ঘোষ
কোৱাস : স্বপন সৈয়দ, কাজী শফিকুল ইসলাম, আরিফ শাহরিয়ার রিন্টু, নিশান, আবদুর রকীব রেজা, খন্দকার ইসমাইল, অপু, রোমিও- জন গোমেজ
কলাকুশলী
নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান
মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ
বিশেষ দৃশ্যনির্মাণ : হাবিবুর রহমান
গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান
পোশাক : অশোক কর্মকার, শিউলি রহমান
সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক : ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ
প্রধান সমন্বয়কারী : গোলাম কুদ্দুছ

এই দেশে এই বেশে ৪র্থ পর্ব
নাতি
একটা কথা কহ দেখি নানা।
নানা
কি কথা?
নাতি
এখন যারা দেশে জিহাদের কথা কইছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তো তারা বাঁইচা ছিল,নাকি?
নানা
শুধু বাঁইচা থাকা? যাকে কহে শান শওকতের সাথে বাঁইচা থাকা।
নাতি
হাঁরগের দেশে লাখ লাখ মা বোনের উপর এই রকম নির্যাতন করছিল খান সেনারা, আল্লার বিধান অনুসারে জিহাদ তো তখনই করার কথা। জিহাদ তো দূরের কথা এই সব লোকজনই তো হাঁর দেশের মা-বোনদের ধইরা খান সেনার হাতে তুইলা দিয়াছিল ।
[এই দেশে এই বেশে ৪র্থ পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
(বাইরে থেকে ছুটে আসে রাষ্ট্রমন্ত্রী)
রাষ্ট্রমন্ত্রী
স্যার। স্যার।
রাজা
কি ব্যাপার?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
দেখা গেছে স্যার। দেখা গেছে।
রাজা
দেখা গেছে। কাকে?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
সেই দুষ্কৃতকারী হাইজ্যাকার। খালি গা। আর কি ভয়ানক চোখ। গ্রেপ্তার করেছো?
রাজা
কি সাহস? ব্যাটা এই প্রাসাদের অভ্যন্তরেই ঘোরাফিরা করছিল।
ধর্মমন্ত্রী
সর্বনাশ। প্রাসাদের অভ্যন্তরে?
রাজা
আমি জিজ্ঞেস করছি, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা ?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
না স্যার। আমাদের নিরাপত্তা রক্ষীরা তাকে স্পষ্ট দেখেছে। কিন্তু পরক্ষণেই ব্যাটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
তথ্যমন্ত্রী
তার মানে তো যে কোনো মুহূর্তে এখানেও ঢুকে পড়বে।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
হুজুর, বুঝতেই তো পারছেন। নিজেদের জানের ওপর হুমকি, এরপরেও কি আপনার জ্বিন সাহেব রাজনৈতিক ব্যাপারে নাক গলাবে না?
ধর্মমন্ত্রী
ইয়া আল্লাহ।
রাজা
একটা সত্যি কথা বলবেন হুজুর আমার মাথাটা যেন ক্যামন গোলমাল হয়ে গেছে। বলবেন সত্য একটা কথা?
ধর্মমন্ত্রী
কি কথা বেটা?
রাজা
ঐ হাইজ্যাকারটা আবার আপনার পালিত জ্বিন নাতো?
ধর্মমন্ত্রী
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
রাজা
দুঃখিত হুজুর। আরো কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাও। শুনুন সবাই। বিপদ আসন্ন। অত্যন্ত দ্রুত কাজকর্ম সেরে ফেলতে হবে। চিন্তার কোনো কারণ নাই। উৎসবটা শেষ করতে পারলেই সব ঝামেলা চুকে যাবে। আর একটা কথা। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ বাইরে যাবেন না । এই দুজনকে (বৃদ্ধা ও চিকন) বাইরে পাঠাও। (স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে) মানুষের জীবনটাই হচ্ছে ঘটনাপূর্ণ। ঠিকঠাক মতন কাজ করতে থাকুন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্যার। আমার চাকুরিটা থাকবে তো।
রাজা
হু! এইবার আপনি। বলেন এই হাইজ্যাকারটা এখন কোথায়?
রোকেয়া
হাইজ্যাকার কোথায় সেটা নিশ্চয়ই আমার জানার কথা নয়।
রাজা
অবশ্যই আপনার জানার কথা। আপনারা একসাথে এসেছেন।

রোকেয়া
আমরা তিনজন একসাথে এসেছি, চারজন নয়। আর সারাটা পথ আমি ঘুমিয়েই কাটিয়েছিলাম। কাজেই ঐ ঘটনা সম্পর্কে আমি মোটেই ওয়াকেবহাল নই।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
কেউই সত্য কথা বলছে না।
হুরমত
স্যার কিছুই তো আমারে করতে দিলেন না। এই কেইসটা আমার হাতে ছাইড়া দেন। দ্যাহেন আমি এর প্যাট থেইক্যা কথা বাইর করতে পারি কিনা।
রাজা
এই মহিলাকে?
হুরমত
হ স্যার।
রাজা
হুরমত। কোন মার্ডার কেসের দায়-দায়িত্ব আমি তোমার খাতিরে নিতে পারি। কিন্তু এই মুহূর্তে কোন রেপকেসের দায়-দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না। দুঃখিত। কি নাম বললেন যেন আপনার?
[এই দেশে এই বেশে ৪র্থ পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
রোকেয়া
বেগম রোকেয়া
রাজা
বেগম রোকেয়া নামটা খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
তথ্যমন্ত্রী
না স্যার। তেনাদের কেউ উনি না।
রাজা
চুপ কর ব্যাটা মাথামোটা বেয়াক্কল।
ধর্মমন্ত্রী
মা জননীর পরিচয়টা আমিই দিচ্ছি। উনি এক সময়ের বৃটিশ ভারতের মুসলিম নারী সমাজের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। গ্রামের বাড়ি পায়রাবন্দ, রংপুর। স্বামী সাখাওয়াত হোসেন, প্রাক্তন ম্যাজিস্ট্রেট।
রাজা
কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য। আপনিই বেগম রোকেয়া? আপনাকে সহস্র কোটি অভিনন্দন। আর চিন্তা নেই। বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব উদ্বোধক আমরা পেয়ে গেছি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্যার। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। খাতা কলম দরকার।
রাজা
খাতা কলম কেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
উৎসব উদ্বোধনের পূর্বে আমাদের পক্ষে ইমার একটা বিবৃতি নিয়ে নিই।
রোকেয়া
মাফ করবেন। কিসের বিবৃতি?
রাজা
দেখুন। আমাদের দেশের মহিলারা ইদানিং নারী স্বাধীনতার নামে এমন কিছু কাজ করছে যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত আপত্তিকর। আপনিই বলুন ঘরের মা বোনেরা যদি ঘর-সংসার ছেড়ে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে বেড়ায় তাহলে আমাদের সংসারে আদর্শ পরিবার বলতে কিছু থাকবে?
রোকেয়া
আজ থেকে শত বছর আগে, আমি তখনো চার দেয়ালের মাঝে অবরুদ্ধ, তখনো বলা হতো এইসব কথা।
ধর্মমন্ত্রী
তাহলেই চিন্তা করে দেখো মা। শত বছর আগেও যে কথা শুনেছো, শত বছর পরেও সেই কথা শাশ্বত সত্য হয়ে এখনো সমাজদেহে বিরাজ করছে। এতেই কি প্রমাণিত হয় না, কতো সঠিক আমাদের চিন্তা ভাবনা?

তথ্যমন্ত্রী
মাঝখানের কিছু সময় বাদ দিয়ে আমরা সেই দিন এবং এই দিনকে একই সুতোয় গাঁথতে চাই। আর চাই বলেই আপনার সহযোগিতা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
রোকেয়া
কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি সেই দিন আর এই দিনকে এক সূত্রে আনা সম্ভব?
রাজা
অবশ্যই সম্ভব। আপনি খালি বিবৃতিটাতে সই করে দিন। তারপর বাদবাকি যা করার আমরা করবো।
রোকেয়া
পারবেন না। মাঝখানে নদীর জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। চার দেয়ালের অবরোধ ভাঙ্গার জন্য এদেশের নারী সমাজকে তো আমিই উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। তারাই আজকে রাজপথে এসে বাদবাকি অবরোধ ভাঙতে চায়।
রাজা
রাজপথ থেকে তাদের আবার ঘরে ফিরে যেতে হবে। সংসার আর সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।
রোকেয়া
তারা কি শুধু সংসার প্রতিপালন আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেকাংশে তাই।
রোকেয়া
মাফ করবেন। আপনাদের সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। এ যুগের মহিলারা বিমান চালায়। নভোযানে চড়ে মহাশূন্যে যায়। যুদ্ধের ময়দানে তারাও পুরুষের সমকক্ষ।
ধর্মমন্ত্রী
নিশ্চয়ই। ইতিপূর্বেও তারা ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তবে অবশ্যই তাজিমের সাথে, পর্দা পরিবেষ্টিত হয়ে।
রোকেয়া
বোরখা পরে যুদ্ধ মধ্যযুগেই সম্ভব ছিল। এই পারমাণবিক যুদ্ধের যুগে সেটা শুধু অসম্ভব নয়, হাস্যকরও বটে।
[এই দেশে এই বেশে ৪র্থ পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
রাজা
তার মানে আপনি নারী স্বাধীনতার পক্ষে?
রোকেয়া
নিঃসন্দেহে।
রাজা
দুর্ভাগ্য।
গান
যখন পড়বে দোররা বুঝবে তখন জেনানা
কোথায় রবে স্বাধীনতা, পালাবার পথ পাবে না
হে নানা।
পড়লে ফতোয়ার কবলে, পিঠের চামড়া নেবে খুলে
সময় থাকতে করো তওবা পরে সময় হবে না।
হে নানা, ভয়ে কাঁপে যত জেনানা হাজাম ছাড়া বিহা তারা করবে না।
হে নানা সামলে রেখো নানী হামার, ঘরের বাহির করো না।
হে নানা, ভেগে গেলে নানী পাবে না। হাজামের ইশকে নানী দিওয়ানা ।
রাজা
বেগম রোকেয়া । তর্ক বিতর্ক বাদ দিন। ও অন্য সময়ে করা যাবে। কিন্তু আপনি কি জানেন কেন আপনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে?

রোকেয়া
কি একটা উৎসব দেখার জন্য ।
রাজা
ঠিক ধরেছেন। বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব শুধু দেখা নয়। উৎসবটা উদ্বোধনও করবেন আপনি।
রোকেয়া
আমি?
রাজা
জি। আপনি।
রোকেয়া
কিন্তু কোন্ বাঙালির? তার সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান, তার বিশ্বাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়গুলো বাদ দিয়ে?
রাজা
আগে উদ্বোধনটা করে নিন। ওসব বিষয় পরে ঠিক করে নিলেও চলবে। (জহিরের উচ্চকণ্ঠে হাসি)
রোকেয়া
তোমার আবার হলোটা কি?
জহির
ব্যাপারটা অনেকটা বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদদের মতো হলো না? আগে সরকারের পতন এবং পরে নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা।
(নীরবতা)
রাজা
আপনি দেখছি অনেক বিষয় সম্পর্কেই খোঁজ খবর রাখেন।
জহির
ঔৎসুক্য আমার বরাবরই ছিল। অভ্যাসটা এখনো যায় নি।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
অভ্যাসটা আপাতত বাদ দিতে হবে বাচাল কোথাকার। মানুষ দেখলেই আমরা চিনি। উৎসবের উদ্বোধনটা হয়ে যাক। তারপর সেই হাইজ্যাকার বেটার খবর তোমার পেট কেটে বের করবো।
জহির
তাই নাকি? সাংঘাতিক ট্যালেন্ট তো আপনার।
রাজা
মহিয়সী বেগম রোকেয়া। আপনার কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ। উৎসবটা আপনি উদ্বোধন করুন। মাথার ঘোমটা টেনে দিন। এই বোরখাটা পরে নিন।
রোকেয়া
বোরখা। বোরখা কেন? উৎসবের সাথে বোরখার কি সম্পর্ক?
রাজা
আছে। আছে। ঝটপট পরে নিন তো।
রোকেয়া
মাফ করবেন। আমি পারবো না।
রাজা
আপনার সব কথা আমরা মানছি। আপনি কি আমাদের একটা কথাও মানবেন না?
রোকেয়া
না।
রাজা
অনর্থক জেদাজেদি করছেন আপনি। পরে ফেললেই হয়। কিছু সময়ের জন্য মাত্র।
রোকেয়া
না।
রাজা
কি সাংঘাতিক জেদি মহিলারে বাবা।
হুরমত
(ধর্মমন্ত্রীকে) হুজুর। কড়া কইরা একখানা ফতোয়া দ্যান তো।
রাজা
সময় একেবারই কম হুজুর। কিছু একটা করেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
না হয় জ্বিন সাহেবরে ভর করাইয়া দ্যান।
ধর্মমন্ত্রী
ইয়া আল্লাহ! ছি ছি ছি মা জননী। এটা উচিত নয়। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জেনানা তুমি পরো মা পরো। বোরখাটা পরে নাও। আমি তোমার সাথে দুএকটি কাজের কথা বলি
[এই দেশে এই বেশে ৪র্থ পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
রোকেয়া
আপনাদের প্রত্যেকটি কাজ সন্দেহজনক কথা বলতে চান বলুন। কিন্তু তার জন্য বোরখা পরতে হবে কেন?
ধর্মমন্ত্রী
আহ্ মা তুমি না হয় পর্দা মানো না। কিন্তু আমি তো মানি। দ্বীন ইসলামের একজন নগণ্য খাদেম হিসেবে আমি তো আর সরাসরি কোনো বেগানা জেনানার মুখের দিকে তাকাতে পারি না ।
রোকেয়া
ঠিক আছে। তাহলে বোরখাটা আপনিই পরে নিন। তাহলে তো আর কোনো বেগানা জেনানার দিকে আপনাকে তাকাতে হবে না। আপনাদের যা অভ্যাস। উকি ঝুঁকি দিয়ে দেখবেন নাতো?
ধর্মমন্ত্রী
আস্তাগফেরুল্লা।
জহির
বেগম রোকেয়া, ভুল বললেন। ইনাদের উকিঝুঁকির প্রয়োজন হয় না। ইনারা যা করেন, জেহাদি জোস নিয়ে সরাসরি প্রকাশ্য দিবালোকেই করেন। বরং আপনার নিরাপত্তার খাতিরেই উচিত, এদের সামনে বোরখা পরে থাকা। অবশ্য তাতেও যে আপনি কতটুকু নিরাপদ সেটা বলা মুশকিল। কারণ ১৯৭১ সালে এদেশের নির্যাতিতা দুই লক্ষ মহিলা পর্দা মেনে ঘরের অভ্যন্তরেই ছিলেন। রাজপথে ছিলেন না। এবং তাদের যে কি দশা হয়েছে সেতো একটু আগে নিজের কানেই শুনলেন।
হুরমত
এই ব্যাটা চোপ। ধইরা অক্ষনি হাত ঠেং-এর রগ কাইট্যা দিমু ।
রাজা
থামো তো হুরমত । পরে দেখা যাবে। বেগম রোকেয়া, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আপনি আমাদের একটি কথাও রাখছেন না। অন্যদিকে আমাদের শ্রদ্ধেয় হাজাম সাহেবকেও বলতে দিচ্ছেন না।
রোকেয়া
কথা বলতে না করছে কে। কথা উনাকে বলতে বলুন।
রাজা
কিন্তু শরীয়তের বিধান মতে উনি তো আর কোনো বেগানা জেনানার চেহারা দেখতে পারেন না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্যার। একটা কাজ করা যায়। হাজাম সাহেব উনার পবিত্র পশ্চাৎদিকটা এই দিকে দিয়ে ওদিকে মুখ বাড়িয়ে ফতোয়া জারি করতে পারেন।
রাজা
হুজুর। সময় একেবারেই নেই এবং সমাধানও একটাই। বোরখাটা আপনিই পরে নিন। এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও দেখছি না। বোরখাটা পরে ফতোয়াটা দিয়ে দিন এবং তার পরপরই আমরা উদ্বোধন পর্বে চলে যাবো। (ধর্মগুরু বোরখা পরছে)
গান
ছোঁড়া পরে ছুঁড়ির বোরখা ছুঁড়ি হেসে আটখানা
ছোঁড়া কহে কেঁদে কেঁদে আখেরি এ জমানা
হে নানা।
বোরখা পরে চলে ছোঁড়া, শিষ মারে দেখ ওরা কারা
কহে ছোঁড়া ছুঁড়ির জ্বালায় ইজ্জত রাখা যাবে না।
হে নানা, কেঁদে কেঁদে ছোঁড়া দিওয়ানা
মরদ নির্যাতনের একি বাহানা।
ধর্ম
(ওয়াজের সুরে) মা জননী। এ দেশের অগণিত মা বোনেরা আমার। একটা বিষয় আমার কাছে এখনো যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। আপনারা এই বেদ্বীনের যুগে না শুনে না বুঝে পর্দার বরখেলাপ করে বেশরিয়তি পথে বিচরণ করছেন। আপনারা স্বাধীনতা চাচ্ছেন। দরজার বাইরে পা বাড়াতে চাইছেন।
এই ঢেং ঢেং করে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর যে কি নতিজ্জা সেটি যদি আপনারা বুঝতেন তবে এই অযৌক্তিক আবদার আপনারা করতে পারতেন না। আমার দুই পিয়ারের মুরিদ যারা আবার মোমেনদার স্বামীস্ত্রী, আরিচার ফেরিঘাটে কলা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। একদিন তারা ভেবে চিন্তে দেখলেন, যেই কলা তারা বিক্রি করেন, সেই কলা মোমেনদার মুসলমানকে কষ্ট করে চুলে খেতে হয়।
পরের দিন স্বামী-স্ত্রী সব কলা ছুলে এনে বিক্রি করতে বসলেন আরিচার ঘাটে। কিন্তু ভাগ্যের এমনি লিখন সেদিন একটি কলাও বিক্রি হলো না। কেউ ফিরেও দেখলেন না। সেই ছুইল্যা কলার মধ্যে নানান রকম ধুলা-বালি পড়ছে বলে পাবলিক কিনে খায় নাই। কলা যতক্ষণ খোসার ভিতরে থাকে ততক্ষণ তার মূল্য। খোসার বাইরে তার কোনো মূল্য নাই । বলেন সবাই সোবহান আল্লাহ।
নাতি
সোবহান আল্লা, সোবহান আল্লা
নানা
তুই আবার প্যাট প্যাট করে কি কইছিস বে।
নাতি
হাজাম সাহেব তো দারুণ একটা কথা কহলো নানা ইনারা বহুত বুজুর্গ লোক। চেষ্টা করলে ইনারা কি না পারে।
নানা
কি কি পারে?
নাতি
পানি পড়া দিয়ে রোগ ভাল করবার পারে।
নাতি
মনের আশেক পুরা করতে পারে।
নানা
পারে।
নাতি
ভাঙা ঘর জোড়া লাগাতে পারে।
নানা
পারে।
নাতি
যাগো ছেলেপেলে হয় না তাদের ছেলেপেলে দিতে পারে।
নানা
পারে? তুই নিজের চোখে দেখিছিস?

নাতি
দেখেছি মানে? আমার নিজের ভাইয়ের বেটা। ভাবিজানকে সবাই কহলো বন্ধ্যা। দশ বছর পার হয়ে গাল, ছেলে পেলে হয় না। কতো ডাক্তার কবিরাজ। কেউই করবার পারলো না। পরে ভাবী সাহেবান ধরলো এক পীর সাহেবকে। আশ্চর্য। নানা। মাত্র এক বছরের মাথায় ভাবিজানের কোল জুড়ে ভাইয়ের বেটা আলো। হ্যাঁ। আমার নিজের চোখে দেখা।
[এই দেশে এই বেশে ৪র্থ পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
নানা
নিজের চোখে দেখা?
নাতি
হ।
নানা
তা ভাইয়ের বেটার চেহারাখান ঠিকা ঠাক দেখেছিলি তো? কার মতো হয়েছিল। ভাইয়ের মতো? নাকি পীর সাহেবের মতো?
ধর্ম
আসেন মা জননী । তওবা করেন।
(ধর্মগুরু হাত ধরে। হাতে চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়াতে থাকে।)
রোকেয়া
তওবা কেন?
ধর্মমন্ত্রী
নিয়ম, উদ্বোধনের আগে উদ্বোধককে তওবা করিয়ে নিতে হয়। বলুন।
রোকেয়া
কি বলবো?
ধর্মমন্ত্রী
বলেন, তওবা, তওবা।
রোকেয়া
কিন্তু আপনি আমার হাত ধরছেন কেন?
ধর্মমন্ত্রী
নিয়ম মা জননী । ধরতে হয়। তওবা করেন। শয়তান দূর হয়ে যাবে। বলেন, তওবা, তওবা, আস্তাগফেরুল্লা।
রোকেয়া
শুনুন। আমার হাতের ওপর আপনার হাতের চাপটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। হাতটা ছাড়ুন।
ধর্মমন্ত্রী
না না, এখন হাত ছাড়া যাবে না। শয়তান দূর করতে হবে তো। বলুন তওবা,তওবা, আস্তাগফেরুল্লা।
রোকেয়া
পড়লাম তো। শয়তানটা তো যায় না। হাত ধরে বসে আছে।
ধর্মমন্ত্রী
যাবে, যাবে, বলতে থাকুন। তওবা, তওবা।
(রোকেয়া জোর করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। ধর্মগুরুর গালে চড় মারে।)
রোকেয়া
হয়েছে? খুব মজা লেগেছে?
(ধর্মগুরু নেকাব দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।)
রোকেয়া
(দর্শকদের) অনাবৃত কলার কোনো মূল্য নেই। কিন্তু আবৃত মোল্লার কাছে অনাবৃত মহিলার নিরাপত্তা কতটুকু? ব্যক্তিগত চরিত্রের কথা বলবেন? দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর গম আত্মসাতের মতো মারাত্মক অপরাধে জড়িত থেকেও এরা হতে চায় খালেদ বিন ওয়ালিদ। আর মাত্র কিছুদিন আগে একজন ফতোয়াধারী কর্তৃক দশ বছরের নাবালিকা ধর্ষণের কথা না হয় বাদই দিলাম। আপনাদের মুক্তিযুদ্ধে দুই লক্ষ ধর্ষিতা মা বোনের কথা যদি ভোলা যায়, তবে এইটুকু ভুলে যাওয়া এমন বেশি কি? কি বলেন? চলি। (প্রস্থান)
গান
হাজাম সাবের ছিইল্যা কলা
খেয়ে নানা ধরছে গলা
আইট্যা কলার এতো জ্বালা আগে নানা বুঝি নি ।
হে নানা, দুষ্ট লোকে করে রটনা এও নাকি একাত্তরের ঘটনা।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
সব কিছুর মূলে এই ব্যাটা বেল্লিক নাফরমান (জহিরকে উদ্দেশ্য করে)
তথ্যমন্ত্রী
কি চমৎকারভাবে মহিলাকে ম্যানেজ করে এনেছিলাম। মাঝখান থেকে ব্যাটা বাম হাত দিয়ে সব নষ্ট করে দিলো।
রাজা
শুনুন। যা বলার ঝটপট বলে ফেলুন। ওই ছেলেটি এখন কোথায়?
জহির
মাঠে। মিছিলে।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
মিছিলে আছে স্যার। অর্ডার দিন। গুলি করে দেই।
জহির
গুলি করে একটা দেহকে ঝাঁঝরা করে দেয়া যায়। কিন্তু তার চেতনাকে কখনোবিনাশ করা যায় না।
রাজা
তার মানে?
জহির
তার মানে সেই ছেলেটি এখন আর একা নয়। সহস্র হাজার লক্ষ। তাকে ধরা কিংবা মারা আপনাদের আয়ত্তের বাইরে।
রাজা
কখন থেকে আপনি ওকে চেনেন?
জহির
অল্প কয়েক দিন।
রাজা
কবে মারা গেছে সে?
জহির
বছর খানেক।
রাজা
সে কি এখানে কোনো গোলমাল পাকাবার তালে আছে?
জহির
গোলমাল পাকানোর কি দরকার? গোলমাল তো লেগেই আছে।
রাজা
কি করে বুঝলেন?
জহির
আপনাদের অস্থিরতা দেখে।
রাজা
স্বীকার করছি। আপনি বুদ্ধিমান। তাড়াতাড়ি বলুন। বিখ্যাত প্রখ্যাত কুখ্যাত কোনটি আপনি ।
জহির
কোনটিই নই । তবে কিছু লোক বোধহয় আমাকে চেনে।
রাজা
আপনার পুরো না
জহির
জহির রায়হান।
রাজা
জহির রায়হান। কোন জহির রায়হান? স্টপ জেনোসাইড? যুদ্ধের পরে নিখোঁজ? ছি ছি আগে বলবেন তো। আপনিই সেই জহির রায়হান, বাঁচালেন ভাই আপনি। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ।
হুরমত
স্যার, ইনি কিডা?
রাজা
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান (হুরমত বাঁশীতে ফুঁ দেয়) এ্যাই,এসব কি হচ্ছে, হুরমত।
[এই দেশে এই বেশে ৪র্থ পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
হুরমত
ছাইড়া দ্যান স্যার। হালারে কাইট্যা টুকরা টুকরা কইরা ফালাই। নয়টা মাস এই হালারে বাত্তি দিয়া খুঁজছি। পাই নাই। আইজকা পাইছি। দ্যাহেন স্যার। দ্যাহেন। মাথায় রগড়া ক্যামুন দপ দপ কইরা লাফাইতাছে। জোস আইয়া গ্যাছে স্যার। জোস। জেহাদি জোস। স্যার অন্তত এই শেষ মালটা আমার হাতে ছাইড়া দ্যান। আমি আপনের জন্য মন খুইল্যা দোয়া করুম।
রাজা
হুরমত। ওর সাথে আমাদের কথা বলতে হবে।
হুরমত
কথা কইবেন স্যার? তা কন। আগে হের হাত আর ঠেং এর রগটা কাইট্যা দিই? রগ কাটনের পরে রক্তডা যহন ফিসিত কইরা বাইর অইবো না, দ্যাখবেন, কথা কইতে কইতে আপনেরও জোস আইয়া গ্যাছে।
রাজা
(হরমতকে) হুরমত। (জহিরকে আমরা দুঃখিত শ্রদ্ধেয় জহির রায়হান। আপনার পরিচয়টা আমরা বিলম্বে জানতে পেরেছি। কেউ যদি আপনার সাথে কোনো কিংবা অনুতপ্ত বলে কোনো শব্দ দুর্ব্যবহার করে থাকে তবে তার জন্য সত্যিই আমরা অনুতপ্ত।
জহির
অনুতপ্ত! আপনারা? আমার ধারণা ছিল, দুঃখিত আপনাদের অভিধানে নেই। যা হোক ধন্যবাদ ।
তথ্যমন্ত্রী
বলুন তো, কেমন লাগছে আমাদের দেশে এসে?
জহির
আপনাদের দেশ। হ্যাঁ। এই ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমি আপনাদের দেশেই আছি। আপনাদের দেশে দাঁড়িয়ে প্রিয় স্বদেশকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
রাজা
শ্রদ্ধেয় জহির রায়হান। আমাদের হাতে সময় কিন্তু একেবারেই নেই। বুঝতেই পারছেন। নিরুপায় আমরা। উৎসবটা আপনাকেই উদ্বোধন করতে হবে।
জহির
উদ্বোধকের যখন এতোই অভাব। না হয় করলাম।
তথ্যমন্ত্রী
মারহাবা মারহাবা।
জহির
কি হাবা?
তথ্যমন্ত্রী
হাবা না হাবা না। মারহাবা। আপনাকে মারহাবা।
রাজা
জহির ভাই । উদ্বোধনের আগে রাষ্ট্রের নতুন নিয়ম অনুসারে আপনাকে একটু তওবা করে নিতে হবে।
জহির
তওবা।
রাজা
প্লিজ। এটা তেমন কিছু না। নিয়ম মাত্র।
জহির
ঠিক আছে। তাও না হয় করলাম। কিন্তু তার আগে কি কয়েকটা বিষয় আমি একটু জেনে নিতে পারি?
রাজা
নিশ্চয়ই। নির্দ্বিধায়
জহির
আপনারা বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসবই তো করছেন।
রাজা
জি।
জহির
অনুষ্ঠানটা আমাকে উদ্বোধন করতে হচ্ছে কেন?
রাজা
আর কোনো উদ্বোধক নেই বলে।
জহির
ভালো কথা। বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব করছেন। একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই এই জাতির স্বাধীন বিকাশ। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি শেখ মুজিব এখানে অনুপস্থিত কেন?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
কোনো বিতর্কিত প্রশ্ন এখানে করবেন না।
জহির
রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
করি ।
জহির
তাহলে রাষ্ট্রের স্থপতিকে অস্বীকার করবেন কোন যুক্তিতে?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
এই যুক্তিতে যে উনার শাসনামলে দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে যায়। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, বিশেষ ক্ষমতা আইন আর একদলীয় শাসনে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
জহির
কোন সালে?
রাষ্ট্রমন্ত্রী
৭২ থেকে ৭৫।
জহির
যদি মেনেই নিই আপনাদের কথা, তাহলে ৭১-এর শেখ মুজিবের কি মূল্যায়ন হবে? ৭২ থেকে ৭৫-এর কথাই যদি বলবেন, তাহলে ৭১-এর কথা বলবেন না কেন?
হুরমত
অহনো সময় আছে, কন স্যার। হাত আর ঠেং-এর রগটা কাইট্যা দিই। তাইলেই ভালো ভালো ডাইলগ বাইর অইবো।
জহির
দুর্নীতি আর বিশেষ ক্ষমতা আইনের জন্যই যদি তার পতন হবে, তাহলে বলবেন কি কোন যুক্তিতে সেই বিশেষ ক্ষমতা আইন এখনো বলবৎ রয়েছে?
রাজা
প্লিজ, জহির সাহেব। এইসব ব্যাপার নিয়ে আমরা না হয় পরেই কথা বলি।
উদ্বোধন পর্বটা শেষ হয়ে যাক। তথ্যমন্ত্রী তুমি দ্রুত একটা ঘোষণা দাও। এক্ষণই উৎসবের উদ্বোধন হবে এবং উদ্বোধন করবেন মরহুম জহির রায়হান।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
স্যার। একটু আইনগত ঝামেলা রয়ে গ্যাছে।
রাজা
ওহহো ঝামেলা আর ঝামেলা। কি ঝামেলা।
রাষ্ট্রমন্ত্রী
রাষ্ট্রীয় নথিপত্রে যে তথ্য আমরা পাচ্ছি, তাতে তিনি এখনো নিখোঁজ রয়ে গেছেন। মারা যান নি। যদিও সবার অনুমান তিনি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মারা পড়েছেন। কিন্তু যতক্ষণ লাশ না পাওয়া যাচ্ছে, ততোক্ষণ তাকে মরহুম বলা যায় না।
তথ্যমন্ত্রী
অসুবিধা কি তাতে। আমরা মরহুম কেটে নিখোজ লাগিয়ে দেবো।
রাজা
নিখোজ। ধুর। এটা হয় নাকি। শহীদ না মরহুম না, নিখোঁজ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
বিশেষণটা কিন্তু চমৎকার স্যার। নিখোজ। উত্তাল সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে যে সমস্ত জেলেরা প্রায়ই হারিয়ে যায়। কিংবা প্রবল জলোচ্ছ্বাসে চরাঞ্চলের যে মানুষগুলো প্রায় প্রতি বছরই বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হয় তাদেরকে তো আমরা নিখোঁজ বলি। মরহুম বলি না। কাজেই এক্ষেত্রেও নিখোজ সম্বোধনটাই যথার্থ। আপনি কি বলেন?
জহির
ভালোই বলেছেন। তবে এর সাথে আমি একটি সংশোধনী আনতে চাই।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী
নিশ্চয়ই, বলুন।
জহির
নিখোঁজ জহির রায়হান উদ্বোধন করবেন, নিখোঁজ চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব। আপনি আবার শুরু করলেন?
তথ্যমন্ত্রী
ব্যক্তিগত ঔৎসুক্য থেকে একটা প্রশ্ন করবো? আপনার নিখোঁজ হওয়ার রহস্যটা একটু বলবেন?
রাজা
জহির
(নীরবতা) সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে আমি একটি কথাই বলবো। কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা হত্যাকাণ্ড কখনো কোনো জাতির জন্য মঙ্গল ডেকে আনে না। এক ষড়যন্ত্র আর একটি ষড়যন্ত্রের জন্ম দেয়। একটি হত্যাকাণ্ড আর একটি হত্যাকাণ্ডকেই উৎসাহিত করে।
স্বাধীনতার ঊষালগ্নে জহির রায়হানের নিখোজ হওয়া, ৭৪-এ সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ড, ৭৫-এ সপরিবারে স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিব-এর হত্যাকাণ্ড, ৭৬ সালে কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ড, ৮০ সালে জিয়া হত্যাকাণ্ড কোনটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত গতিতে চলছে।
নেতৃত্বের নাড়ির টান এখন জনতার সাথে নয়, বিদেশের মাটিতে। দেশের মাটিতে জনতার রক্ত যখন চিৎকার করে গণতন্ত্রের জন্য, নেতৃত্ব তখন ব্যস্ত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে। গণতন্ত্রই যদি চাইবেন, বিশ্বাসটা স্বদেশের মাটিতে রাখুন। মানুষের ওপর রাখুন।
ষড়যন্ত্রের বাঁধটা ভেঙে দিয়ে নিজেদের মুখোশটা একবার খুলুন। জনগণ যদি নির্দ্বিধায় রক্ত দিতে পারে, বিনিময়ে সেই জনগণের সাথে অন্তত চোর-পুলিশ খেলাটা বন্ধ করুন ।
[এই দেশে এই বেশে ৪র্থ পর্ব [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
রাজা
যথেষ্ট হয়েছে। এবার আসুন। মূল কাজটা শুরু করে দিই।
জহির
কোন কাজ ?
রাজা
উদ্বোধন পর্ব। আসুন। হুজুরের হাত ধরে তওবা করে নিন।
জহির
আমার জানা মতে এমন কোনো অপরাধ আমি করি নি, যার জন্য আমকে তওবা করতে হবে।
রাজা
আগেই বলছি এটা একটা রাষ্ট্রীয় নিয়ম।
জহির
সেই নিয়মটা মেনে জনতার কাছে গিয়ে তওবাটা আপনারাই করুন। শুদ্ধ হোন।
রাজা
জনতার কথা বলে কি পক্ষান্তরে আপনি আমাদের ধর্মীয় গুরুকে অপমান করছেন না?
জহির
ভুল বললেন। অপমান নয়। অস্বীকার করছি। ধর্মগুরু নয়। ধর্ম ব্যবসায়ী।
রাজা
আমাদের ধৈর্য্যেরও একটা সীমারেখা আছে।
জহির
আমার ঘেন্নার কোনো সীমারেখা নেই ।
রাজা
তাহলে আপনি আমাদের কথা শুনবেন না? উৎসব উদ্বোধন করতে আপনি রাজি নন।
জহির
উৎসব উদ্বোধন করতে আমি রাজি। তবে সেটা বাঙালি চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব নয়। নিখোজ চেতনার শতবর্ষ পূর্তি উৎসব ।
রাজা
ওহ্। অসহ্য। আপনি বুঝতে পারছেন না। আমাদের কথা না মানলে কত বড় বিপদ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
জহির
আমিও আপনাদের বোঝাতে পারছি না, আপনাদের এই স্বেচ্ছাচারিতা সমগ্র জাতিকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
রাজা
জহির রায়হান, আপনার এই ঔদ্ধত্যের জন্য যথেষ্ট মূল্য আপনাকে দিতে হবে।
জহির
আমাদের সবার প্রতিবাদহীন নির্জিবতার মাশুল জাতিকেই বহন করতে হবে।
রাজা
উৎসব তাহলে হচ্ছে না। উদ্বোধন আপনি করছেন না।
জহির
না।
রাজা
হুরমত আলী খান।
হুরমত
বান্দা হাজির।
(রাজাসহ বাদবাকী মন্ত্রীরা মঞ্চ ছেড়ে যায়)
জহির
তোমাকে চিনি। আমি বেঁচে থাকলে তোমাকে নিয়ে একটি ছবি করতাম।
হুরমত
তাই নিহি? জব্বর কইছেন তো? তা আমার হাতের এই মালখান চিনেন?
জহির
খুব বেশী দিন তো নয়। ৭১ সাল। সেই মানুষ আর তার খড়গ। কিন্তু তোমার তো বাঁচার কথা ছিল না। কিভাবে বাঁচলে?
হুরমত
আপনারও তো মরণের কথা আছিল না। আপনি যেইভাবে মরলেন, আমি হেইভাবে বাঁচলাম। অইছে। অহন প্যাচাল ছাইড়া কন, উৎসব উদ্বোধন করবেন, না হাত ঠ্যাং-এর রগ কাটনের কাম শুরু করুম?
জহির
একবারই তো বলেছি। না।
তথ্যমন্ত্রী
তয় মরেন। ইয়াহু।
(হুইসেল বাজায়, ঘাতক দল আসে। হাত পায়ের রগ কাটছে। জহিরের আর্ত চিৎকার।)
জহির
রক্ত। আহ্ রক্ত। ফিসিত কইরা রক্তডা বাইর অইয়া আমার চোখ মুখ ভিজাইয়া দিছে গো। মুক্তিযোদ্ধা গরিলা যোদ্ধা, থুঃ।
জহির
স্টপ, স্টপ জেনোসাইড।
(স্লাইড-এ ৭১-এর গণহত্যার দৃশ্য। রক্তাক্ত মৃত জহির মঞ্চে। কোরাসের হামিং-এ স্বজন হারানো বিলাপ। ধীর লয়ে শুরু হয় কোরাসের গান। কোরাসের গান ওভারলেপ করে নানা নাতির সংলাপ। আবার নানা নাতির সংলাপ ওভারলেপ করে বৃদ্ধার সংলাপ। বৃদ্ধার সংলাপ শেষে দ্রুত লয়ে কোরাসের গান)
গান
ঐ মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে ছড়িয়ে গ্রাম
জ্বালাতে জ্বালাতে মাটি, হিংস্র সাপের সারি তুলেছে ফণা
সাথীদের খুনে রাঙা পথে দেখ, হায়েনার আনাগোনা।
নাতি
নানা হে নানা –
নানা
কহ।
নাতি
গান গাবি না নানা-
নানা
ঐ তো গায়।
নাতি
গম্ভিরা গাবি না – –
নানা
সবার সাথে মিলে এটেই গাব
গান
তাই আহ্বান, ও সাথী, কৃষাণ, মজদুর ভাইসব আহ্বান।
বৃদ্ধা
৭১-এর পরাজিত ঘাতকের হাতে মরবার জন্য আমার সন্তানের জন্ম হয়নি। শত বিদ্রোহের ঊর্বর জননী স্বদেশ। এই তো আমার অমৃত সন্তানেরা। নিঃশঙ্ক চিত্তে জীবনদানের অতীত গৌরব, বীরদর্পে হেঁটে আয় শত অস্ত্র হাতে।
গান
আহ্বান আহ্বান দিকে দিকে আহ্বান
সময় তো নেই আর ভাই রে
জোটটাকে আমাদের বজ্র কঠিন করো।
হাতিয়ার তুলে নাও তাইরে
আজ কালজয়ী সংগ্রাম শুরু করো
হেঁকে বলো সইবো না সইবো না সইবো না
সাথীদের খুনে রাঙা পথে পথে আর
হায়েনার আনাগোনা সইবো না।
আরও দেখুন: