খানদানি কিসসা নাটকটি এস এম সোলায়মান এর একটি বিখ্যাত নাটাক। এই নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯০ তারিখে। শেখ মোহাম্মদ সোলায়মান বা এস এম সোলায়মান একজন বাংলাদেশী অভিনেতা। তিনি ১৯৫৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মঞ্চ নাটক পরিচালনা করতেন এবং তাতে সঙ্গীত পরিচালনাও করতেন। তাকে বাংলাদেশের থিয়েটারের জগতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি।
খানদানি কিসসা নাটক : ১ম অঙ্ক
প্রথম প্রযোজক দল : সুবচন নাট্য সংসদ
প্রথম প্রদর্শনীর স্থান : গাইড হাউস মিলনায়তন, ঢাকা
কুশীলব
সূত্রধর : বনলতা সাহা
এজিদ : মিঠু
নুসরাত : বাণী
হায়াত : বিপুল
জহির : সজিব
কাইয়ুম : স্বপন
সাববির : কাদের
হাবিল : নান্টু
দাখিল : আসলাম
কাবিল : কবির
সখিনা : সেতু
খালেদ : শাহজাহান (১)
পুষ্প : আরজু
সৌরভ : গিয়াস
কাজী : রফিক
প্রতিহারী : রফিক
কবি সৈয়দ : তৌফিক
সোনা মিঞা : শাহজাহান (২)
কোৱাস : বাবলু, গিয়াস, শ্যামল, তুহিন, তপু, বাসির, সাউদ, শোভন ও লিটু
গায়েন : বনলতা সাহা।
কলাকুশলী
নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান
মঞ্চ ব্যবস্থাপনা : মোঃ শাহজাহান (২)
আলোক পরিকল্পনা : ঠাণ্ডু রায়হান
মঞ্চ পরিকল্পনা : আবু দাউদ আশরাফী
পোষাক পরিকল্পনা : ওয়াহিদ মুরাদ
সঙ্গীত : জাহিদ, তন্ময়, রুমা, পাভেল, বাবুল
প্রচ্ছদ : উত্তম সেন
প্রযোজনা অধিকর্তা : ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীর প্রতীক)

(মঞ্চে পাশাপাশি দুটি বাড়ি, কৃত্রিম আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে ঐ বাড়িতে কোরাস ঢুকে প্রথমে খানদানি কিসসার সূত্রপাত করে। কোরাসের অবয়বে জোকারের প্রতিচ্ছবি, কোরাসের গানের পরে সুত্রধরের প্রবেশ।)
[খানদানি কিসসা ১ম অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
কোরাসের গান
সূত্রধর
এই যে, জনাবেরা সবাই দেখি এইসে পড়েছেন। দুঃখিত, আমার একটু দেরি হয়ে গ্যালো। অবশ্য ঠিক দেরি বলা যায় না, ঠিক সময়েই এইসেছিলাম, ইস্টিজে উঠতেই দেখি ছাওয়াল-পাওয়ালরা কি সব জোকার মার্কা কাপড়-চোপড় পরে মুখে মেকাপ- ফেকাপ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতি লেগেছে।
আর আজকালকার ছাওয়াল পাওয়ালরা গুরুভক্তির আগে গুরুমারা বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত। যাক গে ঐ সব কথা হচ্ছে আপনারা অত দূর-দূরান্ত থেইকে আমার কিস্সা শুনতে এসেছেন, এ বড় সৌভাগ্যের কথা। কিন্তু এত কিস্সা থাকতে হঠাৎ খানদানি কিসসায় সবাই মেতে উঠলেন কেন বুঝতি পারলাম না।
এই যেমন ধরেন ব্যাঙমা ব্যাঙমীর কিস্সা, দেওয়ান ভাবনার কিসসা, বেহুলা লক্ষিণদরের কিসসা। আসলে কথা হচ্ছে আমরা সবাই বর্ণচোরা। এই যে লেবাস পরে আছেন আপনি আমি, এর ভিতরে কিন্তু আর একখান মানুষ লুকায়ে আছে; যাকে বলে একেবারে ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ড। আজকে সেই মানুষটারে একটু দেখতে চাই চুপে চুপে। দেখব, মজা পাব, হাসব, তারপরে চলে যাব। ব্যাস, এর বেশি না।
খানদানি কিস্সা বলে কথা। এক এক খান্দানের এক এক ধাপ। ফরাসি বান্দানের জাতই আলাদা। ইংরেজরা তো কাউকে গোনাতেই আনতে চায় না। ইংরেজেদের নাক তো আবার ইয়া উঁচু। জার্মানের কথা তো সবার জানা। দুইন্যার শ্রেষ্ঠ জাতির দাবিদার তারা। আর আমরা যারা বাংলাদেশে আছি, ছোট হলে কি হবে, দাবির বেলায় সবার চাইতে অগ্রগণ্য। শেখ, সৈয়দ, ব্রাহ্মণ, ডোম, নমশূদ্র বাহান্ন গেরো-তেপ্পান্ন ঝামেলা।
ধনী দরিদ্র শিক্ষিত অশিক্ষিতের কথা না হয় বাদই দিলাম। হায়রে খানদান। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান। কিসব নামের বাহার, খালেক বিন সাজ্জাদ সোবহান চৌধুরী কামাল ইবনে রায়হান আনসারী। দিদার আলীর বাপের নাম গোলাম আলী। আবার গোলাম আলীর নাতির নাম আ. খ. ম. শান্তনু সৌরভ পুষ্প রহমান। সে যাই হোক। আমার পিছনেও আছে দুইখান খানদানি বাড়ি। যাকে বলে একেবারে জাত খানদান।
দুইভাই, বড় ভাই খালেদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান। ছোট ভাই আ. খ. ম পুষ্প সোবহান। পিতা জনাব সে যে কি খানদানি চমক। জায়নামাজ থেকে শুরু করে সেতার, সরোদ, রবীন্দ্র, নজরুল, মার্কস, এঙ্গেলসের নই আর সাথে পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান।
যাকগে, সবই ভালো যাচ্ছিল। কিন্তু দুই ভাইয়ের মধ্যে খানদানি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত রূপ পায় বিশ একরের বিশাল গজারি বনের দখল স্বত্ব নিয়ে। সাথে আবার দুই তরুণ-তরুণীর ভাব তার উদাসীনতা। বড় ভাই খালেদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান, তার বড় ছেলে এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান। এই সময়ের একজন মহান তাত্ত্বিক, বিপ্লবী কাম প্রেমিক। ছোট ভাই আ. খ. ম. পুষ্প সোবহান, তার কন্যা সুপ্রিয়া নুসরাত জাহান
এজিদ
আমি তাত্ত্বিক
নুসরাত
আমি সরলা
এজিদ
আমি বিদ্রোহী
নুসরাত
আমি অবলা
নুসরাত তুমি আগুন
নুসরাত
না-না, আমি ফাগুন
এজিদ
আমি ঘূর্ণি
নুসরাত
আমি গিন্নি
(এজিদ এবং নুসরাতের গান)
নুসরাত
এজিদ। আমার এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান।
এজিদ
মিলন হবে কবে সুপ্রিয়া নুসরাত জাহান?
নুসরাত
খানদান
এজিদ
ভিন্ন ঘরানার খানদান।
নুসরাত
দুই খানদানকে এক করা যায় না?
এজিদ
তোমার আমার তো অসুবিধা নাই। কিন্তু বাপ চাচা যে নিরুপায়।
নুসরাত
তবে কি হবে?
এজিদ
ধৈর্য্য ধরতে হবে।
নুসরাত
কবে?
এজিদ
যেদিন আমার লড়াই শাস্ত্রের অধ্যয়ন শেষ হবে।
নুসরাত
সেটা কবে?
এজিদ
একদিন তো হবে।
নুসরাত
ততোদিন কি আমার বাপি বসে থাকবে? দেখবে একদিন টুকুস করে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
[খানদানি কিসসা ১ম অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
এজিদ
অসম্ভব।
নুসরাত
কি?
এজিদ
এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান তা হতে দেবে না।
নুসরাত
কি করবে তুমি?
এজিদ
চে গুয়েভারার রণ-কৌশল আমার মুখস্ত। আমি গেরিলা যুদ্ধ করে তোমাকে ঐ বিবাহ বাসর থেকে উঠিয়ে আনবো।
নুসরাত
তুমি কি তা পারবে?
এজিদ
পারবো। আমাকে পারতেই হবে।
নুসরাত
এই, ঠিক তো?
এজিদ
হু (ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজে)
নুসরাত
কোথায় যাচ্ছো এজিদ সোবহান।
এজিদ
ওরে বাপরে। আমাদের গৃহশিক্ষক কাম কেয়ার টেকার হায়াত দরাজ খান (এজিদ পালিয়ে যায়। শিক্ষক ঢোকে)
হায়াত
টাং টাং টাং টাং টাং ঢাং। প্রিয় ছাত্রগণ শুরু করো অধ্যয়ন। একি, কেউ নেই, শূন্যে সম্ভাষণ? হুঁ। এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান।

এজিদ
উপস্থিত গুরু হায়াত দরাজ খান।
হায়াত
জাহির, কাইয়ুম, সাববির।
তিনজন
এই তো হুজুর হাজির।
হায়াত
হাবিল, কাবিল, দাখিল
তিনজন
উপস্থিত শুরু ফাজিল ।
হায়াত
কি?
হাবিলা
জি।
হায়াত
বিবি সখিনা ।
সখিনা
উপস্থিত অবলা কামিনা।
হায়াত
এক, দুই, তিন, চার-পাঁচ, ছয়, সাত, আর?
এজিদ
আর তো হয় নাই।
সবার গান
মোরা এক বোন সাতখান ভাই
আরো এক ডজন ভাইবোনের লোভে
বাপজানরে তেলাই।
হায়াত
চোপরাও বেত্তমিজ। নালায়েক, নাফরমান। বাপজান নয় আব্বা হুজুর: আউর আব্বাজান। লজ্জা নাই। বেশরম । খান্দানের জাত মারতে চাও?
জহির
মাফ চাই শুরু, মাফ চাই।
হায়াত
প্রিয় ছাত্রগণ তোমাদের পিতা, খানকায়ে আরাবিয়া নকশে ওয়াকস্তোয়া জনাব খালেদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহানের প্রারম্ভিক সম্ভাষণ। প্রস্তুতি নাও। প্রথমে পরমান করো তোমাদের দূষিত মন।
(যুদ্ধের বাজনা বাজে। বাবা ঢোকে)
খালেদ
পুত্রগণ ও কন্যাগণ।
হায়াত
শ্রবণ করো শ্রবণ।
খালেদ
বিশেষ প্রয়োজনে আমি আজকের এই মোলাকাতের এন্তেজাম করেছি। আমি চাই তোমাদের সত্যিকারের খানদান ঐতিহ্যে সাচ্চা ইনসান রূপে গড়ে তুলতে। আমার পিতা অর্থাৎ তোমাদের দাদা জনাব মাজহার ইবনে ওয়াবাত সোবহান, আমাকে খানদান আর কওমের নিশান হরদম উদ্যত রাখার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। আমি সেই খান্দানের ওয়ারিশিন, যেই খানদান ঐতিহ্যের তাবেইন। ভুলে যেওনা পাশের বাড়িতে বসবাস করছে এক ইবলিস খারেজিন। যদিও সম্পর্কে সে আমার আপন ভ্রাতা এবং তোমাদের চাচা। তথাপি সেই কমবখত রক্ষা করছে না খান্দানের রেছালত। তাই ওদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন। শুধু আমি নই তোমাদেরও জন্য ।
[খানদানি কিসসা ১ম অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
হায়াত
কঠোর নিয়মানুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলা। এই হচ্ছে সত্যিকারের খানদানি ছোলা।
জহির
রেজালা?
হায়াত
চোপরাও। রেছালা। সাবধান ভুলেও কখনো বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকাবে না। বাইরের সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা করবে না। তাতে তোমার খানদানি রক্ত দূষিত হয়ে পড়বে।
খালেদ
ভি.সি.ডি.আর সিনেমা-
হায়াত
ভি.সি.ডি.আর সিনেমা, দেখা যাবে না।
খালেদ
একুশে ফেব্রুয়ারি?
হায়াত
একুশে ফেব্রুয়ারির নামে মূর্তিপূজা করা যাবে না।
খালেদ
বাঙালি ।
হায়াত
এখন থেকে বাঙালি নয়, নিজেকে খানদানি হিসেবে ভারতে হবে।
খালেদ
মুক্তিযুদ্ধ?
হায়াত
তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা যাবে না।
কাইয়ুম
কারণ?
হায়াত
কারণ একাত্তরের সেই ইসলামী জেহাদে তোমাদের পিতা ছিলেন একজন গৌরবান্বিত রাজাকার এবং তোমরা সেই মহান রাজাকার পিতার জেহাদী নওজোয়ান ।
খালেদ
সাবাস শুরু হায়াত দরাজ খান।
হায়াত
কওমী জেহাদে মুক্তিযোদ্ধা নিধন অভিযানে তিনি ছিলেন একজন সফল পুরুষ। তবে কাপুরুষের মতো কাউকে গুলি করে হত্যা করেন নি, বরং বেয়নেটের খোঁচায় ঘন্টার পর ঘন্টা ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাদের ইহলীলা সাঙ্গ করেছেন। কওমের স্বার্থে তিনি বহু বাড়ি ভিটায় আগুন দিয়েছেন ।
খালেদ
তবে,
হায়াত
তবে কোনো লুটপাটে তিনি অংশগ্রহণ করেন নি।
খালেদ
এছাড়াও…
হায়াত
এছাড়াও জেহাদের প্রয়োজনে সেই সময়ে প্রচুর রেপ কেস সংঘটিত হয়েছে।
খালেদ
তবে…
হায়াত
তবে সেই সমস্ত রেপ কেসে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন নি।
খালেদ
সাব্বাস শুরু হায়াত দরাজ খান। আমার তবে এবারের মতো প্রস্থান। (প্রস্থান)
হায়াত
প্রিয় ছাত্রগণ । এবারে অনুশীলন। টুকে নাও এবং মুখস্থ করে নাও। ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙ্গন। সাড়ে পাঁচটায় অর্থাৎ আধঘণ্টার মধ্যে প্রতিক্রিয়া সম্পাদন।
খালেদ
অসম্ভব।
হায়াত
অসম্ভব?
এজিদ
আধ ঘণ্টায় প্রাতক্রিয়া সম্পাদন? এদিকে ভাইবোন আটখান। ওকি সম্ভব শুরু হায়াত দরাজ খান?
হায়াত
সংযম। সংযম, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংযম। অনুশীলন মানে সংযমের অনুশীলন অতএব, আধঘণ্টার মধ্যেই হবে ও কর্ম সম্পাদন।
সখিনা
যথা আজ্ঞা গুরুজন।
হায়াত
ছয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত শরীর চর্চা, সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা ধর্মপাঠ। মাঝে আধ ঘণ্টার প্রাতরাশ।
দাখিল
কি দরকার ওটুকু বরং দিয়েই দিন বাদ ।

সাব্বির
সাব্বাস দাখিল, সাব্বাস।
হায়াত
চোপরাও বেদাত । আটটা থেকে সাড়ে নয়টা বিদ্যাপাঠ। আধ ঘণ্টার মধ্যে গোসল এবং টুক-টাক কর্ম সম্পাদন। দশটায় স্কুল কলেজে গমন। তিনটার সময় ফিরন । চারটা পর্যন্ত খেলাধুলা। চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত নেবে ক্রমাগত গোলাপ ফুলের গন্ধ। ঠিক পাঁচটায় হবে কলাপসিবল গেট বন্ধ। পাঁচটা থেকে ছয়টা বিশ্রাম। দশটা পর্যন্ত বিদ্যাপাঠ, আহার এবং অন্যান্য কর্ম সম্পাদন।
দাখিল
গোস্তাগি মাফ হয় গুরুজন, এরই মধ্যে যদি বাথরুমে যাওয়া হয় প্রয়োজন?
[খানদানি কিসসা ১ম অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
হায়াত
সংযম, আগেই বলেছি সংযম। রাত দশটায় হবে ও কর্ম শেষবারের মতো সম্পাদন। প্রিয় ছাত্রগণ, সত্যিকারের খানদানি রীতিনীতি ধাতস্থ এবং আত্মস্থ করার প্রয়োজনে এই দৈনিক সূচি আমি প্রণয়ন করলাম। বিশেষ প্রয়োজনে আমি একটু নির্গমন। (প্রস্থা
জহির
অপমান, এ এক ভয়ঙ্কর অপমান।
কাইয়ুম
এখন কি হবে?
সাব্বির
হবে আর কি, গোল্লায় যাবে।
সখিনা
অনাচার। এ এক সাংঘাতিক অনাচার। দশ বছর আগেও পিতাজি স্বীকার করতেন না যে, তিনি রাজাকার। আর এখন? এখন গৌরবদীপ্ত কণ্ঠে দাবি করেন তিনি ৭১-এর একজন গৌরবান্বিত রাজাকার।
কাবিল
আমার মনে হয় এটা একটা আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।
হাবিল
পিতাজি আমাদের মনে করেছেন কি?
দাখিল
শাখামৃগ ।
হাবিল
মানে?
দাখিল
মানে বান্দর।
এজিদ
এই বান্দরেরা এদিকে এসো। তোমাদের নিয়ে এই একটা সমস্যা। পাঠ্যসূচির বাইরে তোমরা কেউ পড়াশোনা করো না। ঘর ভর্তি বই। চিত্রকলা, শিল্পকলা, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন। প্রায় সব বিষয়ে আমি বিশেষভাবে করেছি অধ্যয়ন। এখন যেটা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে বাস্তব অবস্থায়, পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন ।
(চিন্তা করছে)
দাখিল
হলো কি তোমার, বিষণ্ণ বদন?
কাইয়ুম
হবে আর কি? ঢং।
এজিদ
পেয়েছি।
দাখিল
কি?
এজিদ
সঠিক উপমা পেয়েছি। দেখো, একটা দ্বান্দ্বিক সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদন কাঠামো এবং ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যায়, সমাজ মননের অনু-পরমাণুর সূত্রগুলোকে আপাত বিচ্ছিন্ন কার্যকারিতার মধ্য দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সত্যে আরোহন করতে গেলে যেসব অবরোহন প্রক্রিয়ায়—
হাবিল
ধুর। কি যে আবোল-তাবোল বল না বল ।
দাখিল
প্লিজ এজিদ, একটু বাংলায় বল।
এজিদ
বুঝেছি। একটু কঠিন হয়ে গেল। আচ্ছা ঐ যে চিড়িয়াখানার খাঁচাবন্দি বানরগুলোর কথা মনে পড়ে? খাঁচার অভ্যন্তরে সারাক্ষণ ছটফট করে, আর প্রচণ্ড আক্রোশে বাইরের মানুষের প্রতি ভেংচি ছুঁড়ে মারে। আমাদের অবস্থাও তাই। শুধু আমরা কেন, পাশের বাড়ির আপন চাচা, আপন চাচাতো বোন, তাদের মুখ দর্শনও সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমি তাত্ত্বিক আমি প্রেমিক। তোমরাই বলো, এটা কি উচিত? আমাকে না দেখলে যে নুসরাত জাহানের রাতের ঘুম হুস করে ফুস হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস আর এপাশ-ওপাশ করে কেটে যায় প্রহর। সেই মহামিলনের পথে বাঁধ সেধেছেন মহান রাজাকার পিতৃপ্রবর ।
সখিনা
কি আর করবে। সবর দাও সবর।
এজিদ
সমস্ত ষড়যন্ত্রের বাঁধ আমি ভেঙে দেবো। আমি তছনছ করে দেবো। আমি আলেকজান্ডার হবো। আমি কার্ল মার্কস হবো। আমি যিশুখৃষ্ট হবো। আমি মুক্তিযোদ্ধা হবো। আমি রাজাকার হবো। আমি তিতুমীর হয়ে একখান বাঁশের কেল্লা বানাবো। তারপর ঐ বাঁশের আগায় দড়ি ঝুলিয়ে, নুসরাত আমি একদিন একটুস করে মরে যাবো। (নুসরাতের প্রবেশ)
সবার গান
ফাঁসির দড়ি সহজে ছিঁড়ে না
যে প্রেম করতে গেলে পা পিছলে
এমন প্রেম আর করো না এজিদ সোনা।
যার বিরহে নেবে দড়ি
সে ভুলবে তোমায় যত্ন করি গো।
সেতো থাকবে মজে স্বামী সুখে
সঙ্গে নিয়ে কাচ্চা বাচ্ছা দশখানা।
জলের সাথে তেল মিশে না।
চাঁদ সুরুজে মিলন হয় না গো
তুমি রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার
দুই নৌকায় পা দিও না এজিদ সোনা।
ভাঙলে কোমর আস্ত থাকবে না ।
(সবার প্রস্থান। অন্য বাড়ি আলোকিত হয়। প্রবেশ করে নুসরাতের ছোট ভাই সৌরভ)
নুসরাত
সে মরবে সুইসাইড খেয়ে
প্রেমে বিবাগী হয়ে
আর কি হবে আমার বিয়ে।
সৌরভ
লজ্জার মাথা খেয়ে
থাকে সে পথ চেয়ে।
নুসরাত
নতুন কি কেউ আসবে এগিয়ে
আর কি হবে আমার বিয়ে
সৌরভ
কেঁদনা নুসরাত কেঁদনা। চোখের জলে তোমার মেকাপ ফেকাপ সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছি কাঁদে না।
নুসরাত
আমার যে কিছু ভালো লাগে না। দু’বছর আগের দিনগুলোই বরং ছিল ভালো। আহা, তখন কতোই-বা আমার বয়স। মিষ্টি বিকেলের রোদে, দুষ্ট হাওয়া মেখে চপলা হরিণীর মতো ঘুরে বেড়াতুম। স্নিগ্ধ গোলাপের গন্ধ মেখে ভাবতাম আমাকে। ভালোবাসার কি রং লাল, নীল, গোলাপি? কি আকার? সরল, বক্র কিংবা ত্রিভুজ কিছুই বুঝি নি। কারণ তখন তো আমি চির সবুজ। আর এখন? গোধূলী হলো ম্লান। সূর্যের উজ্জ্বল্যে আসে ফিক । ধিক শত ধিক। আমাকে অশান্ত করেছে প্রেমিক এজি
সৌরভ
এপারে মুখর হলো নুসরাত আপু।
ওপারে নীরব কেন এজিদ ভাই।

এজিদ
উপায় নাই, উপায় নাই, উপায় নাই।
শোনা গো চাচাত ভাই ।
সৌরভ
হয়েছে অধীর বনহরিণী
কবে পারে ভিড়িবে সে তরণী
ফৌস ফৌস নিশ্বাসে টেকা দায়
ওপারে নীরব কেন এজিদ ভাই।
(পুষ্প সোবহানের প্রবেশ)
এজিদ
পরানেতে পানি নাই পানি নাই
চাচাজান রে দেখা যায় এই ফাঁকে আড়ালেতে নিজেরে লুকাই।
পুষ্প
এত উচ্ছল আর ভাব-বিহ্বল। ব্যাপারটা কি পুত্র সৌরভ-সুপ্রিয়া নুসরাত জাহান?
সৌরভ
কিছু না, সকাল থেকেই পাকস্থলিটা কেমন যেন টানটান।
পুষ্প
প্রাতরাশ সেরেছো?
সৌরভ
হ্যাঁ। বাপী।
পুষ্প
তাহলে এবার দ্রুত গিয়ে করে নাও চান।
সৌরভ
যাচ্ছি বাপী।
পুষ্প
সুপ্রিয়া নুসরাত ।
নুসরাত
বলো বাপী।
পুষ্প
বসন্তের স্পর্শে শুধু বৃক্ষরাই উর্বরা হয় না। মানুষ, মানুষের হৃদয়ও সে স্পর্শকাতারতায় ভোগে। কি ভোগে না?
[খানদানি কিসসা ১ম অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
নুসরাত
সময় সময় তো বটেই।
পুষ্প
হ্যাঁ, সময়। সময় হচ্ছে মানব ঐতিহ্যে সংযোজিত নানান ঘটনাকাল। শুধু সময় নয়। দুঃসময়ও বটে। কাজেই এমন কিছু কখনোই করবে না যা তোমার জীবনে ডেকে আনবে দুঃসময়ের মহাকাল।
নুসরাত
তেমন কিছু তো আমি করি না বাপী।
পুষ্প
করো না। কিন্তু করবে না। ভুলে যেওনা তুমি একটি অভিজাত পরিবারের সন্তান। স্বকীয় সংস্কৃতির লালিত পরিচর্যায় আমি চাই তুমি বেড়ে উঠবে। নিজস্ব কৃষ্টির শোভিত সৌরভে তুমি হয়ে উঠবে একটি আদর্শ মানব বৃক্ষ । কাজেই দুঃসময়কে লালন করো না। শুদ্ধ করে তোলো নিজের অভ্যন্তরের আত্মাকে। বসন্তের ছোঁয়ায় উচ্ছল হবে কিন্তু বিলীন হবে না। বিশেষ করে তোমার জন্য নিষিদ্ধ – পাশের বাড়ির কোনো জাগতিক কিংবা আত্মিক বিষয় অবলোকন ।
নুসরাত
বাপী, ওরা না আমাদের পরম আত্মীয়-স্বজন?
পুষ্প
ছিল। এখন নেই। আমার কাছে সব সময় বড় হচ্ছে পারিবারিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য আজকের নয়। দীর্ঘ যুগের। আমার পিতা অসীম পবন ঘূর্ণি সোবহান-এর সত্যনিষ্ঠতা, তার সংস্কৃতি, তার চিন্তা, তার আদর্শ ঐ পারে পরিত্যক্ত। সেই কারণে তোমার দাদু, ওদের করেছে ত্যাজ্যপুত্র।
(কোকিলের ডাক আসে)
পুষ্প
অসময়ে কোকিলের ডাক?
নুসরাত
অসময় কোথায় বাপী। এখন তো বসন্তকাল। সকালের মিষ্টি রোদে গাছের পাতারা করছে চিক চিক। (চাপা স্বরে) একটু পরে এজিদ। (আবার কোকিলের ডাক)
পুষ্প
দিনকাল সব ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। নির্লজ্জ কোকিল। তাও ডাকে ওপার থেকে। যেখানে বাস করে এক দঙ্গল বেজাত পাপী।
নুসরাত
কোকিলের আবার জাত-পাত কি বাপী? (আবার কোকিল ডাকে)
পুষ্প
উহু। বড্ডো বেসুরো তাল, বেসুরো গীত।
নুসরাত
(চাপা স্বরে) আর একটু পরে এজিদ। আচ্ছা। সৌরভের কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? এতক্ষণ লাগে মানুষের চান করতে? লেখাপড়া ও করবে কবে?
সৌরভ
বধু বিরহের দেশে বসতি আমার অনলে বাঁধি ঘর। সেথা পোড়া দেহ শুধু পোড়ে না অনলে—ছাই করে অন্তর।
পুষ্প
কি? এই তোমার পাঠ্যসূচি? অসভ্য ইতর। জঘন্য।
সৌরভ
বাপী আমি নাতো, রাধাকৃষ্ণ।
পুষ্প
এই বয়সেই রাধাকৃষ্ণ । পরে তো সহস্র গোপীর ক্রস কানেকশানে আমাকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে।
নুসরাত
বাপী ঐ অশুভ পাখিটি তাড়াই?
পুষ্প
ঝাডুপেটা করে করো বিদায় ।
নুসরাত
ঐ কোকিল এখন না। যা-যা (আবার ডাক)
পুষ্প
বড্ডো নির্লজ্জ কোকিল তো?সৌরভ। আমার বন্দুক।
নুসরাত
তুমি শুধু শুধু রাগ করছো বাপী। তুমি সৌরভের পড়াটা দেখো। ঐদিকটা আমিই দেখছি।
এজিদ
কতোকাল নুসরাত আর কতোকাল ।
নুসরাত
বাপী তোমার ফাটাবে কপাল, কেটে পড়ো কেটে পড়ো
(এজিদ পালিয়ে গিয়ে আবার ডাকে)
নুসরাত
সাবধান কোকিল সাবধান। আজকে টান দিয়ে ছিঁড়বো তোমার দু’কান
এজিদ
কু-উ
নুসরাত
উহুহু বলি ও কোকিলা। যা যা যা
তুমি নিশীথে যাইও কচু বনে,
তুমি নিশীথে যাইও কচু বনেরে কোকিলা,
নিশিথে যাইও কচু বনে ।
এজিদ
জ্বালায়ে চান্দের বাতি
জেগে রবো সারা রাতি গো
দুঃখে কাটিবে রাত আসমানেরও তারা গুনে গুনে ।
নুসরাত
আমি আসিবই আসিব কচুবনে
এজিদ
তবে আসিও অতি সংগোপনে। (প্রস্থান)
নুসরাত
বাপী তাড়িয়েছি। কোকিলাটা পালালো,
পুষ্প
বেশ করেছো কনো চলো। এবার চলো। (প্রস্থান)
সবাই
ঘণ্টা ঘণ্টা ঘণ্টা (এজিদ ও সাতভাই বোনের প্রবেশ)
বাজলো শুরুর ঘণ্টা
হায়াত দরাজের ঘণ্টা।
এজিদ
হঠাৎ কেন? আনচান করে মনটা?
সবাই
বারোটা বারোটা বারোটা
বাজবে মোদের বারোটা
সাবিবর
হায়াত দরাজের ঘণ্টা।
দাখিল
মারবে এবার তেষ্টা।
সবাই
তেষ্টা তেষ্টা তেষ্টা
মারবে এবার তেষ্টা
বারোটা বারোটা বারোটা
দাখিল
কাটায়ে করবে তেরটা। (হায়াত দরাজের প্রবেশ)
হায়াত
ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং
ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং
প্রিয় ছাত্রগণ শুরু কর অধ্যয়ন। অনুশীলন পর্বের প্রথম ধাপ শুরু করো প্রার্থনা সঙ্গীত।
(হায়াত ঝিমোচ্ছে। সবাই প্রার্থনা সঙ্গীত শুরু করে।)
সবাই
খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট শিশু প্রভু আনমনে।
খেলিছ লয়ে অসহায়-এ
খেলিছ বান্দর নাচায়ে
ছাগলের মতো করে দড়িতে ঝুলায়ে ।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা,
নিত্য ভাঙ্গিয়া পিঠে কাঠের চেলা। (দাখিল হায়াতের শররি মালিশ করার সুযোগে চড়-থাপ্পড় মারে খালেদের প্রবেশ)
খালেদ
হায়াত পরাজ খান।
হায়াত
গোস্তাগি মাফ হয় জনাব।
খালেদ
ছাগলে আর বান্দরে সহ-অবস্থান, একি সম্ভব সেনাপতি হায়াত দরাজ খান।
[খানদানি কিসসা ১ম অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
হায়াত
হচ্ছিল প্রার্থনা সঙ্গীত, এর মধ্যে কেন ছাগল আর বান্দর?
খালেদ
আমিও তো লা জবাব শিক্ষক প্রবর ।
হায়াত
প্রিয় ছাত্রগণ। শুরু করো অধ্যয়ন।
দাখিল
গাহি সাম্যের গান।
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নাই কিছু মহিয়ান
গাহি সাম্যের গান।
খালেদ
চোপরাও বেত্তমিজ নালায়েক নাফরমান।
দাখিল
আব্বা হুজুর। আমি না তো। নজরুল ইসলাম।
খালেদ
হারাম, হারাম, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নাই কিছু মহিয়ান যদি তার মূলে থাকে সাচ্চা খানদান।
হায়াত
মালুম হোতা হ্যায়, ফাজলামি করা আমার সাথে প্রিয়ছাত্রগণ এটেনশন। ধোলাইয়ের জন্য প্রস্তুত করো দেহ মন। (পিটাতে থাকে) প্রিয় ছাত্রগণ, এবার স্বহস্তে করো কর্ণমর্দন। দুই পা ঝুলিয়ে রাখো গোড়ালি সীমায় ।
হাবিল
পারি না গুরুজি। পায়ে ঝিন ঝিন ধরে যায়।
হায়াত
খানদানি রীতিনীতি অনুশীলন এতই সহজ? নিত্যদিন করতে হয় ধোলাই মগজ।
খালেদ
হায়াত দরাজ খান।
হায়াত
বলুন, কি ফরমান?
খালেদ
খানদান। নাদান খানদান। এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান। আমার পুত্র, আমার বংশে জন্মগ্রহণ করি, ইদানিং ঐ পাশের বাড়ি করে ঘোরাঘুরি।
হায়াত
এজিদ। এইসব কিন্তু বাড়াবাড়ি।
এজিদ
গুষ্টি মারি।
হায়াত
কি?
এজিদ
না কিছু না। নিজেই নিজের শ্রাদ্ধ করি।
হায়াত
শ্রাদ্ধ। এ আবার কোন শব্দ । এতে তো পাই না খুঁজে খানদানি গন্ধ।
খালেদ
এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান। বসন্তের ছাওয়ায় নার্গিস লালার খুশবু স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু গুলশানের আমেজে গুলজার হওয়া নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়।
এজিদ
জি আব্বাজান।
খালেদ
ভুলে যেওনা তুমি এক খানদানি পিতার ঔরসজাত সন্তান।
এজিদ
সব কিছুতে কেবল খানদান আর খানদান। এভাবে কি মানুষ বাঁচে আব্বাজান?
খালেদ
সাবধান এজিদ সাবধান ভুলে যেওনা তুমি খান্দানের তাগ্রাম।
এজিদ
আমি মানি না এসব আব্বাজান।
খালেদ
চোপরাও বেত্তমিজ নালায়েক নাফরমান (চড় মারে)। ইয়ার্কি পেয়েছো? বাপের সাথে মশকরা করতি লাগিছ? হারামজাদা। বাপের কুলাঙ্গার খাইয়ে খাইয়ে পেটে তোমার চর্বি জমিছে। আমি মানি না। তুই মাইনবি না, তোর বাপে মাইনবে। তোর চৌদ্দ ৩টি মাইনবে। শালার বাচ্চা শালা।
হায়াত
লা হাউলা। গোস্তাকি মাফ হয় জনাব। এ কিন্তু নয় খানদানি জবান।
খালেদ
চোপ শালার পুত বউয়ের ভাই। কেতায় আগুন তোর খানদান ফানদান। খাইয়ে খাইয়ে মানুষ করেছি এমনি এমনি? কথায় বলে না? কয়লা যায় না ধুলে, স্বভাব যায় না মলে। চাষার বাচ্চা চাষা খানকির পুতে কয় আবার ঐ শালা ছিলি তো ব্যাপারি। বানিয়েছি— গুরু। কি বইলতে কি বলি। (সংযত হয়ে) দুঃখিত হায়াত দরাজ খান। এ নহে খানদানি জবান। সাবধান, এজিদ সাবধান। ভুলে যেওনা তুমি এক সাচ্চা খানদানি বংশের নওজোয়ান। তাই এইসব মোনাফেকি শব্দ— মানি না, মানবে না বলা তোমার জন্য হারাম। থাক, ওরা এইভাবেই থাক। দূষিত রক্ত চাষাভূষার শব্দ, ধুয়ে মুছে যাক।
হায়াত
থাক এভাবেই থাক
খালেদ
হায়াত দরাজ খান।
হায়াত
বলুন কি ফরমান?
খালেদ
কথা আছে চলুন। বাইরে প্রস্থান। (দু’জনের প্রস্থান)
এজিদ
আই রিভোল্ট।
সাবিবর
ওরে বাব্বা । ইলেভেন থাউজেন্ড ভোল্টস।
এজিদ
আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করছি। আমি ভয়ঙ্কর শব্দে বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছি। আমার রক্তে রক্তে এখন ধ্বংসের মাতম। কণ্ঠে আমার ভাঙনের গর্জন। এই মুহূর্তে আমি ছিন্ন করছি রুটিন মাফিক জীবন। ভিয়েতনামী গেরিলা যুদ্ধের শিক্ষা আর ওহাবি বিদ্রোহের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে, এসো আমরা জানিয়ে দেই মানি না মানবো না এই মধ্যযুগীয় খানদানি নিপীড়ন। বাস্তব অবস্থার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রমাণ করছে এখনই সময় । এসো ভ্রাতৃকুল ভেঙে ফেলি ঐ ব্যারিকেড। সমস্ত শোষণ নিপীড়ন ছিন্ন করে চলো, সমাজ বিপ্লবের পতাকা হাতে সামনের দিকে এগিয়ে যাই।

সাবিবর
সাব্বাস এজিদ। এই তো চাই।
দাখিল
আমি নাই।
এজিদ
কেন ভাই?
দাখিল
আব্বাজানের কিল গুঁতোর কথা মনে নাই?
এজিদ
ওরে ভীরু তোমার হাতে নেই ভুবনের ভার ।
সবাই
(গান) এক সাথে সব হাল ধরেছি হবো সাগর পার (হায়াত দরাজ ও খালেদের প্রবেশ) এখানে ওখানে যত ব্যারিকেড ভেঙে করো চুরমার।
[খানদানি কিসসা ১ম অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
কাবিল
এলার্ট ।
এজিদ
(গান) আঘাত যদি আসে তবে আমার বাবার কি।
আছি আমি সাথে নিয়ে খানদানি জিন্দেগি।
খালেদ
সাব্বাস বেটা। এক থাপ্পড়েই অভাবনীয় উন্নতি। হায়াত দরাজ খান। বাঙালি চরিত্রের এ এক আশ্চর্য দিক থাকে শান্ত সুবোধ যদি ঘুরাও স্টিক। যা হোক, আমি খুশি এজিদ । আমি খুশি।
হায়াত
শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আমরাও মহাখুশি। এই খুশিতে দিলাম ষাট মিনিটের ছুটি।
সবাই
ছুটি ছুটি ছুটি ছুটি। ষাট মিনিটের ছুটি। (প্রস্থান)
খালেদ
হায়াত দরাজ খান। এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহানকে নিয়ে আমি বড় চিন্তযুক্ত। উহার তবিয়ত বড়ো…..
হায়াত
চিন্তা করবেন না জনাব, আমি যদ্দিন আছি।
খালেদ
যাক। অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। ঐ যে তথাকথিত আ. খ. ম পুষ্প সোবহান।ইদানিং করছে বড্ডো বাড়াবাড়ি।
হায়াত
সানটিং দেন তাড়াতাড়ি।
খালেদ
কওমের খেদমত আমার মূলমন্ত্র। জেলার পশুরক্ষা সমিতির চেয়ারম্যান আমি। 1 গণতন্ত্র চর্চা সমিতির আহ্বায়ক-
হায়াত
আপনি ।
খালেদ
তদবির সমিতি, ইসলামী সংস্কৃতি লালন কেন্দ্র, নজরুল চর্চা কেন্দ্রের
হায়াত
আপনি সাধারণ সম্পাদক।
খালেদ
কি দুঃসাহস, ঐ তথাকথিত আ. খ. ম. পুষ্প সোবহানের আমি মাযহার ইবনে গুয়াবাত সোহানের সন্তান খালেদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান। আমার খুন জোশিতে লোহিত সমুদ্রের রাগ। হায়াত দরাজ খান-
হায়াত
বলুন কি ফরমান?
খালেদ
ঐ যে পশ্চিমের গজারির বন। যা নিয়ে গত দুই বছর ধরে চলছে মামলা। আমি এবার করে নিতে চাই ফয়সালা । অন্যথায় জানিয়ে দাও ঐ নালায়েক তথাকথিত আ. খ. ম. পুষ্প সোবহানকে। প্রয়োজনে জেহাদে সামিল হয়ে নেবো দখলি স্বত্ব, তারপর বোঝাবো আমার পায়ের তলার মাটি কতো শক্ত। (প্রস্থান। পুষ্প এবং প্রতিহারীর প্রবেশ)
পুষ্প
না না না না। আমি আর কোনো শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকতে চাই না। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী । অনেক সহ্য করেছি আমি, আর না। আমি অসীম পবন ঘূর্ণি সোবহানের সন্তান আ. খ. ম. পুষ্প সোবহান। ওর কতো বড় দুঃসাহস। প্রতিহারী।
প্রতিহারী
আদেশ শিরোধার্য মহোদয়।
পুষ্প
যুদ্ধ।
প্রতি
যুদ্ধ।
পুষ্প
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যুদ্ধ। পশ্চিমের গজারির বন বিদেশে থাকতে করেছি জনা। এখন খালেদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান তার দখল নিয়ে করছে বিক্রয়। আমিও আ পুষ্প সোবহান, দেখে নেবো ও বাড়ির লাঠির কত ধার ছিনিয়ে প্রতিষ্ঠা করবো আমার গণতান্ত্রিক অধিকার।
প্রতি
আর কিছু, আর
পুষ্প
অতএব দাও-লাঠি-বল্লম-মরিচের গুঁড়া যাবতীয় প্রস্তুতি করো সম্পাদন। তারপর চতুর্দিক থেকে করো সাড়াশী আক্রমণ। (প্রস্থান)
কোৱাস
দেশবাসী দেশবাসী
পৌরবাসী পৌরবাসী
হাতে তুলে নাও এবার আসি ।
বগলে দাবায়ে রশি
ঠোটেতে মধুর হাসি।
বাজাও গো অভিজাতের বাঁশি।
দেশবাসী দেশবাসী পৌরবাসী
বাজাও গো জেহাদি বাঁশী
দেশবাসী দেশবাসী। (প্রস্থান)
এজিদ
(গান) হাসি হাসি পরবো ফাঁসি হবো জান্নাতবাসী,
এবার বিদায় দাও গো মরে বাঁচি।
মরে যাবো, আমিও একদিন টুক করে মরে যাবো। যুদ্ধকে ঘৃণা কর, ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধর। ভালোবাসা, সেতো বসন্ত গোলাপ। দুটি মন দুটি জীবন, তাকে ধ্বংসের জন্য আজ এতো আয়োজন দাও, লাঠি, বল্লম, মরিচের গুঁড়া। মাঝখানে দুইখান গোলাপের চারা। ঐ তো শোনা যায় উন্মত্ত পঙ্গপালের হিংস্র গর্জন। (দ্রুত প্রবেশ নুসরাতের)
নুসরাত
এজিদ। আমার সাত রাজার ধন।
এজিদ
নুসরাত। আহা হা। কতোদিন পর। কতো যুগ। কতো বছর। পাশাপাশি । কাছাকাছি। দুটি মন দুটি চোখ।
নুসরাত
খবর কিন্তু খারাপ। শোন, পাকা খবর যুদ্ধ হবে ভয়ঙ্কর। বাপীর ঘোষণা। কি হবে গো আমাদের, বলো না?
এজিদ
জানি না।
নুসরাত
ভালো লাগে না। কিচ্ছু ভালো লাগে না। দীর্ঘ এক মাস পর একান্ত নিভৃতে দেখা আমার যে নিত্যদিন ইচ্ছে করে। আর কি হবে দেখা ঐ যুদ্ধের পরে?
এজিদ
হবে। নিশ্চয়ই হবে। আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে? ভেবো না নুসরাত। আমি বিদ্রোহ করবো। আমি পাঁচ বছর ধরে ফরাসি বিদ্রোহের ইতিহাস অধ্যয়ন করবো। দশ বছর ধরে গেরিলা যুদ্ধের কলা-কৌশল রপ্ত করবো। আমি ত্রিশ বছর অবিরাম যুদ্ধ করে তোমাকে জয় করবো।
নুসরাত
হ্যাঁ গা, ততোদিন কি আমি বাঁচবো?
এজিদ
আমরা না হয় নাই বাঁচলাম। কিন্তু আমাদের স্বর্গীয় ভালোবাসা তো বেঁচে থাকবে। মুখে মুখে ঘরে ঘরে সমাজবিকাশের প্রতিটি স্তরে। পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিক কুলের হৃদয়ে অঙ্কিত থাকবে আমার ছবি।
নুসরাত
কিন্তু আমার হবেটা কি?
এজিদ
কেন? অপেক্ষা করবে। ইতিহাসের রায়ের অপেক্ষায় আমরা দিন গুনবো
নুসরাত
তুমি গুনো। আমি বরং সৈয়দ ভাইকে বিয়ে করবো। বাপীরও তাই মত। ছেলে হিসেবে সে নাকি অত্যন্ত সৎ। (চলে যাচ্ছে)
এজিদ
নুসরাত একটি আদর্শ মার্কসীয় প্রেমের এই কি প্রতিদান?
নুসরাত
এতদিন ধরে আমার অপেক্ষার ধৈর্য নেই। এজিদ, দু’বছরেই আমি ক্ষিপ্ত, জ্ঞানশূন্য, বেসামাল।
এজিদ
আমার রণকৌশলের ওপর বিশ্বাস রাখো। তুমি অহেতুক করছো রাগ।
নুসরাত
হ্যাঁ রণকৌশল আসলে তুমি একটা কাগুজে বাঘ। একটা সত্যি কথা বলবে? তোমার কি বিয়ে করার আদৌ ইচ্ছে-টিচ্ছে আছে? নাকি অন্য কোথায়ও তোমার মন বাঁধা পড়ে গেছে?
এজিদ
ভুল। নুসরাত ভুল আমার চোখের দিকে তাকাও। ম্লান মুখের দিকে তাকাও, ফ্যাকাসে। তোমার দুশ্চিন্তায় ভুগে ভুগে সমস্ত শরীর অস্থি-চর্মসার। বুকের গহীনে যেথায় ঝরতো অবিরাম বরষা, নিদারুণ উৎকণ্ঠায় সেখানে গ্যাস্ট্রিক বেঁধেছে বাসা। ভুল করলে নুসরাত, মহাভুল।
[খানদানি কিসসা ১ম অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
নুসরাত
গুল। সবই গুল।
এজিদ
(গান) ভুল । সবই ভুল
নুসরাত
গুল। সবই গুল।
ছলায় কলায় কথার মালায়
ছাড়ছ যে কে তুমি গু ।
এজিদ
তুমি বললে গুল? বেশ তবে তাই হোক, আমিও প্রমাণ করে দেবো আমার ভালোবাসার বহ্নিশিখায় নেই এতটুকু ফাঁক । যাক ভুল বোঝাবুঝির পালাটা যাক। কেটে পড়ি।
নুসরাত
কোথায় যাবো?
এজিদ
এই খানদানি কারাগারের বাইরে মুক্ত বিশ্বে। এই মূল প্রাচীরের বাইরে অন্য কোথাও।
নুসরাত
কিন্তু ঐ কলাপসিবল গেট
এজিদ
ভেঙে ফেলবো।
নুসরাত
এই লেবাস?
এজিদ
ছিঁড়ে ফেলবো।
নুসরাত
চাচাজানের রক্তচক্ষু ।
এজিদ
উপেক্ষা করবো।
নুসরাত
হায়াত দারাজ খানের দণ্ডাদেশ।
এজিদ
অগ্রাহ্য করব।
নুসরাত
সাব্বাস এজিদ। এই তো চাই। চলো।
(কিছুদুর গিয়ে থেমে যায়)
নুসরাত
এই, থামলে কেন? চলো।
এজিদ
দাড়াও।
নুসরাত
কেন? কি হলো?
এজিদ
শব্দ পাচ্ছ?
নুসরাত
শব্দ?
এজিদ
কে যেন আসছে?
নুসরাত
তাইতো, কে যেন আসছে। চলো পালাই । আহা চলো ।
এজিদ
যাবো? চলো। (কিছুদূর গিয়ে থেমে যায়)
নুসরাত
কি হলো?
এজিদ
এদিক থেকেই আসছে।
নুসরাত
ওদিকে চলো ।
এজিদ
ওদিক থেকেও।
নুসরাত
তাহলে?
এজিদ
প্রস্তুতি নাও ।
নুসরাত
পালাবো?
এজিদ
না।
নুসরাত
তবে?
এজিদ
যুদ্ধ করবো। হঠাৎ আক্রমণ করে পরাজিত করবো।
নুসরাত
থেমে আছ কেন? এগিয়ে যাও।
এজিদ
দাঁড়াও। সঠিক রণকৌশলটা নির্ধারণ করতে দাও ।
নুসরাত
দেরি করো না এজিদ। এগোও ।
এজিদ
আহা, একটু ভাবতে দাও ।
নুসরাত
তুমি কি আদৌ যাবে?
এজিদ
নুসরাত। অনেক দেখলাম ভেবে। মার্কসবাদী চিন্তা চেতনার সঠিক প্রয়োগে, এই মুহূর্তে আক্রমণ করাটা কি উচিত হবে?
নুসরাত
হুঁ। আমি চললাম তবে।
এজিদ
আমি প্রস্তুত আক্রমণে যাচ্ছি। বিদায় নুসরাত। যাচ্ছি।
নুসরাত
যাচ্ছো কোথায়। তুমি তো পিছাচ্ছো। এগোও
এজিদ
না। সাবধান।
নুসরাত
কেন?
এজিদ
মনে হয়…
নুসরাত
কি?
এজিদ
ওরে বাপরে, হায়াত দারাজ খান।
(লুকোয়, একে একে সবাই ঢোকে )
হায়াত
ছাগলের মতো করে দড়িতে ঝুলায়ে
তোরে হান্টার দিয়ে আমি পিটাবো!
ভালোবাসা কারে কয় তার প্র্যাকটিকেল শিখাবো।
কোরাস
সারেন্ডার করো তোমরা সারেন্ডার, না হলে তোপের মুখে হবে চুরমার।
খালেদ
সারেন্ডার অর ফায়ার।
কোরাস
আয় খান্দানের বংশধর
ওয়ারফিল্ডে ঝাপায় পড়
জাতের কুল মান রক্ষা কর
পালানোর পথ বন্ধ কর
লেফট রাইট…
রাখতে হবে কওমের নাম
আয় খান্দানের নওজোয়ান
শমসেরে তোর দিয়ে শান
আয় দিলাবার জোরয্যান
লেফট রাইট…
সারেন্ডার কর তোমরা সারেন্ডার
না হলে তোপের মুখে হবে চুরমার।
পুষ্প
বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী। নুসরাত, এখনো যথেষ্ট সময় আছে। আত্মসমর্পণ করো। যেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লালিত হয়েও নিজের আত্মাকে করেছো কলুষিত। এখনো সময় আছে প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ হও। বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করো ।
[খানদানি কিসসা ১ম অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
খালেদ
বেটা এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান। ঐ নালায়েক কমিনা মেয়েছেলেকে তালাক দাও। শত সহস্র খানদানি জেনানা তোমাকে শাদি করার জন্য উদগ্রীব। নিকাল আও বেটা। বাহার আও
পুষ্প
স্নেহধন্য নুসরাত । যাকে বিশ্বাস করে তুমি নিজ বংশ আভিজাত্যে চুনকালি মেখেছ সে একটা নিম্নশ্রেণীর নামগোত্রহীন নোংরা পরিবারের সন্তান। ওরা আমাদের কৃষ্টির কলঙ্ক। মানব সভ্যতার কলঙ্ক ।
খালেদ
খবরদার কতিছি পচা। জাত ভুইলে কথা কবি না বইলে দিচ্ছি। তোর ঐ নষ্ট মেয়েছেলেটা
পুষ্প
কি? আমার মেয়ে নষ্ট? শালার ভাই শালা। আমার মেয়ে শরিফ।
খালেদ
এত যে বংশ বংশ করতি লেগেছিস। কি আছে? বলি খানদানি কোন জিনিসটা আছে তোর মইধ্যে?
পুষ্প
চোপ শালা রাজাকার
খালেদ
রাজাকাররা চুপ কইরবে না। রাজাকাররা এইবার মুখ খুইলবে। শালা মুক্তিযোদ্ধার চোটপাট দেখাতি লাগিছিস? জাত তুইলে কথা বলিস, জাতের কি আছে তোর মইধ্যে?
পুষ্প
আমার না থাইকলে তোর কি আছে?
খালেদ
কি আমার খানদানি মুরোদ রে। ঐ তোর ঘরে কি হাবিবুল্লাহ খানের সানাই আছে?
পুষ্প
তোর চৌদ্দ গুষ্টি কোনোদিন চন্দ্রশেখরের সেতার শুনছে?
খালেদ
আমার ঘরে আলমারি ভর্তি একখান মার্কস, লেলিন ভলিউম আছে।
পুষ্প
আমার ঘরে এবেষ্টাক পেইন্টিং আছে। রাধাকৃষ্ণের ক্যাসেট আছে। মাইকেল জ্যাকসনের ডিস আছে।
খালেদ
আমার ঘরে নজরুলের ফটু আছে।
পুষ্প
আমার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ফটো আছে।
খালেদ
তোর বাপে কোনোদিন রবীন্দ্রনাথের নাম শুনছে?
পুষ্প
খবরদার বাপ তুইলে কথা কবি না বলে দিচ্ছি। হাটে হাড়ি ভাঙি দিমু। চাষার বাচ্চা চাষা।
খালেদ
চোপ এক্কেরে ভাঙি দিমু, শালার বাচ্চা শালা। ঐ, আমার বাপ চাষা হলি পরে। তোর বাপ কি?
পুষ্প
আমার বাপ?
খালেদ
না থাইক, শুধু এই পয়েন্টে কম্প্রোমাইজ।
পুষ্প
(করমর্দন করে) সিজ ফায়ার কম্প্রোমাইজ। স্নেহের নুসরাত এখনো সময় আছে। আত্মসমর্পণ করো।
খালেদ
এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান। সারেন্ডার অর ফায়ার।
কোরাস
দাও লাঠি বল্লম মরিচের গুঁড়া
দুষ্কৃতকারী আজ পড়িবে ধরা
কম্বিং অপারেশন ফ্রন্ট লাইন এ্যাকশান
ফায়ারিং হুঁশিয়ার এক পায়ে খাড়া।
এজিদ ও নুসরাত
মোরা এতিম সর্বহারা
মোরা দুইখান গোলাপের চারা
আমি দেবো না দেবো না ধরা দেবো না দেবো নারে
বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না।
নুসরাত
আমি যাবো না যাবো না ঘরে
যাবো না যাবো নারে
সে বিহনে মন বসে না।
নুসরাত
বাপী-
এজিদ
আব্বাজান-
হায়াত
এটেনশন।
এজিদ
আব্বাজান। চাচাজান। বাঁচান, দুইটি গোলাপ ফুলকে বাঁচান ।
হায়াত
চোপরাও নাদান।
এজিদ
জনাব ভাবী শ্বশুরজান। মেহেরবানী করুন, মেহেরবান। নুসরাত বিহনে বাঁচিবে না প্রাণ ।
খালেদ
চোপরাও নালায়েক শয়তান। হায়াত দরাজ খান, করুন কঠিন শাস্তি প্রদান।
হায়াত
এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান। খানদানি রীতিনীতি ভঙ্গের অপরাধে শরিয়তের আইন অনুসারে তোমাকে মাটিতে পুঁতে প্রস্তর নিক্ষেপ করা হোগা
নুসরাত
মধ্যযুগীয় বর্বরতা।
এজিদ
নিষ্ঠুর। কি নিষ্ঠুর! বিদায় নুসরাত বিদায় শ্বশুর বিদায় রবি শশী তারা। সাক্ষী থেকো কেমন করে ধ্বংস হলো দুইখান গোলাপের চারা।
নুসরাত
এজিদ সোনা, মানিক আমার, আর কি দেখা হবে?
এজিদ
এখন না হোক ২০ বছর পরে হলেও তো হবে।
নুসরাত
২০ বছর? এতদিন অপেক্ষা করা কি সম্ভব হবে?
এজিদ
দোহাই লাগে নুসরাত। দোহাই। আমি ছাড়া অন্য কাউকে মনে দিওনাগো ঠাঁই।
নুসরাত
ভয় হয়। যদি সৈয়দ ভাই—
এভাবে বলো না গো। মনে বড়ো কষ্ট পাই। আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়। যাই-
(দুই দল দু’জনকে দুদিক থেকে টানছে)
সৌরভ
কই যাওরে, তারে একা থুইয়া
ধোপ কাপড়ে লাগায়ে দাগ বিধবা করিয়া
কই যাও, যাওরে।
এজিদ
বোইন গো
সাধে কী আর যাই
টানে আমারে মাজায় দড়ি দিয়া
অপেক্ষা করিও তুমি কুমারী থাকিয়া
আমি যাই, যাইরে।
নুসরাত
পরান আমার কেমন কেমন করেরে
আর কি দেখা হবে এই বছরে।
এজিদ
টুনটুনি, আমি আসিবই ফিরিয়া ও টুনটুনিরে
খোদার কসম সৈয়দ ভাইরে, না করিও বিয়া
আমি খাই, যাইরে।
নুসরাত
ও হায় হায়রে ।
(হঠাৎ একজন বিশ্রি আমা লোক ঢোকে)
হায়াত
এলার্ট।
পুষ্প
সর্বনাশ, সেরেছে।
লোকটি
ছেইলে মেইয়ে দুইটিরে ঐ রকম টানাটানি করতি লেগেছে কেন? এত লোকজন কি করে এহেনে, কি ব্যাপার কেউ কথা কতি চায়নে। মোর ভাইয়ের বেটারা আমারে চিনতে পারলিনে, আমি তোমাগোর চাচা সোনা মিয়া।
পুষ্প
শাট আপ।
খালেদ
অ্যাটাক। (সবাই কর্ডন করে)
(মঞ্চ অন্ধকার)
খানদানি কিসসা নাটক : ২য় অঙ্ক
প্রথম প্রযোজক দল : সুবচন নাট্য সংসদ
প্রথম প্রদর্শনীর স্থান : গাইড হাউস মিলনায়তন, ঢাকা
কুশীলব
সূত্রধর : বনলতা সাহা
এজিদ : মিঠু
নুসরাত : বাণী
হায়াত : বিপুল
জহির : সজিব
কাইয়ুম : স্বপন
সাববির : কাদের
হাবিল : নান্টু
দাখিল : আসলাম
কাবিল : কবির
সখিনা : সেতু
খালেদ : শাহজাহান (১)
পুষ্প : আরজু
সৌরভ : গিয়াস
কাজী : রফিক
প্রতিহারী : রফিক
কবি সৈয়দ : তৌফিক
সোনা মিঞা : শাহজাহান (২)
কোৱাস : বাবলু, গিয়াস, শ্যামল, তুহিন, তপু, বাসির, সাউদ, শোভন ও লিটু
গায়েন : বনলতা সাহা।
কলাকুশলী
নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান
মঞ্চ ব্যবস্থাপনা : মোঃ শাহজাহান (২)
আলোক পরিকল্পনা : ঠাণ্ডু রায়হান
মঞ্চ পরিকল্পনা : আবু দাউদ আশরাফী
পোষাক পরিকল্পনা : ওয়াহিদ মুরাদ
সঙ্গীত : জাহিদ, তন্ময়, রুমা, পাভেল, বাবুল
প্রচ্ছদ : উত্তম সেন
প্রযোজনা অধিকর্তা : ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীর প্রতীক)

কোরাস
এবার ওঝার ঘাড়ে ভূত আছর করে
দেখো সোনা মিয়া এলো লঞ্চে চড়ে।
জংলি ভূতের এমন বুকের পাটা
মানুষ রে ডাকে আবার ভাইয়ের ব্যাটা
এমন শিক্ষা দিতে হবে তারে
যেন জানের ভয়ে এই তল্লাট ছাড়ে।
(কোরাসের প্রস্থান, সূত্রধর ঢোকে)
সুত্রধর
দেখেন দেখি ব্যাপারখান, কতি এসেছিলাম খানদানি কিসসা। মাঝখান দিয়ে কোথাকার কোন সোনা মিয়া এইসে প্যাঁচ লাগায়ি দিলো। আরে ব্যাটা আসলিই যদি একটু নামটা পাল্টিয়ে আসতি পারলিনে? খালেদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান আর ভিন্ন খানদান আ খ ম পুষ্প সোবহানের চাচার নাম সোনা মিয়া, একি সম্ভব? কোথায় যেন একখান ঝামেলা বেঁধেছে। কেমন য্যান মাটি মাটি গন্ধ পেতি লাগিছি। দেখা যাক কি দাঁড়ায়। (প্রস্থান)
[খানদানি কিসসা ২য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
সোনা মিয়া
ভাইয়ের ব্যাটারা, এইবারের মতন মাফ কইরে দাও। এই রকম ভুল আমি জীবনে কইরবো না। আমারে যাতি দাও। তোমাগোর বাপে ডাক দিয়া কলি যা সোনা, নাতি-নাতিনগুলো কেমন আছে একবার দেইখে আয় তোমাগোরে ত্যাজ্য করলি কি হবি, নাতি-নাতিনগোর কথা কি ভুইলতে পারে? তা এইঠে এসে আমার জন্মের শিক্ষা হয়ি গ্যাছে। দাও, পোটলাটা দাও। আমি চইলে যাচ্ছি।
খালেদ
শাট আপ।
সোনা মিয়া
কি কলি বাপ?
পুষ্প
আপনি কোথাও যাবেন না।
সোনা মিয়া
আমারে যাতি হবে। আর কয়েকদিন থাকলি পরে দম বন্ধ হয়ি মারা যাবো। দাও, আমার পোটলাটা দাও। লঞ্চ ছাড়নের সময় হয়ি গ্যাল।
খালেদ
পাক জনাবেষু ।
সোনা মিয়া
কি কও না কও ।
পুষ্প
মন দিয়ে শুনুন চাচা শুভ্র সুন্দর শুদ্ধ সোবহান।

সোনা মিয়া
কি শুভ্র শুভ্র। আমি সোনা মিয়া।
খালেদ
না, আপনার নাম সোকরে নজরানা নসিহত সোবহান।
পুষ্প
না, আপনি শুভ্র সুন্দর শুদ্ধ সোবহান ।
খালেদ
আমি বলছি সোকরে নজরানা নসিহত সোবহান।
সোনা মিয়া
আমি কতিছি সোনা মিয়া আমার নাম।
পুষ্প
ঠিক আছে। এই জায়গায় আমি তোমাকে ছাড় দিলাম
খালেদ
শোকর আলহামদুলিল্লাহ। এবার মন দিয়ে শুনুন জনাব সোকরে নজরানা নসিহত সোবহান।
সোনা মিয়া
আরে ধুর, কি কয় না কয়। আমি সোনা মিয়া।
পুষ্প
ছিলেন।
সোনা মিয়া
মানে?
খালেদ
মানে আপনি আর সোনাদানা না। আপনার শরীফ নাম হচ্ছে—
পুষ্প
শুভ্র সুন্দর শুদ্ধ, আচ্ছা থাক।
খালেদ
আপনার নাম সোকরে নজরানা নসিহত সোবহান।
সোনা মিয়া
মস্করা করতি লেগেছ? আমি যাচ্ছি।
পুষ্প
কোথায় যাবেন?
সোনা মিয়া
লঞ্চ ঘাটে।
খালেদ
কলাপসিবল গেইট বন্ধ।
পুষ্প
দরজায় কড়া।
খালেদ
হায়াত দরাজ খানের-
পুষ্প
বাইরে প্রহরা।
সোনা মিয়া
কোন বিপদে পড়লামরে আল্লা।
খালেদ
গলাটিপে ধরবে। আপনি যাবেন-
পুষ্প
তবে কিছুদিন পরে ।
খালেদ
কারণ, এখন আপনি তবিয়ত খারাপ করে চলে গেলে-
পুষ্প
সবার মনে প্রশ্ন জাগবে এবং যা কিনা আমাদের দু’জনের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনবে। কাজেই কিছুদিন আপনাকে পালা করে দুই বাড়িতে থাকতে হবে। প্রথম মাসটা।
খালেদ
আমার বাড়িতেই থাকবেন। হায়াত দরাজ খান শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করবে।

পুষ্প
বেশ তাই হবে। তবে আমার বাড়িতে আপনার ভিন্নধর্মী দীক্ষা নিতে হবে। (প্রস্থান)
খালেদ
হায়াত দরাজ খান, সবাইকে নিয়ে আসুন তবে
(ছেলেমেয়েসহ বিশেষ খানদানি কায়দায় হায়াতের প্রবেশ। সোনা মিয়া আতঙ্কিত। চুড়িদার পায়জামা, আচকান, জুতা জোর করে পরানো হচ্ছে।)
[খানদানি কিসসা ২য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
সবাই
আইয়ে আইয়ে আইয়ে আইয়ে খানদানি তানজাম
পহেলা মুঝেকো শুনিয়ে দাদাজান
একঠো পাকিস্তানি জবান
জাপটাইয়া ধর তারে সাপটাইয়া ধর
চিত কইরা শোয়াইয়া পিনজিরাতে ভর।
আছড়াইয়া মাছড়াইয়া ধোয়া মোছ কর
ঘষিয়া মাজিয়া তারে হেদায়েত কর ।
রুমাল হান্দাইয়া দে পকেটের ভিতর
বেশি জোড়াজুড়ি করলে গলা টিপা ধর ।
মনোযোগ দিয়ে নাও গো শিখিয়ে সাচ্চা খানদানি জবান।
বাইঠিয়ে বাইঠিয়ে বাইঠিয়ে ইয়াহিয়া খান ।
খালেদ
পুত্রগণ ও কন্যাগণ।
হায়াত
দিল সাফ করে করো শ্রবণ।
সোনা মিয়া
ও বাপ, আমার তো নিশ্বাস বন্ধ হয়ি যাতিছে।
খালেদ
আজ আমাদের খানদানি পরিবারের অত্যন্ত আনন্দের দিন।
সোনা মিয়া
কাপড়-চোপড় তো আমারে ঝাপটায়ে ধরিছে।
খালেদ
আজকে আমি তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি এমন একজন বিশাল ব্যক্তিত্বের-যাকে কিনা তোমরা বলতে পারো একটি আদর্শ কওমের হলকুম।
সোনা মিয়া
ও বাপ, কাপড়-চোপড় গুলান খুলি নে। লুঙ্গিটা দে, কথা দিচ্ছি জীবনে কোনো দিন তোমাগোর ত্রিসীমানায় আইবো না।
খালেদ
তোমরা জানো, তোমাদের দাদাজান আমার আব্বা হুজুর জনাব মাজহার ইবনে ওয়াত সোবহান
হায়াত
উনার মঞ্জিল
খালেদ
উনার জমিদারিতে, সহি সালামতেই আছেন। বাইরের মানুষের নাপাক কার্যকলাপ, চাষাভুষাদের যত্রতত্র বিচরণে তিনি তাক বিরক্ত। তাই মনুষ্য দর্শন বর্জন করে নিজের সাধনায় ব্যস্ত সেই গুলি কামেল মহাপুরুষ।
হাবেল
উনি কি আমাদের বাড়িতে-
খালেদ
আসবেন না। নিজের মঞ্জিলে ইবাদাত নিয়ে ব্যস্ত সেই পীরে কামেল। অনেক তকলিফ করে চাচাজানকে নিয়ে এসেছিলাম। উনার কাছে অনেক কিছু শিক্ষার আছে আমাদের সবার।
সোনা মিয়া
সারাটা শরীর চুলকাচ্ছে আমার। আমারে ছাইড়ে দেনা বাপ।
হায়াত
গোস্তাখি মাফ হয় জনাব। এ কেমন খানদান আপনার?
খালেদ
দুর্ভাগা। বদ তকদির। আমার শ্রদ্ধেয় চাচাজান গত এক বছর ধরে তার সব হারিয়ে ফেলেছেন। খুইয়ে বসেছেন তার খানদানি জবান ।
সাকিনা
এমন পাগল?
খালেদ
হ্যাঁ, বন্ধ পাগল ।
সোনা মিয়া
মিথ্যা কথা। আমি পাগল না। আমি—
খালেদ
হায়াত দরাজ খান। কৌশিশ করে দেখুন। যদি ফিরিয়ে আনতে পারেন তার খানদানি জবান। (প্রস্থান)
হায়াত
প্রিয় ছাত্রগণ । এবার অধ্যায়ন। দ্রুত বৈঠকখানায় করো গমন। (প্রস্থান)
সোনা মিয়া
ভাইরে, আমারে কোন দোজখে ফেলি দিলো। একবার কতিছে সোকরে সোকরে। আবার কতিছে পাগল ছাগল, আচ্ছা ঠিকানা ভুল কইরলাম নাতো আবার? (চিরকুট) বের করে) ও বাপ, এই ঠিকানা সেই ঠিকানা কিনা দেখি দেন তো?
হায়াত
শাট আপ
সোনা মিয়া
কই সাপ?
হায়াত
এটেনশান।
সোনা মিয়া
কি কন বাপজান?
হায়াত
আপনার নাম?
সোনা মিয়া
সোনা মিয়া।

হায়াত
বোঝা গেল। বহুত কঠিন বিমারি। ভয় নেই। সেরে উঠবেন শীঘ্রি। আমার নাম হায়াত দরাজ খান। আমি আপনার শিক্ষক, তাই-
সোনা মিয়া
আপনে আমার বইনের জামাই। লুঙ্গি আর ফতুয়াটা দেন। আমি যাই ।
[খানদানি কিসসা ২য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
হায়াত
অস্থির হবেন না জনাব। অন্দরে চলুন। আপনার যাবতীয় আরাম আয়েসের ব্যবস্থা আমিই করে দেবো। চলুন জনাব। (হায়াত এবং সোনা মিয়ার প্রস্থান)
নুসরাত
(গান) তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন আমারে-
এজিদ
হায় নুসরাত, বিধি হলো বাম। আমি আজ খানদানি পিতার কারাগারে বন্দি।হাতে হাতকড়া, পায়ে শিকল। উহ্ এ যে কি ভীষণ ধকল।
নুসরাত
বিফল। সবই বিফল। কোথায় আমাদের বিয়ে হবে। নাকে নথ উঠবে। তুমি নওশা সাজবে।
এজিদ
হবে নুসরাত, হবে ।
নুসরাত
কবে?
এজিদ
হবে। সাহস রেখো। বিয়ে আমাদের হবে।
নুসরাত
আমাদের তো হবে না। আমার হবে।
এজিদ
সেকি। কবে?
নুসরাত
সামনের মাসের এক তারিখে। সব ঠিকঠাক। বাপীকে এত করে বোঝালাম। কিন্তু না। অটল পাহাড় তিনি ।
এজিদ
সর্বনাশ। পাত্রটা কে? হায় হায় ।
নুসরাত
আর কে? সৈয়দ ভাই ।
এজিদ
ওকে আমি ঢিল ছুঁড়ে মারবো।
সোনা মিয়া
অরে লেং মারি চিৎ করি দে। (লুকোয়)
এজিদ
কে?
নুসরাত
কে?
এজিদ
হায়াত দরাজ খান!
নুসরাত
বাপী?
এজিদ
না।
নুসরাত
তবে?
এজিদ
কেউ না।
নুসরাত
যা ভয় লেগেছিল।
এজিদ
নুসরাত। যেমন করেই হোক এক তারিখের ঐ বিয়ে পিছাতে হবে। আমাকে শুধু কয়েকটা দিন সময় দাও। ফরাসী বিদ্রোহের ইতিহাস আমি পড়ে ফেলেছি। চে গুয়েভারার রণরীতি আমার মুখস্থ। রুশ বিপ্লবের ইতিহাসও প্রায় সমাপ্ত। শুধু মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সিপাহী বিদ্রোহ।
নুসরাত
এসব করে কি করবে গো?
এজিদ
অধ্যয়ন করে রণনীতি নির্ধারণ করবো। আক্রমণের তাত্ত্বিক কৌশল রপ্ত করবো। তারপর একদিন আমি হুঙ্কারে লাফিয়ে পড়ে ঐ কলাপসিবল গেট তছনছ করে দেবো।

সোনা মিয়া
তুমি ঘন্টা কইরবে।
এজিদ
কে?
সোনা মিয়া
শালা তুমি গাইও না, বলদও না। একখান গেইট ভাইবে। তার জ কুদাকুদি। আরে মরদ, শক্ত করি দেখি বাটালি নিয়ে জোরে বাড়ি মার। গেইট মেইট ঝুরঝুর করি ভাইঙে পইড়বে। (নুসরাতের কাছে) কবজিতেই জোর নাই, খালি হেন করেঙ্গা তেন করেগা।
[খানদানি কিসসা ২য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
নুসরাত
জি। আপনি?
সোনা মিয়া
সোনা মিয়া। না না। গুরুকু ইয়ে শুকরে শুকরে
নুসরাত
শুকর। (হাসে)
সোনা মিয়া
এতো হাসে ক্যান এই মাতারি। কি যেন কলে নামটা, ফিকা মার। আমি সোনা মিয়া: তোমাগোর বাপের চাচা।
নুসরাত
বাপের চাচা?
সোনা মিয়া
মাইনে তোমাগো দাদা।
এজিদ
ও আপনিই সেই—
নুসরাত
কিন্তু
এজিদ
কি?
নুসরাত
খালেদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান আর আ. খ. ম. পুষ্প সোবহানের চাচার নাম সোনা মিয়া। এইটা
সোনা মিয়া
সেই কিসসা সময় আসলেই করানে। তা তোমরা হলি গিয়ে ফিলিমের হিরু হিরুইন। তুমি হিরু। আর তুমি হিরুইন।
নুসরাত
আপনি সব শুনেছেন?
সোনা মিয়া
শুইনেছি এবং তোমাগো সাহায্য করতি মনস্থ কইরেছি।
এজিদ
বাঁচান, দাদাজান বাঁচান। পিশাচের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবে কম্পিত এক জোড়া কপোত- কপোতি। কালবৈশাখীর প্রচণ্ড তাণ্ডবে নিবু নিবু আমাদের অনির্বাণ প্রেমশিখা-
সোনা মিয়া
আ মোর জ্বালা। খালি ফ্যাত ফ্যাত করি কান্দে । আরে বিয়া করতি চাও?
এজিদ
হ্যাঁ।
সোনা মিয়া
(নুসরাতকে) তুমি রাজি?
নুসরাত
হ্যাঁ।
এজিদ
তোমারে কতিছি না। অরে কই ।
নুসরাত
কিন্তু বাপী?
এজিদ
ঐদিকে আবার হায়াত দরাজ খান?
নুসরাত
এক তারিখ আমার বিয়ে।
সোনা মিয়া
এক তারিখেই তোমার যুদ্ধ।
এজিদ
যুদ্ধ। নুসরাত। এক তারিখে যুদ্ধ। দাদু নিশ্চিন্ত থাকুন আপনি। আমি আপনাকে চমৎকার কলাকৌশল নির্ধারণ করে দেবো। আপনি করবেন যুদ্ধ। কানপুরের যুদ্ধ, অযোধ্যা যুদ্ধ, পানিপথের যুদ্ধ। ভিয়েতনামের যুদ্ধ। আলেকজান্ডারের লঙ্কা বিজয় হযরত আলীর সোমনাথ মন্দির আক্রমণ সব আমার মুখস্ত। বাকি শুধু
সোনা মিয়া
গোত্তা মারা শিখেছো?
এজিদ
গোত্তা গোত্তা?
সোনা মিয়া
মাথায় যাতা দিয়ে সাপ মাইরেছ?
এজিদ
না।
সোনা মিয়া
লুঙ্গি কাছা মারি লাঠি ধরা শিখেছ?
এজিদ
না।
সোনা মিয়া
তাইলে শিখেছটা কি তুমি? তুমি শালা কোন কিছিমের বীর?
নুসরাত
মহাবিদ্রোহী বাক্যবীর।
এজিদ
নুসরাত ইয়ার্কির দেখলেটা কি?
নুসরাত
যা সত্য তাই বলেছি।
এজিদ
নুসরাত। সীমা থাকা উচিত ইয়ার্কির
নুসরাত
ইয়ার্কির দেখলেটা কি? যা সত্য তাই বলছি।
এজিদ
সাবধান নুসরাত। আমি তোমাকে
নুসরাত
কি? কি করবে?
এজিদ
প্রহার করবো।
নুসরাত
কি? তুমি আমাকে মারবে?
সোনা মিয়া
কি শুরু করলা তোমরা?
নুসরাত
দাদু। তবে আমিও জানিয়ে দিলাম ঐ বাক্যবীরটাকে আমি তালাক দিলাম ।
[খানদানি কিসসা ২য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
এজিদ
আমার রাগ হচ্ছে।
নুসরাত
যাচ্ছি।
এজিদ
এবার আমার কান্না পাচ্ছে।
সোনা মিয়া
হাসি কান্না যা খুশি ইচ্ছি মতন কর। কথা কিন্তু একটাই। এক তারিখে যুদ্ধ ।
(প্রস্থান)
এজিদ
নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর তুমি, এভাবে পারলে তুমি বলতে? বুকের কাছাকাছি কোথাও একটু খচাং করেও কি লাগলো না? বেশ, তবে তাই হোক। আমি ও নেবো এর চরম প্রতিশোধ।
নুসরাত
প্রতিশোধ! তুমি পারবে তো?
এজিদ
তোমার বিয়ে কবে?
নুসরাত
এক তারিখে।
এজিদ
পাত্র কবি সৈয়দ আহমদ। তাই না?
নুসরাত
হ্যাঁ। জানো। ছেলেটি কিন্তু মন্দ না। আমাকে দেখে এ পর্যন্ত বারোটি কবিতা লিখে বসেছে। সেদিন একগুচ্ছ রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললেন- তোমার ঘন কালো চুল রাতের ঈর্ষা। তোমার চোখ প্রশান্তির নীল সাগর। কান তো নয় যেন দেবতার বর। বললেন- তোমার ঠোঁট…..
এজিদ
(চিৎকার করে) প্রতিশোধ।
নুসরাত
আহা শোনো না, তারপর কি বললো।

এজিদ
শুনবো না। প্রতিশোধ নেবো। তোমার বিয়ের দিন আমি সুইসাইড খাবো। তারপর-
নুসরাত
তারপর?
এজিদ
আমার পকেটে চিরকুট রেখে যাবো। আমার এই আত্মহত্যার জন্য দায়ী নুসরাত জাহান। তখন পত্র-পত্রিকায় তোমার ছবি বেরুবে। আদালতে তোমার বিচার হবে। জেল হবে।
নুসরাত
হ্যাঁ, জেল? হ্যাঁ গা, তুমি মরলে আমার কতদিন জেল হবে?
এজিদ
দিন না, দিন না। বছর। নরহত্যার দায়ে কম করে হলেও বিশ বছর।
নুসরাত
বিশ বছর?
এজিদ
বলা তো যায় না। এমন কি তোমার ফাঁসিও হয়ে যেতে পারে।
নুসরাত
এ মা, ফাঁসি?
এজিদ
হ্যাঁ। যাবজ্জীবন ফাঁসি ।
নুসরাত
না গো না, অনেক ভেবেছি আমি, অসম্ভব। তুমি, তুমিই আমার সব এজিদ সোনা। বিয়ে আমি তোমাকে ছাড়া কাউকেই করতে পারবো না। (পুষ্প এবং সৈয়দ আহাম্মদ ঢোকে)
পুষ্প
বিয়ে তুই করবি না তো তোর বাপে কইরবে? হারামজাদি বাপের কুলাঙ্গার,ঐ ধর। ঐ রাজাকারের বাচ্চাটারে ধর। বেজাতটারে আইজকা আমি- (সৈয়দ ধরতে যায়। এজিদ পালায় ।)
সৈয়দ
নাহ, নির্বিঘ্নে পলায়ন করিল। আমি দ্রুত তাহার পশ্চাতধাবন করিলাম কিন্তু – (সোনা মিয়া ঢোকে )
পুষ্প
আপনি? কবি সৈয়দ আহাম্মদ, ইনি তোমার কাকা শুভ্র সুন্দর শুদ্ধ সোবহান। অবনত হও।
(সৈয়দ আহাম্মদ কদমবুছি করে)
সোনা মিয়া
ও বেইচে যাক বাবা। কেডা তুমি?
পুষ্প
কাকা, ও হচ্ছে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল অভিজাত পরিবারের সন্তান। একাধারে কবি, ভাষাতাত্ত্বিক, একজন সত্যিকারের রুচিবান, সংস্কৃতিবান পুরুষ। আমার কন্যা নুসরাতের জামাতা। সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং রুচির ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা এক এবং অভিন্ন। (নুসরাতকে) হারামজাদি, শালীর বেটি শালী, একটা নষ্টা মেয়ে হেইলে। আইজ বাদে কাইলেকে তোর বিয়ে হচ্ছে, আর তুই কিনা—ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
সোনা মিয়া
কি করিছে ও বাপ?
পুষ্প
কি করে নাই তাই কন। বংশের কুলে কালি দিয়ে এই ঘুটে কুড়নীর-ঝি, চল । আইজ তোরে গাছের লগে ঝুলিয়ে পেটাব।
সৈয়দ
প্রিয় বাপী। প্রিয় শ্বশুর, সুপ্রিয়া নুসরাতকে ক্ষমা ভিক্ষা দিন। বিবাহের পূর্বে প্রতিটি তরুণীর এ জাতীয় পদস্খলন খুবই স্বাভাবিক। একটু দেখা, একটু ছোঁয়ার আশায় উন্মুখ হয় চিত্ত। ও কিছু না। আমি কিন্তু কিচ্ছু মনে করি নি। এখন একটু-আধটু করুক। বিবাহের পর সব ঠিক হইয়া যাইবে ।
পুষ্প
জামাতার সুচিন্তিত পরামর্শে তোমাকে মার্জনা করলাম। যাও, ঘরে যাও।
নুসরাত
আমি কিন্তু এই রকম একটা সার্কাস পার্টির জোকারকে বিয়ে করতে পারবো না।
পুষ্প
হারামজাদি তুই কি করেছিস? জামাইরে তুই অপমান করতি লেগেছিস?
সৈয়দ
না, না, নুসরাতের গায়ে হাত তুলিবেন না শ্বশুর সাহেব। নুসরাত অভিমান করিয়াছে। অপমান করে নাই। করিলেও তাহা আমার গায়ে লাগে নাই। আসলে আপনি অনুধাবন করিতে পারিতেছেন না । আমি কবিতা লিখি। রমণী হৃদয় আমার কবিতার গবেষণার বিষয়বস্তু। আমার স্নিগ্ধতার অমূল্য পরশে ও একদিন নিশ্চয়ই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া যাইবে ।
[খানদানি কিসসা ২য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
সোনা মিয়া
জামাই একখান বটে।
সৈয়দ
বাপী। চিত্তটা হঠাৎ করিয়া বড় আনমনা হইয়া পড়িয়াছে। যাই, একটু দখিনা সমীরণের নির্যাস গ্রহণ করিয়া আসি।
পুষ্প
যাও বাবা। শুভ হোক তোমার যাত্রা।
সৈয়দ
শুভ হোক। শুদ্ধ হোক।
(প্রস্থান)
পুষ্প
এক তারিখ নুসরাতের শুভ পরিণয়। প্রচুর কাজকর্ম বাকি। আপনি আমার হয়ে ও বাড়ির লোকদের বলবেন। যদি ইচ্ছে হয় আসবে, না হলে আমার কিছু করার নেই।
সোনা মিয়া
আইচ্ছা । এই ভাইয়ে ভাইয়ে এত ঝগড়া বিবাদ না কইরে একটু মিশ খায়ি থাকতি পার না। (খালেদ ঢোকে )
খালেদ
না পারি না। শির দেঙ্গে লেকিন ইজ্জত নেহি দেঙ্গে। চাচা সোকরে নজরানা নসিহত সোবহান ।
পুষ্প
ভুলে যেও না উনি এখন আমার সীমানায়। উনার নাম শুভ্র সুন্দর শুদ্ধ সোবহান।
সোনা মিয়া
নামে কি আসি যায়। ও একটা হলিই চইলবে। কছিলাম ঝগড়া ফ্যাসাদ না কইরে-
খালেদ
গজারির বনের ফায়সালা যদ্দিন না হচ্ছে তদ্দিন আপোষ সম্ভব না।
পুষ্প
আপোষ আমিও চাচ্ছি না। শুধু জানিয়ে দিচ্ছি, এক তারিখ আমার কন্যার শুভ পরিণয়। তোমার সন্তান ইতোমধ্যেই অনেক ঝামেলা করেছে। বিয়ের কাজটা নির্বিঘ্নে হয়ে যাওয়া দু’জনের জন্যই মঙ্গল। যে-কোনো ধরনের গণ্ডগোলে আসল ব্যাপারটা—তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?
খালেদ
ঠিক আছে আমার নওজোয়ানের দায়িত্ব আমার। তুমি তোমার বেটি সামলাও।
সোনা মিয়া
দুইজনকে নিয়ে ভাইয়ের ব্যাটারা এক কাজ করতি পার? এতই যখন ঝামেলা তখন ছেইলে মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়ে দাও ।
খালেদ
শাট আপ।
সোনা মিয়া
ক্যান বাপ ?
পুষ্প
মৃত্যুর পূর্বে না ।
খালেদ
তামাম জাহান ওলট-পালট হয়ে গেলেও না।
সোনা মিয়া
ও, তাইলি তো সম্ভবও না। একটা কথা কতি চাচ্ছিলাম। বইলেই ফেলি। গাঁও গিরামের কথা তোমাগোর মনে পড়ে? সেই যে একবার শিব গাজনের মেলা থিকা ফিরার পথে উঠলো ঝড়। তোমরা দুই ভাই—
দু’জনে
শাট আপ ।
সোনা মিয়া
ও ভুইলে গেছ। ও, তাইলি একাত্তর সালে পূর্ণিমার রাইতে কদম গাছের তলায় অডুইক্যা এক চিৎকার-
খালেদ
খবরদার।
সোনা মিয়া
মনে নাই। তাইলি এইডা নিশ্চই মনে আছে। ঐ একাত্তর সালেই ঘরে ঘরে তহন মাইনষের কান্দন । তোমাগোর বাপ একদিন হালের বলদ নিয়া—
দু’জনে
ইউ শাট আপ ।
(সোনা মিয়ার গলা টিপে ধরে। অন্ধকার।)
খানদানি কিসসা নাটক : ৩য় অঙ্ক
প্রথম প্রযোজক দল : সুবচন নাট্য সংসদ
প্রথম প্রদর্শনীর স্থান : গাইড হাউস মিলনায়তন, ঢাকা
কুশীলব
সূত্রধর : বনলতা সাহা
এজিদ : মিঠু
নুসরাত : বাণী
হায়াত : বিপুল
জহির : সজিব
কাইয়ুম : স্বপন
সাববির : কাদের
হাবিল : নান্টু
দাখিল : আসলাম
কাবিল : কবির
সখিনা : সেতু
খালেদ : শাহজাহান (১)
পুষ্প : আরজু
সৌরভ : গিয়াস
কাজী : রফিক
প্রতিহারী : রফিক
কবি সৈয়দ : তৌফিক
সোনা মিঞা : শাহজাহান (২)
কোৱাস : বাবলু, গিয়াস, শ্যামল, তুহিন, তপু, বাসির, সাউদ, শোভন ও লিটু
গায়েন : বনলতা সাহা।
কলাকুশলী
নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান
মঞ্চ ব্যবস্থাপনা : মোঃ শাহজাহান (২)
আলোক পরিকল্পনা : ঠাণ্ডু রায়হান
মঞ্চ পরিকল্পনা : আবু দাউদ আশরাফী
পোষাক পরিকল্পনা : ওয়াহিদ মুরাদ
সঙ্গীত : জাহিদ, তন্ময়, রুমা, পাভেল, বাবুল
প্রচ্ছদ : উত্তম সেন
প্রযোজনা অধিকর্তা : ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীর প্রতীক)

(মঞ্চে বিয়ের প্রস্তুতি)
গান
সাদিয়ে মোবারক কবি সৈয়দ আহাম্মদ
জামাই একখান বটে কত দেখিতে সরস
দ্যাখ আইছে জামাই মিয়া মুখে রুমাল দিয়া
কুছুর কুছুর পান চিবাইয়া ফেলিছে পিকের কষ
শৌর্য নাই বীর্য নাই তবু সে মরদ ।
[খানদানি কিসসা ৩য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
পুষ্প
ভদ্র মহোদয়গণ। আজ আমাদের পরিবারের এই আনন্দ মেলায় আপনাদের জানাই উষ্ণ অভিনন্দন। নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লালিত আমার কন্যা সুপ্রিয়া নুসরাত জাহানের আজ শুভ পরিণয়। পাত্র, জনাব কবি সৈয়দ আহাম্মদ, যার কবিতার ছন্দে ছন্দে বাঙালি সংস্কৃতি আর কৃষ্টির ছাপ। আমার মহান পিতা অসীম পবন ঘূর্ণি সোবহানের আদর্শে পরিচালিত হোক বর কনের নতুন জীবন।
সৈয়দ
আব্বাজান। আজিকের এই মহতি দিবসে আমি একগুচ্ছ কবিতা পাঠ করিয়া শোনাই।
পুষ্প
না। দরকার নাই।
সৈয়দ
কিন্তু আমি যে আমার ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ চিত্তকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারিতেছি না । আমার ধমনীর প্রতি কণা রক্তস্রোত উষ্ণ হইয়া সুদৃশ্য ফেনিল জলকণার মতো উপচাইয়া পড়িতেছে।
কাজী
নাউজুবিল্লা। বিয়ার দুলার এত কথা কওন ঠিক না।
পুষ্প
কাজী সাহেব, বিয়ের কাজ তাহলে শুরু করে দেয়া যায়?
কাজী
হ্যাঁ, যায়।
পুষ্প
কাবিননামা তৈরি করুন।
কাজী
আপনার নাম?
সৈয়দ
কবি সৈয়দ আহাম্মদ
কাজী
কবি-
সৈয়দ
কবি সৈয়দ আহাম্মদ ।
কাজী
কবি?
সৈয়দ
জি ।
কাজী
কবি কি আপনার পদবী?
সৈয়দ
অত শত কি আমি বুঝি? সোজা কথায় আমি কবিতা লিখি। আমার কবিতার প্রতিটি ছত্র, রমণী হৃদয়ের উষ্ণতার পরিমাপে মত্ত।
কাজী
আপনার মুখে এত বদ গন্ধ। দাঁত মাজেন না?
সৈয়দ
দখিনা বাতাস যখন বহে মৃদু মন্দ কি কোকিল কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু কুহু গায় কি – জানি কিসের লাগি।
কাজী
উহু। গন্ধ মাখা মুখে এত কথা হুনতে কি ভাল লাগে? আচ্ছা আচ্ছা। আপনার বাপের নাম।
[খানদানি কিসসা ৩য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
সৈয়দ
সদ্য অবসরপ্রাপ্ত নূর মোহাম্মদ।
কাজী
অবসরপ্রাপ্ত। কিসের থেইক্যা, আর্মি?
সৈয়দ
না। জীবন থেকে অবসরপ্রাপ্ত।
কাজী
জীবন থেকে অবসরপ্রাপ্ত। মানে?
সৈয়দ
মানে তিনি লোকান্তরিত।
কাজী
এত প্যাচান ক্যান? সোজা কইলেই তো হয়, মরহুম নূর মোহাম্মদ ।
(গান গেয়ে এজিদ ঢোকে। উপর থেকে নেমে আসছে একটি ফাঁসির দড়ি)।
এজিদ
হাসিমুখে ফাঁসি বরণ করিব আজি। অবহেলায় মৃত্যু নাই আমার মৃত্যু নাই। মৃত্যুকে আমি করিয়াছি জয় মৃত্যুঞ্জয়ী, তাই। আমার মৃত্যু নাই। আমি বেঁচে রবো মানুষের মাঝে মৃত্যুঞ্জয়ী। শত সহস্র প্রেমিকার মাঝে ।

নুসরাত
এজিদ। আমার এজিদ। বাপী বাপী, বাঁচান। এজিদকে বাঁচান। নুসরাত বিহনে সে রাখিবে না প্রাণ।
পুষ্প
হু, গণ্ডগোলটা তাহলে ঠিক ঠিক লাগিয়ে দিল।
নুসরাত
নেমে এসো এজিদ। নেমে এসো। ওহো হো ।
সৈয়দ
অত ব্যাকুল হইও না প্রিয়তমা। মনটাকে একটু শক্ত কর ।
(সবার অলক্ষ্যে সোনা মিয়া ঢোকে)
পুষ্প
প্রতিহারী । সর্বাত্মক প্রস্তুতি নাও। তিনশো বরকন্দাজ, পাঁচশো লাঠিয়াল সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বল। আমার নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে মরণ যুদ্ধে।
(খালেদ এবং হায়াতের প্রবেশ)
খালেদ
এজিদ । নাইমে আয়। ফাঁসি খাসনে বাপ। আমি তোরে কথা দিচ্ছি। আরো সুন্দর মেয়েছেইলে দেইখে তোরে বিয়ে দেবো।
পুষ্প
আজকেই মহাপ্রলয়। আমার কন্যার বিয়েতে ঝামেলা সৃষ্টি? সৌরত। আমার বন্দুক। ঐ বেজাতটাকে আমি গুলি করে হত্যা করবো।
এজিদ
গুলি করে ফাঁসির কেসের আসামী আপনাকে আমি হতে দেবো না শ্বশুর সাহেব। নুসরাতের বিবাহ কবুলের সাথে সাথে আমিও কুটুস করে শহীদ হয়ে যাবো।
[খানদানি কিসসা ৩য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
নুসরাত
ওহো হো হো।
সৈয়দ
কেঁদো না নুসরাত। কেঁদো না। প্রিয়জনের বিদায়ের মুহূর্তে চোখের জল ফেলো না প্ৰিয়া।
খালেদ
এজিদ। নামি আয় বাপ। নামি আয়। একজন খানদানি মানুষ আর কত অপমান সহ্য করতি পারে। নামি আয় বাপ। আমি কথা দিচ্ছি।
এজিদ
জগৎ সংসার দেখুক। তাবৎ প্রেমিককুল প্রত্যক্ষ করুক একজন আত্মত্যাগী মার্কসিস্ট প্রেমিকের বীর আত্মদান। দেখুক, কি করে একটি জ্বলন্ত সূর্য, খটাস করে পড়ে ফটাস করে নিভে গেল। আগামী পৃথিবীর ভালোবাসার ইতিহাসে, স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে একজন ত্যাগী, একজন যোগী, একজন সাধক, একজন মহান পরাক্রমশালী তাত্ত্বিক প্রেমতাপসের নাম।
এজিদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান, যার মহৎ অবিনশ্বর আত্মবিসর্জনকে কেন্দ্র করে রচিত হবে সহস্ৰ গীত । চারণ কবির ছন্দে। গাঁয়ের রাখালের কণ্ঠে। বীর গাথার হে মহানায়ক। তুমি অক্ষয়, তুমি দুর্জয় । লক্ষ কোটি নিপীড়িত নিষ্পেষিত জনতার পক্ষ থেকে তোমায় রক্তিম অভিনন্দন। (নিজের গলায় নিজে ফাঁসির দড়ি পরায়) বিদায় নুসরাত। বিদায়, আমি অপেক্ষা করছি তোমার কবুল বলার অপেক্ষায়।

নুসরাত
না, এজিদ না ।
পুষ্প
কাজী সাহেব। আর বিলম্ব করা যায় না।
নুসরাত
না।
পুষ্প
দ্রুত সম্পন্ন করুন শুভ বিবাহের কাজ।
কাজী
জনাবা কনে, আপনি এই বিবাহে রাজি?
নুসরাত
না, না, রাজি না।
কাজী
বলুন রাজি কি না?
এজিদ
নুসরাত, না বলো, না।
পুষ্প
বলো কন্যা, হ্যাঁ
এজিদ
ভয়ে আমার জিহ্বা শুকিয়ে যাচ্ছে। না বলো, না।
পুষ্প
নুসরাত, হ্যাঁ বলো, হ্যাঁ।
এজিদ
আক্রোশে আমার তলপেট মোচড় দিচ্ছে, খবরদার হ্যাঁ বলবে না।
পুষ্প
নুসরাত, বলো, হ্যাঁ।
এজিদ
দুই হাঁটু আমার ঠোকাঠুকি করছে, প্লিজ না বলো, না।
পুষ্প
মর শালা, মর তুই, মর না।
এজিদ
চেষ্টা কি আর করছি না? কিন্তু মরণ অত সহজ না।
কাজী
দুঃখিত, কাবিননামায় কনের নাম পাওয়া যাচ্ছে না।
পুষ্প
আহা হা, জলদি করেন জলদি।
[খানদানি কিসসা ৩য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
কাজী
কনের নাম?
পুষ্প
সুপ্রিয়া নুসরাত জাহান।
কাজী
বাপের নাম?
পুষ্প
জনাব আ. খ. ম. পুষ্প সোবহান
সোনা মিয়া
মিছা কথা, বাপের নাম পচা মিয়া। (গুঞ্জন উঠে)
পুষ্প
আরে কি সর্বনাশ! আপনি এখনো বেঁচে আছেন?
সোনা মিয়া
হ্যাঁ বেঁচে আছি। ঐ দিন দুই ভাইয়ে মিলে গলা টিপে ধরেছিলে আমারে। মরা মনে করি থুয়ে দিছিলে গজারির বনে; কিন্তু চাষা-ভুষোর জান তো সহজে যেতে চায় না।

পুষ্প
ভদ্রমহোদয়গণ । ইনি হচ্ছেন আমার সম্মানিত চাচাজান জনাব শুভ্র সুন্দর শুদ্ধ সোবহান।
সোনা মিয়া
এটাও মিছা কথা। আমার নাম সোনা মিয়া। এর নাম হচ্ছে গিয়ে ছক্কু মিয়া, আর এর নাম পচা মিয়া।
খালেদ
মিথ্যে কথা। আমার নাম খালেদ ইবনে সাখাওয়াত সোবহান।
সোনা মিয়া
ছকু মিয়া ওরফে সাখাওয়াত সোবহান।
পুষ্প
আমার নাম আ. খ. ম. পুষ্প সোবহান।
সোনা মিয়া
পচা মিয়া থিকা পুষ্প সোবহান।
খালেদ
আমার মহান পিতা জনাব খালেদ ইবনে গুয়াবাদ সোবহান।
সোনা মিয়া
গুয়াবত সোবহান না, গুঁড়া মিয়া।
পুষ্প
চোপ। আমার পিতা অসীম পবন ঘূর্ণি সোবহান।
সোনা মিয়া
ঘূর্ণি সোবহান। মানে ঐ একই নাম গুঁড়া মিয়া। আমি তার ভাই সোনা মিয়া, বিশ্বাস না হয় আপনারা চরগাও গ্রামে গিয়া খবর নিতে পারেন। হাতে হাতে পিরমান পাইবেন। (আরো গুঞ্জন বাড়ে)
সৈয়দ
কি সব ভয়ঙ্কর কথাবার্তা বলিতেছেন আপনি?
খালেদ
সুধীজনেরা, উনার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে।
সোনা মিয়া
না বাপ। মাথা আমার ঠিকই আছে।
সূত্রধর
আমি ঠিক বুঝতে পারতিছি না। কতিছিলাম খানদানি কিসসা। মাঝখান থিকা আপনি কোথা থেকে এসে-
সোনা মিয়া
কতিছি। সব কতিছি। আইজ থিকা বহু বছর আগে চরগাঁও গ্রামে জন্মে চাষা গুঁড়া মিয়ার দুই ছেলে—ছকু মিয়া আর পচা মিয়া গিরামে টাউটারি কইরা বেড়াইত। মামলা মোকদ্দমা, জাল দলিল, ধানী জমি দখলে দুই ভাই ছিল পরস্পর প্রতিদ্বন্দি। ঐ যে ৭১ সালে দেশে যুদ্ধ বাঁধলো, পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামকে গ্রাম জ্বালাইয়া দিলো।
ছকু মিয়া যোগ দিলো রাজাকার বাহিনীতে। এমন কোনো অপকর্ম নাই যা সে করে নাই। অবস্থা বেগতিক দেইখ্যা পচা মিয়া পালাইয়া গেল কলকাতায়। বুঝেনই তো কলকাতায় গেলেই তখন সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধা। আমরাও তাই জানতাম। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে গিয়ে যুদ্ধ তো দূরের কথা পচা মিয়া পাখি মারার বন্দুকও হাতে নেয় নাই ।
[খানদানি কিসসা ৩য় অঙ্ক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]
সূত্রধর
তারপর ?
সোনা মিয়া
তারপর আর কি, যথানিয়মে দেশখান স্বাধীন হইলো; তারপর বহুদিন দুই রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের কোনো খবর নাই। সবে জানলো দুই ভাই বিদেশে টাকা জমাচ্ছে। বহুত বছর পর এই তল্লাটে সংসার বাঁধে দুই ভাই। ছকু মিয়া হয় খালেদ ইবনে ছাখাওয়াত সোবহান, আর পচা মিয়া হয় আ.খ.ম. পুষ্প সোবহান। হেগোর বাপ গুঁড়া মিয়া জানেও না তার নাম হয়ে গেছে গুয়াবাদ সোবহান কিংবা ঘূর্ণি সোবহান। চরগাও গ্রামের জন্মচাষা গুঁড়া মিয়া এখনো গাংগের ভাঙ্গনের সাথে লড়াই কইরে বেইচে আছে।
খালেদ
সব মিথ্যে।
পুষ্প
সব বানোয়াট। (গুঞ্জন আরো বাড়ে)
সোনা মিয়া
আপনারা আরো পিরমান চান? তয় দুই ভাইয়ের শরীলের গন্ধ শুইকে দেখেন—এখনো পাইবেন লুনতা জল আর কাদামাটির গন্ধ।
সৈয়দ
(পুষ্পকে) আপনি একজন প্রতারক। আপনি আমার কুলনাশ করিয়া ছাড়িয়াছেন । বড়ই দাগা পাইলাম । ছি! ছি! ছি! আমি আপনাকে বিবাহ করার বাসনা পরিত্যাগ করিলাম ছি! ছি! ছি! (প্রস্থান)
সোনা মিয়া
আমি তোগের অনিষ্ট করতি চাইনি বাপ। ছেইলে মেয়ে দুটির কষ্ট দেইখে—থাইক। বেলা থাকতি থাকতি পথ ধরি। (প্রস্থান। এজিদ চলে যাচ্ছে)
সুত্রধর
কোথায় যাতি লেইগেছেন বিপ্লবী তাত্ত্বিক কাম প্রেমিক?
এজিদ
আমার বিদ্রোহী পৌরুষের আবিষ্কারে। চরগাওয়ের প্রতিকূল পরিবেশ সোঁদা মাটির গন্ধ নিয়ে অপেক্ষা করছেন আমাদের আদিপুরুষ গুঁড়া মিয়া। তার কাছে আমার অনেক কিসসা শুনতে হবে। মাটির মানুষের জীবন যুদ্ধের কিসসা।
সূত্রধর
খানদানি কিসসা আর জীবন যুদ্ধের কিস্সা। বিষয়টা মন্দ না। কি বলেন গো জনাবেরা ?
আরও দেখুন: