গনি মিয়া একদিন নাটক – এস এম সোলায়মান

গনি মিয়া একদিন নাটকটি নাট্যকার এস এম সোলায়মানের একটি বিখ্যাত নাটক। এই নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী ১৫ অক্টোবর ১৯৮৬ হয়েছিল। শেখ মোহাম্মদ সোলায়মান বা এস এম সোলায়মান একজন বাংলাদেশী অভিনেতা। তিনি ১৯৫৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মঞ্চ নাটক পরিচালনা করতেন এবং তাতে সঙ্গীত পরিচালনাও করতেন। তাকে বাংলাদেশের থিয়েটারের জগতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি।

গনি মিয়া একদিন নাটক - এস এম সোলায়মান

গনি মিয়া একদিন নাটক :  ১ম শ্লোক

প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক

প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা

কুশীলব

নিমাই :  জন মার্টিন

গনি মিয়া : এস এম সোলায়মান

মজনু : মিজান মুহাম্মদ শাহীন

নেয়ামত : মধু

শরাফত : নাদের চৌধুরী

শের আলী : মিজান

জামাত মোহাম্মদ: আশীষ খন্দকার

শমশের : আখতার

বারেক : মুকুল

ময়না : ফেরদৌসী হাবীব চিঠি

গয়না : মৌসুমী

জনৈক :  শাহ আলম কবীর, দেবাশীষ বড়ুয়া, শাহীন, মনসুর, দিলান,রিপন, জর্জ, বুলবুল

গয়নার বাপ : জহির আহমেদ

পিয়ন : শেখ শানে মাওলা

 কলাকুশলী

নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান

মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ

সহকারী : হাবিবুর রহমান, সুনীল বাবু

আলোক নিয়ন্ত্রণ :  কামরুল হাসান স্বপন

পোষাক ও পোস্টার ডিজাইন : অশোক কর্মকার

মঞ্চসামগ্রী :  মিজান

গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান

বটগাছ নির্মাণ : হাবিবুর রহমান

আলোকচিত্র : আমিনুর রহমান আজম

(সমস্ত মঞ্চ জুড়ে একটি বিশাল এবং অতি প্রাচীন বটবৃক্ষ, চতুর্দিকে বিস্তৃত শেকড় এক প্রশাখা। বটগাছের সামনে রাখা একটি লাশ। মনে হবে সদ্যমৃত এই লাশটিকে শেষ উপস্থিত করা হয়েছে । সাদা কাপড় ঢাকা লাশটির চতুর্দিকে কোরাস বসে আছে। ইন্সট্রু ভোকাল মিউজিকের সাথে সাথে কোরাসের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটছে। মঞ্চের এক পাশে পুঁথিয়াল মজনু পাগলা। তার হাতে বেশ বড় আকারের একটি – অংশে আলো জ্বলার সাথে সাথে পুঁথির প্রথম পৃষ্ঠায় ভেসে উঠবে প্রথম শ্লোক। শ্লোক-এর পর মঞ্চে ঢোকে একজন অশীতিপর বৃদ্ধ। নাম তার নিমাই। অনেক নিমাই এই গ্রামের বাসিন্দা। কিন্তু তার জন্মসূত্র সবারই কাছে বড্ডো রহস্যজনক। নিমা ঢুকেই শেষকৃত্যের জন্য প্রস্তুত লাশটার দিকে তাকায়। গভীর মমতায় স্পর্শ করে লা করে বিশ্রীভাবে হেসে খুব দ্রুত মঞ্চ থেকে পালিয়ে যায়।)

 

গনি মিয়া একদিন ১ম শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ১ম শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ১ম শ্লোক

(মানুষের জন্ম, বেঁচে থাকা, স্বাদ, আকাঙ্ক্ষার গগণচুম্বিতা)

মজনু 

(পুঁথি) শুরু করিলাম কিস্সা ইলাহি ভাবিয়া 

কিতাব মাফিক বলি শুন মন দিয়া 

মজনু হইল পাগল লাইলীর কারণ 

শিরী ছলে ফরহাদ হারাইল জীবন 

ইউসুফের রূপে মরে জ্যোলায়খা সুন্দরী 

জীবন করিলি শেষ কৈরে রোনাজারী 

প্রেমের আগুন প্রভু করিয়া রোশন 

তাহাতে করিল কত জীবকে দহন 

ভালোবেসে আদমেরে সৃজন করিলে 

যতনের সাথে তারে বেহেশতে রাখিলে 

ছলনায় দোষী কৈরে আদমের তরে 

কান্দাইলে তারে তিন শত সাল ধরে 

কেমতে সহিবে মানুষ এই জ্বালাতন 

বিচ্ছেদ অনলে তার জ্বলিছে জীবন 

অনলে জ্বলিয়া আদম নিয়াছে জনম 

কেমনে ঘটিল কিসসা বলে এ অধম

একদিন কহিল আল্লাহ জিবরীলের তরে 

এক মুঠি থাক আন আরশ কিনারে 

জিবরেলে ধরে থাক জোরেতে কষিয়া

লাচার হইয়া থাক উঠিল কান্দিয়া 

মাটির কান্দন শুনি জিবরিল আসিল ফিরিয়া 

আল্লাহ পাক মিকাইলে দিল পাঠাইয়া 

মিকাইল থাক ধরে টানিল যখন 

কান্দিয়া কহিল থাক কেন কর জ্বালাতন 

কান্দন শুনিয়া মিকাইল আসিল ফিরিয়া 

ইযরাইলে পাইয়া হুকুম চলিল কুদিয়া 

এমন জোরেতে ধরে না ছাড়িল তারে 

এক মুঠা থাক খেচে লইলেন জোরে 

আজাজিলের কাছে মাটি সোপর্দ করিল। 

হুকুম পাইয়া আজাজিল পুতলা বানাইল 

রুহ নিকালিয়া দিল পুতুলের ধড়ে 

সৃষ্টি হইল আদম জীবনের তরে।

 

 

অভিনেত্রী দেবযানী । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

(শেষ পঙ্ক্তিতে সাদা কাপড় ঢাকা মানুষটি নড়ে চড়ে উঠে দাঁড়ায়। তার বয়স প্রায় ৫৫-এর কাছাকাছি। মজনু পুঁথি শেষ করে গনি মিয়া মাস্টারের মুখোমুখি হয়।) 

[ গনি মিয়া একদিন ১ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]

মজনু

কেডা? কেডায় ঐ হানে? (একটু ভয় পেয়ে) আরে কথা কয় না। জিন্দা মুর্দার লাহান খাড়াইয়া আছে। ও বাই কেডা তুমি? মানুষের ছাওয়াল হইলে আওয়াজ দাও। নিশীথ রাইতে কি কাম? (অল্প একটু কোরান শরীফের আয়াত ভেসে আসে। মজুন ভয় পেয়ে চাপা চিৎকার করে উঠে। পালাতে চায়। পালাতে পারে না। কোরাসের আবহ তাকে সম্মোহিতের মতো ডাকতে থাকে। মজনু একেবারে গনি মিয়ার কাছাকাছি চলে গিয়ে চিৎকার করে উঠে) নিমাই কাহা।

গনি

না, আমি গনি মিয়া মাস্টার 

মজনু

ও! তুমি। এতো রাইতে?

গনি

রাইত তো শেষ । সকাল হইয়া আসে। (রহস্য করে)

মজনু

কিন্তু… (নীরবতা)

গনি

সব কিন্তুর জবাব হয় না মজনু (হাসি দিয়ে রহস্য)

মজনু

কিন্তু আপনি তো—

গনি

আহ্।

মজনু

ও।

গনি

যাও। নিজ কামে যাও।

মজনু

(স্বগত) সারা রাইত ঘুম হয় নাই। দুই চোখ খালি বুইজা আছে। বুঝছি, ও কিছু না মনের ভুল, যাই, বাড়িতে যাই।

(চলে যেতে উদ্যত, গনি মিয়া মজনুর ঘাড়ে হাত দেয়। মজনু ভয় পায়) ওহ্

 

 

দুলিয়া চলচ্চিত্র । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

গনি

হ্যাঁ। ঠাণ্ডাই, তোমার বগলে কি?

মজনু

পুঁথি।

গনি

বেহেশত না দোজখের?

মজনু

কোনোটাই না ।

গনি

চৌথা দরিয়া আর শারাবান তহুরার জায়গাটা ধর।

মজনু

ঐ পুঁথি আমি আর পড়ি না।

গনি

বিশ্বাস হয় না?

মজনু

(প্রবল আগ্রহে) আপনার হয়?

গনি

গেছিলা কই?

মজনু

তেলাপাড়া । পুঁথি পড়তে পড়তে কখন যে এত রাইত হইয়া গ্যাল, টেরই পাইলাম না। আর আইজকার রাইভটা যেন ক্যামন কালা মেঘের লাহান সুরত। আগে পিছে কিছুই দেহা যায় না।

[ গনি মিয়া একদিন ১ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]

গনি

আমি কিন্তু দেহি।

মজনু

কি দ্যাহেন।

গনি

তোমারে দেহি। 

মজনু

কি দ্যাহ মাস্টার?

গনি

আন্ধার দেহি। আন্ধারের গভীরে একটা মানুষ দেহি। নানান কিছিমের মানুষ। ছোড়, বড়, যোয়ান, আন্ধা, লুলা, নানান জাতের, দেহা যায় ছোঁয়া যায় না। ঠোট কাঁপে, কথা কয় না চক্ষে সুরমা, মুখে চন্দন। মানুষ তো নয় য্যান গাংগের ধারে অসংখ্য অগণিত সাদা কাশবন। আচমকা ফাল পাড়ে বুকের গহীনে মজনু।

 

google news logo

 

মজনু

অমন কইরা কি দ্যাখেন। মাস্টার। আমার ডর করে। (নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে) বুজছি, ও কিছু না, বাতাস শেষ রাইতের বাতাস। মাঝে মধ্যেই আহে। ডর দেহায়, কিছু না, কিছু না, যাই, বাড়ি যাই। (যেতে উদাত)

গনি

মজনু। মজনু ভাই।

মজনু

(ভয় পেয়ে) আমারে কন?

গনি

আজাবের গীতটা মনে আছে? দোজখের আজাব কি? কি। শেষ রাইতের বাতাস, এখন ডর করে না? মুখে কথা জোটে না?

মজনু

(আরো ভয় পেয়ে) মাস্টার। আমি বাড়ি যামু। 

গনি

বাড়ি যাবা? সারাবান তহুরা খাবা না?

মজনু

না।

গনি

দুধের সায়রা

মজনু

না । (গণি উত্তেজিতভাবে মজনুর দিকে এগোয়) 

গনি

বেহেশতি মেওয়া?

মজনু

না

গনি

বেহেশতি সুগন্ধি । শিরিন পিঠা, চৌথা দরিয়া।

মজনু

না

গনি

সাত আসমান, নরম মেওয়া?

মজনু

না মাস্টার না।

গনি

গোলাপ জলের সুবাস।

মজনু

না।

গনি

আতর লোবান কাঁচা মাটির গন্ধ।

মজনু

(প্রচণ্ড চিৎকারে) না । (চিৎকার করে মজনু বসে পড়ে। মজনুর অংশ অন্ধকার হয়ে যায়।)

 

গনি মিয়া একদিন নাটক :  ২য় শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ২য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান

 

প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক

প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা

কুশীলব

নিমাই :  জন মার্টিন

গনি মিয়া : এস এম সোলায়মান

মজনু : মিজান মুহাম্মদ শাহীন

নেয়ামত : মধু

শরাফত : নাদের চৌধুরী

শের আলী : মিজান

জামাত মোহাম্মদ: আশীষ খন্দকার

শমশের : আখতার

বারেক : মুকুল

ময়না : ফেরদৌসী হাবীব চিঠি

গয়না : মৌসুমী

জনৈক :  শাহ আলম কবীর, দেবাশীষ বড়ুয়া, শাহীন, মনসুর, দিলান,রিপন, জর্জ, বুলবুল

গয়নার বাপ : জহির আহমেদ

পিয়ন : শেখ শানে মাওলা

 কলাকুশলী

নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান

মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ

সহকারী : হাবিবুর রহমান, সুনীল বাবু

আলোক নিয়ন্ত্রণ :  কামরুল হাসান স্বপন

পোষাক ও পোস্টার ডিজাইন : অশোক কর্মকার

মঞ্চসামগ্রী :  মিজান

গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান

বটগাছ নির্মাণ : হাবিবুর রহমান

আলোকচিত্র : আমিনুর রহমান আজম

 

গনি মিয়া একদিন ২য় শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ২য় শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ২য় শ্লোক

(শিক্ষক সমাজ। মানুষ গড়ার কারিগর। মানুষ তৈরিতে তার আনন্দ, স্বপ্ন, অহঙ্কার। এক সময় কল্যাণের খোলস থেকে বের হয়ে আসে নিজের গগণচুম্বি আকাঙ্ক্ষা।) 

(কোরাস এগিয়ে আসে। গনি মিয়ার সাদা কাপড় খুলে গিয়ে মাস্টারের বেশ, পরিবেশ ক্রমান্বয়ে পাঠশালায় রূপ নেয়।)

কোরাস

 স্বপ্ন দেখে খোকা

আঙুর থোকা থোকা

ঊর্মিমালা দোলে

নীল সাগরের কোলে

ছয় ঋতু আসে

ফুলে ফুলে হাসে

স্বপ্ন দেখে খোকা

আঙুর থোকা থোকা

কোরাস-১

স্বপ্ন দেখে ছোট্ট খোকা ইঁদুর ছানা দুটি তাকের উপর খোয়াবনামা কাটছে ফুটি ফুটি

কোরাস-২

জুলেখা বাদশার মেয়ে। তাহার ভারী অহঙ্কার

কোরাস-৩

গনি মিয়া একজন শিক্ষক তাহার বাপ দাদা ছিল জমিদার।

কোরাস ৪ 

গনি মিয়া একজন কৃষক। নিজের জমি নাই। অন্যের জমি চাষ করে।

সবাই

 নিজের জমি নাই। অন্যের জমি চাষ করে।

কোরাস ৫ 

গনি মিয়া ঘটা করিয়া ছেলেকে বিবাহ করাইল। বহু ধুম ধাম করিল। ইহাতে তাহার প্রচুর টাকা কর্জ হইল । পরে ঋণের ভারে জর্জরিত গনি মিয়ার.. 

কোরাস ৬ 

পরে ঋণের ভারে জর্জরিত গণি মিয়ার সকল সুখ শান্তি নষ্ট হইয়া গেল। পরে গণি মিয়া একদিন….

কোরাস ৭ 

গনি মিয়া একজন কৃষক।

সবাই

গনি মিয়া একদিন

কোরাস-৮ 

গনি মিয়া একজন মজুর

সবাই

গনি মিয়া একদিন

কোরাস ৯ 

গনি মিয়া একজন ছাত্র

সবাই

গনি মিয়া একদিন।

কোরাস ১০ 

গনি মিয়া একজন কারিগর

সবাই

গনি মিয়া একদিন

কোরাস-১১ 

গনি মিয়া একজন সেবক

সবাই

গনি মিয়া একদিন

কোরাস-১২ 

গনি মিয়া একজন মানুষ

সবাই

গনি মিয়া একদিন

কোরাস-১৩ 

গনি মিয়া একজন শিক্ষক

সবাই

গনি মিয়া একদিন

(মজনুর অংশ আলোকিত হয়। মজনু উঠে দাঁড়ায়)

 

google news logo

 

[ গনি মিয়া একদিন ২য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]

মজনু

ধল পহরের আগে তিনি একদিন

খাঁচায় দিয়া হাত দ্যাখে একদিন

কাঁদিছে নোয়ারে মাথা পাখি সে অচিন

চক্ষের ভিতরে চেয়ে দ্যাখে একদিন 

মানুষ নয়তো যেন ভেসে যাওয়া তৃণ

গোগ্রাসে গিলে খায় নিজেরি জমিন

আশায় বসতি গড়ে ধু ধু বালিচিকা 

চারিধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।

 

(কোরাস বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে, মজনু চলে যায়। গনি মিয়ার হাতে স্কুলের হাজিরা খাতা, বেত, চক ইত্যাদি। গনি মিয়া ছাত্রদের নাম ডাকতে শুরু করে)

গনি

রোল নম্বর এক

কোরাস

উপস্থিত

গনি

রোল নম্বর দুই

কোরাস

উপস্থিত

গনি

রোল নম্বর তিন

কোরাস

উপস্থিত

গনি

রোল নম্বর চার

কোরাস

উপস্থিত

গনি

রোল নম্বর পাঁচ

কোরাস

 (নিরুত্তর)

গনি

রোল নম্বর পাঁচ

কোরাস

 (নিরুত্তর)

(ছাত্রদের কথাবার্তা গনি মিয়া হঠাৎ করে উদাস হয়ে যায়)

গনি

আমাদের আইজকের পড়া কি?

কোরাস

আমাদের বিদ্যালয়।

গনি

পড়।

কোরাস

আমাদের স্কুলের নাম আলামিয়া মডেল স্কুল। প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলী মিয়া। তিনি একজন বড় দানবীর ছিলেন।

কোরাস-১

তিনি একজন জমিদার ছিলেন।

গনি

হুন, এই আলামিয়া ছিলেন আমার দাদা। মাইনষ্যে বলতো বাঘা জমিদার। গোয়াল ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, সিন্ধুকের তাকে তাকে সোনাদানা, শত শত চাকর- বাকর। ছিল না কি? ছিল, বেবাক ছিল: সময়, কালে কালে কত কি বদলায়। রং বদলায়, মন বদলায় । আলামিয়া থেইক্যা গনি মিয়া বিরাট এক বদলের ইতিহাস।বাদ দাও, পড়। 

[ গনি মিয়া একদিন ২য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]

কোরাস

আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলীমিয়া।

কোরাস-১

 

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 কোরাস-২ 

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্তিলাভ করেন।

কোরাস-৩ 

যন্দিন তিনি বেঁচেছিলেন।

কোরাস ৪

 তিনি মরেছিলেন

 কোরাস ৫

তিনি ছিলেন সাহসী পুরুষ, আজীবন তিনি সত্যের সপক্ষে লড়াই করেছেন। 

 

 

দুলিয়া চলচ্চিত্র । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

কোরাস-৬ 

আজীবন তিনি মৃত্যুর সপক্ষে লড়াই করেছেন।

গনি

এক জনমের জীবন কতো উত্থান, কত পতন। এক বাঁক থেইক্যা আর এক বাঁক। বাঁকের পরে বাঁক। শুরু আছে শেষ নাই। হাসিতেও কান্দন। দুঃখেও কান্দন। কান্দনে কান্দনে সয়লাব হইয়া যায় জীবন।

(নিমাই হেঁটে যাচ্ছে) কেডা? নিমাই কাহা কই যান?

নিমাই

ঐখানে। (চলে যায়)

গনি

এই এক মানুষ। কালে কালে কত কিছু দেখলাম। গাংগের ভাঙ্গন দেখলাম, মরণও দেখলাম। কিন্তু এই একজন মানুষ যার কোনো পরিবর্তন দেখলাম না কি? তোমরা চুপ কেন? পড়।

কোৱাস

মানুষের জীবনের সব চেয়ে বড় সম্পদ তার চরিত্র। টাকা গেলে টাকা পাওয়া যায়, ভগ্ন স্বাস্থ্য সবল করা যায়। কিন্তু চরিত্র একবার নষ্ট হয়ে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না।

(গ্রামের চেয়ারম্যান এবং স্কুলের সেক্রেটারি নেয়ামত মণ্ডল ও প্রভাবশালী ব্যক্তি শের আলী ঢোকে)

নেয়ামত

কই, মাস্টার সাব কই?

গনি

আসসালামু আলাইকুম ।

নেয়ামত

ওয়ালাইকুম, ওয়ালাইকুম, তা ক্যামন চলছে স্কুল?

গনি

জ্বি। ভালো ।

নেয়ামত

সব ভালো যার শেষ ভালো তার কি কন শের আলী মিয়া । 

শের আলী

ভালো হইলেই ভালো। নাকি কন মাস্টার সাব।

গনি

আপনে আইজকে হঠাৎ

নেয়ামত

আইস্যা পড়লাম। আসলে সময়ও ঠিক পাই না। চাইর দিকে মেলা কাইজ কাম । তবু দায়িত্ব বলে কথা। সবাই বিশ্বাস কইরা স্কুলের সেক্রেটারির দায়িত্ব চাপাইয়া দিলো। নাও করতে পারি না, তা বাবাজিরা কেমন চলছে তোমাগো লেহাপড়া?

কোরাস

ভালো চলছে ইনশাআল্লা। 

নেয়ামত 

মাশাআল্লাহ। মাশাআল্লাহ। এক্কেরে বজ্রকণ্ঠের আওয়াজ।

শের আলী 

আওয়াজ তো নয় য্যান ঠাড়া পড়া বাজ। সাবাস বাবাজীরা সাবাস। (হাসি)

নেয়ামত 

মাস্টার সাব, এই শরাফতে নাকি ফেইল মারছে?

গনি

জ্বি, অঙ্ক আর ইতিহাসে বড় কাঁচা।

নেয়ামত 

তাতে কি, বাংলায় তো ভালো করছে। পোলাপান মানুষ কান্দাকাটি করে,প্রমোশনটা দিয়ে দিয়েন।

[ গনি মিয়া একদিন ২য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]

গনি

কামডা করা কি ঠিক অইবো?

নেয়ামত 

আর যেন কি কইতে আসছিলাম? ও হ্যাঁ। কাইলকে স্কুল বন্ধ।

গনি

কাইলকে স্কুল বন্ধ? আমি কিছু জানলাম না।

নেয়ামত 

(হেসে) এখন তো জানলেন। ঘটনা হচ্ছে গিয়া আগামী কাইল আমার ছোট মাইয়াডার আকিকা। বুঝেনইতো এখন ধান তোলনের মওসুম। বাড়িতে এত মেহমানের জায়গা কই, তাই চিন্তা কইরা দেখলাম, স্কুল ঘরেই কামডা সাইরা ফালাই। তো আপনিও আইস্যা চাইরডা খাইয়া যাইয়েন আর কি?

গনি

কিন্তু

নেয়ামত

কি?

গনি

না মানে, ঐ সামনের মাসেই আবার পোলাপানের পরীক্ষা, এই অবস্থায় স্কুল বন্ধ রাখনডা- 

নেয়ামত 

অসুবিধা একটু আধটু তো অইবোই। আর পোলাপান যে কি লেহাপড়া করে হেইডাতো আমি জানি। নইলে পাশের স্কুলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশের হার আর আমাগো স্কুলের পাশ

(বিরক্তি)

গনি

এইডা কিন্তু ভুল ধারণা। পাশের স্কুলের সাথে আমার স্কুলের তুলনা হয় না। আমি পোলাপানগোরে লেহাপড়া শিখাই। নকল শিখাই না। 

 

 

দুলিয়া চলচ্চিত্র । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

নেয়ামত

মাস্টার, আমি স্কুলের সেক্রেটারি। আমার ট্যাহায় এই স্কুল চলে। জানেনই তো আমার বাপদাদা জাত ব্যবসায়ী। আমি ব্যবসা বুঝি। ট্যাহা নিবেন আর পাশ শুইন্যা দিবেন । এইডা হইলো গিয়া কথা। স্কুলে মাস্টার রাখছি কিন্তু এইজন্য । 

গনি

মাপ করবেন। আপনার সাথে আমি একমত না। স্কুল জ্ঞানের জন্য। ব্যবসা অন্য জিনিস। আমার দাদা মরহুম আলামিয়া এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। জ্ঞানের জন্য-

নেয়ামত

দূর মিয়া, সব সময় খালি এক প্যাচাল, কবে কোন আমলে ঘি খাইছেন-এখনো তুড়ি শেষ হয় না । খাসিলতটা বদলান। দ্যাহেন গিয়া কত জমিদারের নাতি পুতি, চৌকিদার আর দফাদার হইয়া ফ্যা ফ্যা কইরা ঘুইরা বেড়াইতেছে। আমি লেহাপড়া করি নাই কিন্তু শিক্ষার মর্মটা বুঝি। আর বুঝি বইলাই দয়া কইরা আপনারে স্কুলের চাকরি দিছি ৷ কথা ভুইল্যা যাইবেন না। কি শের আলী মিয়া, যাইবেন না আছেন? 

শের আলী

আপনি যান। আমি আইতাছি। (নেয়ামতের প্রস্থান) তো বাবাজীরা। সেক্রেটারি সাব স্কুল পরিদর্শনে আইছিলেন। তোমাগোর লেহাপড়ার উন্নতি দেইখ্যা খুশি হইয়া স্কুল ছুটি দিয়া গ্যালেন। যাও, তোমরা বাড়ি যাও। খেলাধুলা কর। খেলাধুলা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। যাও বাবাজীরা, যাও, যাও (কোরাসের প্রস্থান) মাস্টার।

গনি

 জ্বি

শের আলী

 আমি জানি মনডা আপনার খারাপ। আমি এও জানি, আপনি এখন গনি মিয়া মাস্টার না, আল মিয়া, জমিদার। অন্য এক মানুষ। মাঠ ভর্তি আপনার সোনালী ফসল, শত শত কামলা ঠাডা ভাঙ্গা রোইদে মাঠে নিড়ানি দ্যায়। আপনি খালি দ্যাহেন, পাশে আপনার জমিদারির সরকার। বাম পাশে ছাতা ধইরা হাঁটে জমিদার বাড়ির খাস চাকর। ঠিক তার পিছনে রূপার গড়গড়ি হাতে হাঁটে আর এক নফর। খুশবুটা কিন্তু বড়ই চমৎকার। আপনি খালি দ্যাহেন। যতোদূর দৃষ্টি যায় চক্ষু মেইল্যা দ্যাহেন। মাঠ ভরা ফসল। পুকুর ভরা মাছ। বিশাল সুপারির বাগান। আরও দূরে ঐ যে দ্যাহা যায় আবছা কালো অন্ধকার, এটা সেই গজারীর বন। ঠিক কইছি না মাস্টার?

গনি

(সম্বিত ফিরে পায়) ঠাট্টা করলেন?

শের আলী

বুকের খাঁজে হাত দিয়া দ্যাহেন? বুঝবেন, ঠাট্টা করলাম না মনের কথাটা কইলাম । মাস্টার, আইজকে না হয় আপনের আর্থিক অবস্থা খারাপ, কিন্তু একদিন তো—

গনি

হ! বেবাক সময়ের ফারাক।

শের আলী 

সময় না, সময় না মাস্টার, হিসাবের ফারাক, আপনের দাদার ছোট্ট একখান ভুলে এতোবড় একটা একটা বনিয়াদি বংশ কি রকম চোখের সামনে ছারখার হইয়া গ্যাল।

[ গনি মিয়া একদিন ২য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান ]

গনি

বেবাক খোয়ারের মতন লাগে। এক এক সময় ইচ্ছা হয়—

শের আলী

জানি, এই নেয়ামত মণ্ডলের গুটির কাঁচা মাংস চিবাইয়া খান, আমিও তাই চাই মাস্টার। খালি আপনার একটু সহযোগিতা দরকার। ওর চেয়ারম্যানগিরি আমি ছুটাইয়া দিমু। সামনে ইলেকশান না? এইবার একটু শক্ত কইরা খাড়ান। ও হ্যাঁ। আসল খবরটাই আপনারে দিলাম না। শোনেন, চক্রান্ত চলতেছে। আপনার দাদার শেষ নিদর্শন-

গনি

কি?

শের আলী 

স্কুল, স্কুলের নাম পাল্টাইতে চায় নেয়ামত মণ্ডল। হাজী নেয়ামত মণ্ডল স্কুল।

গনি

ওহ্! (চাপা ক্রোধের চিৎকার বের হয়ে আসে)

শের আলী

চিন্তা কইরেন না মাস্টার, আমি যদ্দিন বাঁইচ্যা আছি, কামডা ততোটা সহজ না। কইলাম তো, সামনের ইলেকশানডা পার কইরা দেন। দ্যাখেন আমি কি করি তাইলে ঐ কথাই রইলো, এহন যাই। পরে আবার কথা বোলবনে। (প্রস্থান) 

গনি

মানুষের চেহারা দিন দিন ক্যামন বদলাইতেছে। এক মানুষের ভিতরে হাজার কিছিমের মানুষ। কারো লগে কারো মিল খায় না। থাকে তবুও থাকে মিলা মিইশ্যাই থাকে। (ধীরে ধীরে বটগাছের দিকে এগোয়, বিড়বিড় করে কথা বলে) পারতাম, পারতাম যদি একবার ওর কইলজ্যাটা হাতের মুঠায় নিয়া দোমড়াইয়া মোচড়াইয়া (হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়ে) না, কারে কি কই। হাছাই বুড়া অইয়া গেছি। এই বটগাছের লাহান বুড়া কথা কওনের শক্তিডা পর্যন্ত নাই। আলা মিয়া দশ গেরামের মাথা আলা মিয়া, তোমার নাতি গনি মিয়া। গনি মিয়া মাস্টার (নিজেকে নিয়ে হাসতে থাকে, মজনু ঢুকে)

মজনু

কি মাস্টার। অইলোডা কি তোমার মাস্টার, আরে ও মাস্টার

গনি

না, কিছু না। এমনি ।

মজনু 

কিছু একডা যে অইছে, সেতো দেইখ্যাই বুঝতেছি। কি, ব্যাপারডা কি?

গনি

মজনু’ হাছাই আমি বুড়া হইয়া গেছি, না?

মজনু

বয়স কতো তার হিসাব আছে?

গনি

কেডা? কেডা কয় বুড়া অইছি আমি? মজনু। হাতি মরলেও লাখ ট্যাকা দাম। আমিও আছি সময়ের অপেক্ষায়। ঐদিন আমি চিল্লান দিয়া জানাই দিমু, আমি আলা মিয়ার নাতি গনি মিয়া। জমিদারি রক্ত আমার শরীরের খাঁজে খাঁজে দশ গেরামের মাথা গনি মিয়ার অহনো কোমরে শক্তি আছে, কব্জিতে জোর আছে- 

মজনু

বেবাক আছে। খালি সাহসডা নাই। এরেই কয় খোয়াবের মানুষ। তাও আবার জাইগ্যা জাইগ্যা খোয়াব দেহে। মহাবীর হুঙ্কারে ফাটায়ে ফেলে গাঙ্গের দুই তীর। খোয়াব স্যাহে নিতা লড়াই করে। সাগর সাতরাইয়া হাঙ্গর জব্দ করে। আতকা কুত্তার আওয়াজ শুনি ফাল দিয়া পড়ে। সাগনো না, সোজা নিজের ঘরে। 

গনি

খোয়াব না খোয়াব না, হাছাই কই।

মজনু

কি কও।

 গনি

আহুক, ছাওয়ালডা খালি একবার পাশ দিয়া আহুক।

মজনু

কার কথা কও?

 

 

অনাদিনাথ বসু । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

গনি

কাসেম আলী। কাসু। আমার আশা, আমার শেষ ভরসা। শরীরের রক্ত পানি কইরা ঢাকায় রাইখ্যা পড়াইতেছি। খালি একবার ওকালতিড়া পাশ কইরা নিক। এতো সহজে ছাইড়া দিমু? আমি মামলা করুম। ঐ মণ্ডল বংশের ক্ষেমতা আমি দেইখ্যা নিম্ন। আমার বাপ দাদার হকের সম্পত্তি।

মজনু

অ’ তুমি কাসুর কথা কও?

গনি

হ হ

মজনু

মাস্টার! তুমিও যে একডা কি, আরে যে দিন-কাল পড়ছে, পোষা পাখি পোষ মানবার চায় না। তুমি বনের পাখি পোষ মানাইবা? (প্রস্থান)

গনি

আমি কারে কই, মনের কথাডা কার কাছে খুইল্যা কই। বেবাকই যদি খোয়াব তয় আশার জায়গাডা কই। বিশ্বাসের ভিত্তিডা কই। আর আশাই যদি না থাকলো তাইলে বাঁইচ্যা আছি কিসের জন্য। এই রকম ধুইক্যা ধুইক্যা মরতে তো আমার মন চায় না । এই সাধের মানব জীবনের প্রতি আমার তো বিতৃষ্ণা আসে না। আমি তো নিমাই কাহা না ।

যে প্রতি মুহূর্তে পরপারের ডাকের অপেক্ষায় কান খাড়া কইরা থাকুম আর বক বককুম বক বককুম কইয়া বলুম শুরু দিন তো গেল। আমি বাঁচতে চাই। আশায় বুক বাইন্ধ্যা খাড়া হইতে চাই। খোয়াবও দেখতে চাই সুন্দর জীবনের। আর চাই বইলাই আমার মন চায় ঐ তালগাছের সমান উচা হই। আলা মিয়ার লাহান দশ গেরামের মাথা হই। পাঁচ আঙ্গুল খুইল্যা আসমান থেইক্যা পূর্ণিমার চাঁদড়া খুইল্যা লই। কতো গল্পে কতো কিস্সা হুনছি মায়ের কাছে। আমার দাদা আলামিয়া ।

কোনো আদম সন্তানের সাধ্য ছিল না যার সামনে মাথা উঁচু কইরা খাড়ায়। বাঘে মোষে এক ঘাটে পানি খাইতো এমনি ছিল তার প্রতাপ। আর আমিও গনি মিয়া মাস্টার। ছাগল পিটাইয়া মানুষ করি। হ্যাঁ আমি। গনি মিয়া। নেয়ামত মণ্ডলের বেতনভুক্ত মাস্টার। ওয়াক, থুঃ। আমার মাথায় দিনভর আলা মিয়ার খোয়াব, ঐডাই আশা। ঐডাই হচ্ছে বাঁচা। আমারে বাঁচতে হবে। আমি বাঁচুম । এবং আলা মিয়া হইয়াই বাঁচুম। শত বৎসর, হাজার বৎসর-লক্ষ বছর।

 

গনি মিয়া একদিন নাটক :  ৩য় শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান
গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান

প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক

প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা

কুশীলব

নিমাই :  জন মার্টিন

গনি মিয়া : এস এম সোলায়মান

মজনু : মিজান মুহাম্মদ শাহীন

নেয়ামত : মধু

শরাফত : নাদের চৌধুরী

শের আলী : মিজান

জামাত মোহাম্মদ: আশীষ খন্দকার

শমশের : আখতার

বারেক : মুকুল

ময়না : ফেরদৌসী হাবীব চিঠি

গয়না : মৌসুমী

জনৈক :  শাহ আলম কবীর, দেবাশীষ বড়ুয়া, শাহীন, মনসুর, দিলান,রিপন, জর্জ, বুলবুল

গয়নার বাপ : জহির আহমেদ

পিয়ন : শেখ শানে মাওলা

 কলাকুশলী

নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান

মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ

সহকারী : হাবিবুর রহমান, সুনীল বাবু

আলোক নিয়ন্ত্রণ :  কামরুল হাসান স্বপন

পোষাক ও পোস্টার ডিজাইন : অশোক কর্মকার

মঞ্চসামগ্রী :  মিজান

গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান

বটগাছ নির্মাণ : হাবিবুর রহমান

আলোকচিত্র : আমিনুর রহমান আজম

 

গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক

(জামাত মোহাম্মদের অকপট স্বীকারোক্তি। নেয়ামত মণ্ডলের ভূড়িভোজন। গণি মিয়ার প্রতি তাচ্ছিলতা, মজনুর আবিষ্কার ) (নেয়ামত মণ্ডলের মেয়ের আকিকা উৎসব, উপস্থিত গ্রামবাসী, মজনু এবং নিমাই খুড়োর ভোজনের ওপর গান। গানটি সম্ভব হলে বিতর্কমূলক হবে)

গান

কোন পড়শীর বিলাই ডাকে ম্যাও ম্যাও 

নন্দা জামাইর মাছের মাথা কোন সাহসে খাও

নেয়ামত

তো মিয়ারা এই গিরামের গন্যি মান্যি মুরব্বিরা আমার ছোড মেয়ের আকিকায় আপনেরা মেহেরবানি কইরা আইছেন, চাইরডা ডাইল ভাত খাইছেন। খুব খুশি অইলাম। আইজকের এই দিনডা আপনার আমার অর্থাৎ আমাগো সবার জন্য অত্যন্ত খুশির দিন। কারণ প্রথম একজন জ্ঞানী গুণী সম্মানী মানুষের লগে আপনাগো পরিচয় করাইয়া দিমু যার নাম আপনারা হাজারবার হুনছেন।

কিন্তু দেখার সৌভাগ্য কোনোদিন অয় নাই। তিনি অইতেছেন গিয়া আমাদের এই গিরামেরই কৃতি সন্তান দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক জনাব জামাত মোহাম্মদ । (সবাই তালি দেয়) জামাত সাব বহু দিন গিরামে নাই। পরিবার পরিজন নিয়া শহরে আছেন।

[গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

গনি

আমাগো লেদা না?

মজনু

নেয়ামত

তো মিয়ারা, কথায় কয় আল্লায় দিলে কি না হয়? জামাত মোহাম্মদ সাব কত গন্যিমানি৷ মানুষ। দেশের মন্ত্রী গভর্নরের সাথে যার উঠতে বসতে দোস্তি, ভালো লাগে যখন ভাবি তিনি আমাদেরই লোক-

(কথার মাঝখানে জামাত মোহাম্মদ উঠে দাঁড়ায়)

জামাত

আসসালামু আলাইকুম প্রিয় গ্রামবাসী, আমি তোমাগোরি লোক। এই মোর পরিচয় হোক। গ্রামের টান বড় টান। সেই টানেই আসিয়া পৌঁছিলাম আপনাদের কাছে। বহুদিন ধরিয়া আমার দেশ সেবার ইচ্ছা জাগিয়া উঠিয়াছে ।

সবাই 

মাশ আল্লা মাশ আল্লা 

 

গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক

 

জামাত

তবে একটা কথা নিয়ামত মণ্ডল ঠিকই বলিয়াছেন। মন্ত্রী গভর্নরের সাথে আমার দোস্তি আছে। তবে এই দোস্তি সেই দোস্তি নয়। ইহা হইতেছে গিয়া টেকার দোস্তি। অর্থাৎ ক্যাশ টাকা গুনিয়া দিয়া মন্ত্রী বানাই। পরে ছোবড়া বানাইয়া ছাড়িয়া দিই। মন্ত্রী বানাইতে যেই টাকা ইনভেস্ট করি তাহার শতগুণ উসুল করিয়া লই।

শিক্ষিত লোকের ভাষায় ইহাকে মোস্ট প্রফিটেবল ডিগনিফাইড ব্যবসা বলে। কারেন্ট ব্যবসার জন্য সরকারি দলকে ট্যাকা দিয়া কিনি এবং ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া বিরোধী দলকেও বঞ্চিত করি না। আমি মোনায়েম খান, সবুর খান, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব, শেরে বাংলা, হাজী দানেশ, জুলফিকার আলী ভুট্টো গোলাম আজম সবার দলেই চাঁদা দিয়াছি এবং দিলের মখসুদ পূরণ করিয়াছি। আমার টাকায় প্রচুর টাউট বাটপার মানুষ হইয়াছে।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আসীন হইয়া দেশের খেদমত করিতেছে। তাহারা নিয়াছে আমি দিয়াছি। এখন তাহারা দিতেছে আমি নিতেছি। কিন্তু আমার দুঃখ, আমি এত কিছু করিয়াছি, এতো লোকরে মানুষ বানাইয়াছি কিন্তু নিজের গ্রামের জন্য কি করিয়াছি। বাংলাদেশ মানেই গ্রাম, আটষট্টি হাজার গ্রাম। আটষট্টি হাজার গ্রাম বাচিলে বাংলাদেশ বাঁচিবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি লোকজনরে মানুষ বানাবার প্রক্রিয়া ডিসেনট্রেলাইজ করিয়া গ্রামে ঠেলিয়া আনিব, আপনারা মানুষ হন।

সবাই

মারহাবা মারহাবা।

জামাত 

বহুদিন সরকারের বাহিরে থাকিয়া দেশের খেদমত করিয়াছি। তাই সরকারের ভিতরে ঢুকিয়া দেশের খেদমত করার মজা অনুধাবন করি নাই। ভিতরে ঢুকিতে হইলে প্রয়োজন ইলেকশান। আশা করি বুঝিয়াছেন আমার আগমনের উদ্দেশ্য।

মজনু

না, বুঝি নাই ৷

জামাত 

বোঝেন নাই? (নেয়ামতকে) আপনি বুঝিয়াছেন?

নেয়ামত 

(লজ্জা পেয়ে) জ্বি।

জামাত

(শের আলীকে) আপনি?

শের আলী

অবশ্যই।

জামাত

(মজনুকে) তফাৎটা বুঝিয়াছেন? উহাদিগকে মানুষ বানানো যাইবে। আপনাকে যাইবে না। তো যা হোক, সময় বড় সংক্ষিপ্ত। এখন হইতে মাঝে মাঝে আসিয়া আমি আপনাদের দেখিয়া যাইব। এখনকার মত বিদায় নিই। আবার দেখা হবে। খোদা হাফেজ। (চলে যেতে থাকে)

গনি

ভাই লেদা। আমারে চিনছ?

জামাত 

আমার নাম জামাত মোহাম্মদ।

গনি

আমি গনি মিয়া।

জামাত 

গনি মিয়া…..

গনি

গনি। গনি মিয়া। ভুইল্যা গেলা এত তাড়াতাড়ি? গিরামের সবাই আমারে আর তোমারে কইতো মানিক জোড়। শিকদার বাড়িতে ডাব চুরির কথা মনে আছে তোমার? কত দিন দুই জনে মিইল্যা এক লগে চুলাচুলি করছি, গাংগে ফাল পাড়ছি। এইবার নিশ্চয়ই সব মনে পড়ছে তোমার?

[গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

 

গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক

 

জামাত

হ্যাঁ

গনি

ছোড বেলায় একবার আমার অসুখ অইছিল। তোমার কান্দন হুইন্যা আল্লার কাছে মোনাজাত করছি-আল্লাহ আমারে নিয়ো না। ওর বড় কষ্ট অইবো। 

জামাত

হ! তো!

গনি

তুমি কিন্তু ভাই বয়সটারে ধইরা রাখছো আমার মতন বুড়া অইয়া যাও নাই। আইজ আল্লায় তোমারে কত বড় করছে। ভাবিজানের খবর কি? নিশ্চয়ই আমার বহু গপ্পো ভাবিজানেরে হুনাইছ? 

জামাত

হুঁ! তো? 

নেয়ামত

জামাত সাব চলেন। ট্রেইনের সময় কিন্তু অইয়া পড়লো। তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার।

জামাত

হুঁ। চলেন, তো আসি। সবাইকে খোদা হাফেজ।

(গনি মিয়া মুহূর্তে বিমর্ষ হয়ে যায়, লজ্জায় পালাবার চেষ্টা করে)।

নিমাই 

গনি, মাস্টার।

গনি 

হু

নিমাই

আমি কিন্তু দেখছি বাপ ।

গনি 

কি দেখছেন?

নিমাই 

ছোড বেলায় একবার গাংগের ধারে মারামারি করছিল না? (গনি নিরুত্তর) কি দিয়া করছিলি, হাত দিয়া, না? যুগ পাল্টাইছে, মাস্টার। শহুইরা মানুষ আর হাত দিয়া মারামারি করে না, বন্দুক দিয়া করে। তুইও যে একটা কি। এহনও মানুষ চিনলি না।

গনি

নিমাই কাহা, তোমার কথাডাই ঠিক, এই দুইন্যাডা বড় জটিল।

নিমাই

আখিরাতের কাম কর গনি, দুই দিনের দুনিয়া। আইজ আছি কাইল নাই। দুই চোখ বুজলে সব অন্ধকার । 

গনি 

আখিরাতে আমার কাম নাই কাহা । বর্তমানডাই আমার জন্যি ঠিক। এই জীবনের পরে কি হবে কি হবে না তা নিয়া আমার মাথা ব্যথা নাই।

নিমাই

বুঝবি, একদিন সবই বুঝবি। তিন কাল গিয়া শেষ কালে ঠেকছি। আর বাঁচতে মন চায় না। যার লগে জন্ম-জন্মান্তরের পীরিত, সেই মরণ রে ঠেকাবি ক্যামনে। তাইতো দুই চক্ষু মেইলা তার দর্শনের আশায় বইসা আছি। ডাকি আর ডাকি, কিন্তু সাড়া তো পাই না।

জনৈক-১

আরে ও নিমাই কাহা, এদিকে আসো। 

মজনু

আহ! নিমাই কাহা আহ, ধর একখানা গীত ধর

নিমাই

সেই দিন কি আর আছে রে মজনু। গায়ে গতরে শক্তি নাই, গলায়ও আগের মতো জোর পাই না।

মজনু

শরীর আপনার ভাংছে কাহা, কিন্তু গলার তেজ এহনো আগের মতোই আছে।

শমশের

কাহা, আপনার মনে আছে? জমিদার বাড়ির পালাগান গাইতে গিয়া কি ঘটনাটা ঘটছিল?

নিমাই

বেবাক মনে আছে রে! কত বছর অইয়া গ্যাল না? জমিদার সাবে বড় আদর করতেন আমারে। একদিনের গীত গাইতে গেছি, দুইদিন তিনদিন-চারদিনেও ছাড়ন পাই না । কইতো গা নিমাই, দিলটা খুইল্যা গা। আহা, কই গ্যাল সেই দিন।কই গ্যাল সেই মানুষ।

মজনু

ধরেন কাহা, গীতটা ধরেন।

বারেক 

না, চেয়ারম্যান সাব আহুক, বড়লোক মানুষ, আবার কি না কি মনে করে? 

নিমাই

এক জনমে কতো কিছু দ্যাখলাম, ইংরেজ দ্যাখলাম, জমিদার দ্যাখলাম, জিন্নাহ্ সাবরে দ্যাখলাম, শেখ মজিবরে দ্যাখলাম, ভেদ মগর কিছুই বুঝলাম না। 

 

গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক

 

গনি

জমিদার আমলের কথাগুলা কন নিমাই কাহা। হুনতে বড় ভালা লাগে।

শমশের

জিনিসপত্র নাকি পানির দামে বেচাকেনা হইতো? না কাহা?

নিমাই 

হু। পাঁচ ট্যাকা মনেও চাউল কিনছি, ১ ট্যাহায় কিনছি ২০টা আভা।

গনি

জমিদার সাবের কথা কন নিমাই কাহা ।

নিমাই 

দাদার কথা হুনতে বড্ড মন চায়, না? আমার বয়স তহন আঠার। আমার এক কাহা বড় গরিব, তিন সালের খাজনা বাকি। জমিদার সাব ছিলেন খুব রাগী আবার বড় আমুদে মানুষ। কাহা খাজনা দিতে পারে না। জমিদারের পাইক পিয়াদা কাহারে ধইরা আনলো। খবর হুইন্যা ছুইট্যা গেলাম জমিদারের কাছারিতে। আমারে দেইখ্যাই জমিদার সাব এক গাল হাইস্যা কন—বুঝেছি কি মতলবে আইছস। ঐ রইশ্যার নিমাইর কাহারে আন। জমিদার সাথে কন— নিমাই একখান গীত গা, তারপর তোর কাহারে লইয়া বাড়িতে যা। কাহার পিঠ বাইয়া চুইয়া চুইয়া রক্ত পড়ে আর আমি গীত গাই। একখান না পরপর পাঁচখান। গান বড় ভালোবাসতেন কি না? কি যেন ছিল গীতটা? না, মনে নাই।

[গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

বারেক

আপনার কাহারে ছাড়ছিল?

নিমাই

ছাড়ছিলেন, জবান রাখছিলেন, তবে ঐ শেষ। সেই যে কাহা বাড়ি গিয়া বিছানায় পড়লো আর উঠলো না। (শের আলী ঢোকে) 

শের আলী

কি বেবাকে চুপচাপ, গান বাজনা কই।

শমশের

চেয়ারম্যান সাবে কই? 

শের আলী

আরে, হের কি কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে? শুরু করেন ।

মজনু

কাহা, ধরেন, শুরু করেন।

নিমাই

না, তুই শুরু কর।

মজনু

আপনি মুরব্বি মানুষ কাহা। ওস্তাদের ওস্তাদ। আপনের আগে গামু আমি? না না,এইডা হয় না।

গনি

ধরেন, নিমাই কাহা আগে।

নিমাই

গুরু দিন তো গ্যাল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে 

তুমি পারের কর্তা শুনি হে বার্তা তাই ডাকি তোমারে

আমি আগে এসে ঘাটে রইলাম বসে 

ওহে আমার কি পার করবে না হে

আমি অধম বলে

যারা পাছে এলো আগে গেল 

আমি রইলাম পড়ে

শের আলী

কাহা। কি শুরু করলেন কন তো? এই আনন্দ উৎসবের দিনে ঐ সব মরণ ফরনের শীত কি ভালো লাগে? একটা সময়-অসময় আছে না?

নিমাই

বাজান, কোনডা যে সময় আর কোনডা যে অসময়, হে যদি মানুষ জানতো? 

বারেক

একখান পীরিতের গীত গান কাহা ।

নিমাই

পীরিতের গীত। ভাল একখান কথা কইছ। শৈশবে মায়ের লগে ছেলের পীরিত। যৌবনে বউয়ের লগে স্বামীর পীরিত। বুড়াকালে মরণের লগে বুড়ার পীরিত। তা বাজান, ঘটনা কি কি দাঁড়াইল। জন্ম থেইক্যা শেষ দিন পর্যন্ত পীরিত কিন্তু একজনের লগে। যতোই না না কর, তার বুকে ঝাঁপ দেওনই লাগবো। যেইদিন জন্মাইছি হেই দিন থেইক্যা কাঠালের আঠা লাইগাই আছে। যার লগে আমার জন্ম- জন্মান্তরের পীরিত— সেই মরণ তারে ভুলি ক্যামনে বাজান?

শের আলী 

ধুর ধুর ধুর। দিলেন তো পুরা দিনটাই মাটি কইর্যা। বুড়া মানুষ কিছু কইনা দেইখ্যা লাট পাইয়া গ্যালেন। কেডায় কইছিল আপনারে এইখানে আইতে। চব্বিশটা ঘণ্টা খালি ঠক-ঠকর আর যত আজাইরা প্যাচাল।

নিমাই 

বাদ দাও। বাপ। আমারি ভুল। উৎসব তো বুড়া মানুষ কি বইলতে কি বলি ।

শের আলী 

ঠিক আছে। যান যান ।

নিমাই 

যাই। বাজান, (দ্রুত পালাবার চেষ্টা।)

গনি

দাঁড়ান কাহা। আমিও যামু। কাজটা কিন্তু ভাল করলেন না শের আলী খান। বুড়া মানুষ। বয়সে আপনের কাকার বয়সী।

নিমাই

বাদ দাও আমার কথা। মজনু, ধর। 

শমশের 

পীরিতের গান। মজনু ভাই ।

মজনু

কাহা, গামু?

নিমাই

গা।

মজনু 

আইচ্ছা! গেন্দু চান্দুর কিসসা হুনছ?

শের আলী

তুমি শুরু কর না। 

মজনু

গেন্দু আর চান্দু নামে দুই ভাই আছিল। মহাজনের জমিতে কামলা খাটতো দুই ভাই। সেই ফসল কাটনের মওসুমে তিন নদী আর এক দইরা পার হইয়া উত্তর চকে যাইতো ধান কাটতে। গেন্দুর আছিল দুধে আলতা রংয়ের সুন্দর একখান বউ।

বাকের

কিসসা না গীত মিয়া?

মজনু

গীতই গাইতাছি মিয়া, পীরিতের গীত, গেন্দুর বউয়ের পীরিতে পড়ছিল মহাজন।

নিমাই

মজনু, পড়ছে। এইবার মনে পড়ছে।

মজনু

কি কাহা?

নিমাই

কত বছর, ৩০? 80? ৫০? কাহার পিঠ বাইয়া দরদর কইরা রক্ত ঝরে আর আমি জমিদার সাবের সামনে বইসা গীত গাই। গেন্দুর বউ আর মহাজনের পীরিতের গীত। আমার দাদা ছিলেন বড় গায়েন। তার দাদার দাদা নাকি এই গীত বানছিলেন। কত বছর আগের কথা? ২০০ ৩০০? সেই মানুষ গুলান নাই। কিন্তু গীতটা আছে। সেই কবে তেনারা এই গীত গাইছেন। আইজ কতো বছর পরে মজনুও সেই গীত গায়। এই জীবন বড়ো রহস্যের, বাজান। গা

 

google news logo

 

 

(গনি মিয়ার মেয়ে ময়না ঢোকে, খুব উচ্ছল স্বভাব ময়নার) 

ময়না

বাজান ও বাজান, তুমি এখানে? আর আমি তোমারে গোটা গেরাম তালাশ কইরা বেড়াই ।

গনি

আয় মা বয়।

ময়না

না না, বসুম না। বাড়ি যামু। ক্যামন আছেন নিমাই দাদা? 

নিমাই

আমার আর ভালো খারাপরে বইন।

ময়না

বাজানের কাণ্ডটা দ্যাহ দাদা। হ্যায় আমারে একলা ঘরে থুইয়া বাইরে টো টো কইরা ঘুইরা বেড়ায়। আমার বুঝি একা একা ঘরে ডর করে না?

[গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

নিমাই

কি গনি, কি কয় ময়না? 

গনি

কাহা। যাই, মজনু গেলাম, ল মা যাই।

(গনি ও ময়না যাচ্ছে)

শের আলী 

মাস্টার, কথা আছে। একবার আইসেন।

গনি

আইচ্ছা?

শমশের 

মজনু ভাই, শুরু কর।

মজনু

হ। ওরে উত্তর চকে হইছেরে ধান

গেন্দু গ্যাছে ধান কাটিতে গো মনরে

গেন্দুর বউয়ে কাইন্দা কাইন্দা কয় | 

কি করে দেখামু মুখ প্রাণের পতিরে।

ময়না

আহারে! আইচ্ছা বাজান। বিয়ার দিন মাইয়াগোর রং সোন্দর লাগে, তাই না?

গনি

 হুঁ। ক্যান মা?

মজনু

ঐ যে, দক্ষিণ পাড়ায় মরিয়ম বু, হের না, আইজকে বিয়া। ওর জামাইর গুষ্টিটা আস্ত বেক্কল। বিয়ার মাইয়ারে কেউ কালো শাড়ি দিয়া সাজায় ? কও, অমন টকটইক্যা কাঁচা হলুদের মতো রং মরিয়ম বুর, রংটা মাইর খাইয়া গেল না?

গনি

 হুঁ।

মজনু

ওরে মহাজনের কুকীর্তিতে গেন্দুর বউয়ে

সতীত্ব হারাইলো মনরে

গেন্দুর বউয়ে কাইন্দা কাইন্দা কয়

কি করে দেখামু মুখ প্রাণের পতিরে।

সবাই

আহা-হায়।

গনি

তোরে একডা কথা জিগাই মা?

ময়না

বল

গনি

কাসুরে তোর পছন্দ হয়?

ময়না

যাও বাজান, তুমি খালি মস্‌করা কর ।

গনি

মসৃকরা নারে পাগলী। খোয়াবও না। এইডা আমার জিদ। এইডা আমার বিশ্বাস। ছাওয়ালডা খালি একবার পাশ দিয়া আহুক কাসু, কাসুইডা, আমার নিজের হাতে গড়া ছাওয়াল। মারে, অঙ্ক যদি এইবার মিইলা যায়, তয় আমি- 

ময়না

কোনা বাড়ির জমিলার কথা তোমার মনে আছে, বাজান?

গনি

ক্যান। কি হইছে জমিলার ?

ময়না 

আইজ দুপুরে আমি আর ময়না গেছিলাম গাংগের পাড়ে। দেখি কি ডিংগি খুনে একডা মাইয়া নামলো, বয়স তার কতো অইবো ঐ আমার মতো। আহারে কি কান্দন। কাছে যাইয়া দেখি, আমাগো জমিলা। জিগাইলাম, কিরে জমিলা কান্দস ক্যান? কয়, দুই বছরের ছাওয়ালডারে রাইখ্যা সোয়ামি হেরে খেদাইয়া দিছে। পোলার কথা কয় আর কান্দে। মায়ের পরান তো।

মজনু

ওরে গেন্দু চান্দু দুইভাই 

গতরের ঘাম ঝরাইয়া ফসল ফলায়

চান্দু ডাকি কহে সোদ্দর ভাই

মহাজনের গোলায় ক্যান মোর ঘামের ঘেরান পাই 

আর গেন্দু বসি দ্যাখে উত্তর চকে

সোনার পোতলা কান্দে চাইয়া পথে আশে 

ব্যাকুল দুইখান নয়ন ভাসে বাঁশ বাগানের ফাঁকে

ময়না

আচ্ছা বাজান, তোমার দাদায় তো খুব বড়লোক আছিল। তয় আমরা এত গরিব অইলাম ক্যান?

গনি

গরিব! কেডা গরিব। কেডায় কয় গরিব? সামনে পিছে ডাইনে বায়ে চক্ষু ঘুরাইয়া দ্যাখ। যদ্দুর দৃষ্টি যায় বেবাক তল্লাটের মালিক ছিল আমার দাদা আলা মিয়া। ঐ যে দ্যাখ, ঐ দক্ষিণ পশ্চিম কোনে ধুয়া উঠে—

ময়না

এইডা তো নিয়ামত মণ্ডলের ইটাখোলা।

গনি

ঐটা ছিল আমার বাপ দাদার বাগিচা। জমিদারির তহন পড়ন্ত সময়। একবার কি এক ঠেকায় পইড়া জমিদার আলা মিয়া বাগিচা বন্ধক রাখে মণ্ডলগো কাছে। মণ্ডলরা করতো সুদের কারবার। সেই শুরু, বাগিচা গেল বাগান বাড়ি গ্যাল, বাপের নির্বুদ্ধিতে বাদবাকি জমিজমা জাল দলিলের কবলে পড়লো। নইলে আজকে আর কয়টা দিন মা। সময় আমার আগাইয়া আইতেছে। কাসুর লগে তোর বিয়াটা দিয়া লই। আমিও আলা মিয়ার নাতি গনি মিয়া, মণ্ডল বাড়ির ক্ষেমতা-

ময়না

বাজান, তোমারে না কদ্দিন কইছি? এই সব কথা নিয়া বেশি নাড়াচাড়া কইরো না, অত আশা করা কিন্তু ভালা না।

 

গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৩য় শ্লোক

 

গনি

ঐ ইটখোলার আগুন আর আমার অন্তরের আগুন এক সুতায় গাঁথা মা। এর শেষটা আমারে দেখতেই অইবো। ট্যাকা ছাড়া কি আছে নিয়ামত মণ্ডলের? ওর কত বড় বুকের পাটা যে দাদার স্কুলের নাম পাল্টাইয়া নিজের নামে রাখতে চায়। এইডা খালি আশা না ময়না এইডা বিশ্বাস। এইডার নাম হচ্ছে গিয়া লড়াই। বেনিয়ার রক্তের সঙ্গে জমিদার এর রক্তের লড়াই। ল, বাড়িত যাই। (দু’জনেই চলে যায়)

মজনু

স্বপন ভাঙ্গে নিশীথ রাইতে

পোষা পাখি উইড়া গ্যাছে অচিন এক দ্যাশে 

গেন্দুর বউয়ে কাইন্দা কাইন্দা কয়

সতীত্ব হারাইছি যহন আর সোয়ামীর ঘর নয় 

ওরে মহাজনের কুকীর্তিতে গেন্দুর বউয়ে

সতীত্ব হারাইলো মনরে

গেন্দুর বউয়ে কাইন্দা কাইন্দা কয়

কি করে দেখাইমু মুখ প্রাণের পতিরে। 

দূর ছাই। ভাল্লাগেনা, সর্বখানে এক প্যাচাল।

নিমাই

ভালাই তো গাইতেছিলি মজনু, শ্যাষ করলি ক্যান।

মজনু

না কাহা, মনডা জানি ক্যামুন কইরা উঠলো।

শের আলী

তুমি পুঁথি ধর মজনু।

মজনু 

না থাক।

শের আলী

আরে থাকলে চলবো না, ধর। 

বারেক

আল্লার নাম নিয়া ধর মজনু।

শমশের

তুমি কেয়ামতের জায়গাটা ধর।

মজনু

কি কাহা, ধরুম?

নিমাই

ধর

 

 

 

গনি মিয়া একদিন নাটক :  ৪র্থ শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান
গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান
প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক

প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা

কুশীলব

নিমাই :  জন মার্টিন

গনি মিয়া : এস এম সোলায়মান

মজনু : মিজান মুহাম্মদ শাহীন

নেয়ামত : মধু

শরাফত : নাদের চৌধুরী

শের আলী : মিজান

জামাত মোহাম্মদ: আশীষ খন্দকার

শমশের : আখতার

বারেক : মুকুল

ময়না : ফেরদৌসী হাবীব চিঠি

গয়না : মৌসুমী

জনৈক :  শাহ আলম কবীর, দেবাশীষ বড়ুয়া, শাহীন, মনসুর, দিলান,রিপন, জর্জ, বুলবুল

গয়নার বাপ : জহির আহমেদ

পিয়ন : শেখ শানে মাওলা

 কলাকুশলী

নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান

মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ

সহকারী : হাবিবুর রহমান, সুনীল বাবু

আলোক নিয়ন্ত্রণ :  কামরুল হাসান স্বপন

পোষাক ও পোস্টার ডিজাইন : অশোক কর্মকার

মঞ্চসামগ্রী :  মিজান

গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান

বটগাছ নির্মাণ : হাবিবুর রহমান

আলোকচিত্র : আমিনুর রহমান আজম

 

 

গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক

 

মজনু

আসমানের তারা সব খসিয়া পড়িবে

পাহাড় পর্বত যত তুফানে উড়িবে

হাকিম অবিচারী হবে মুলুকেতে 

গরীব দেখে কথা না কহিবে তার সাথে 

দজ্জাল পৌঁছিল আসি দুনিয়া মাঝার

তাহার জুলুমে মান রাখা হবে ভার 

দুনিয়ার যত ধন উদরে পুরিবে 

ধান গেহ মাছ ফসল কিছু না রহিবে 

ফুল ফল যাবতীয় সকলি খাইবে

বাঁচিবার আশা আর কারও না রহিবে 

এরপর আরো কিছু দিন বাদ রোজ

হাজির হইবে আসি ইয়াজুজ মাজুজ।

(শেষ পঙ্ক্তিতে নিয়ামত এবং তার ছেলে ঢোকে, শরাফত কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ থেমে পড়ে)

নেয়ামত

কি বাবা শরাফত, অইলোডা কি আপনার?

শরাফত

কাঁটা। 

নেয়ামত 

এ্যা। কাঁটা। কোন জায়গায় কোন জায়গায়

শরাফত

পায়ে। 

নেয়ামত 

কাঁটা বিধলো পায়ে। লক্ষণ তো বড় সুবিধার ঠেকে না।

শরাফত

বাইর করছি।

নেয়ামত 

করছো? শোকর আলহামদুলিল্লাহ। তো বাজান, আজ আপনারে এই জায়গায় নিয়া আসছি ক্যান, জানেন? বোধ অয় জানেন না। বয়স তো আমার কম অইল না। আল্লায় না করুক, কাইল যদি আমার কিছু একটা হয় তাইলে এত বিষয়-সম্পত্তি দেখবে কেড়া। তো বাবা শরাফত

[গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

শরাফত

বলেন আব্বা।

নেয়ামত 

একড়া কথা সব সময় খেয়াল রাখবেন – বিষয় সম্পত্তি অর্জন করাই বড় কথা নয়। – উহা রক্ষা করাটাই হইল গিয়া আসল। আপনেরে বলতে তো শরমের কিছু নাই। ঐ যে ইটাখোলা, দক্ষিণের সুপারি বাগান, শেষ সীমানার শর্ষা ক্ষেত – এর কোনটাই মার হক্কের না । এইগুলা পাইতে গিয়া বহু ভিটায় আগুন দিতে অইছে । আমারে, আমার বাপ দাদারে। মাঝে মাঝে ভাবি, এই যে এতো বিষয় সম্পত্তি, এতো মানুষের কান্দন, এতো পাপ-কি লাভ। তো কথা হইল গিয়া এই গুলা রক্ষা করন লাগবে দয়া মায়া মনে ঠাঁই দিছেন তো গ্যাছেন। শ্যাষ। দেখবেন, চোক্ষের সামনে সব ধুলিস্যাৎ অইয়া গ্যাছে।

শরাফত

আব্বাজান, সব আমার ওপর ছাইড়া দ্যান। চিন্তা কইরেন না।

নেয়ামত 

চিন্তা কি খামোকা করি রে বেক্কল আপনের যা মতি গতি আমার এত কষ্টের সম্পত্তি। আল্লায় নি মাফ করে আমারে। সম্পত্তি তো নারে বাজান। মনে অয় ঠাণ্ডা এক কালসাপ সারা শরীর আঁকড়াইয়া আছে। ছাড়তেও পারি না, খালি খালি লাগে। রাখতেও পারি না, খোঁচা লাগে।কি য্যান বইলতেছিলাম? ও হ্যাঁ, আপনের মতিগতি। শক্ত হন। সামনে আমার চেয়ারম্যানি ইলেকশান।

 

গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক

 

শরাফত

আপনি তো জিতত্যাই আছেন।

নেয়ামত 

জিইত্যা আছি। ক্যামনে বাজান? 

শরাফত

ভোটের আগের দিন শেষবারের মতন বেকতের বাড়ি বাড়ি যামু। জিগামু ভোট কারে দিবা। আমারে দেখলে তো বেকতেই কইবো আপনারে দিবো। ব্যাস। মামলা খতম। আপনাগো ভোট বুঝিয়া পাইলাম। সেন্টারে যাওনে আপনাগো কোনো কাম নাই। আর সেন্টার যদি খালি থাকে তো-

নেয়ামত

মাশাআল্লা। মাশাআল্লা আল্লায় বাঁচাইয়া রাখুক আপনেরে সত্যি কথা বলতে কি বাজান, আপনি পাশে থাকলে কোমরের জোর আমার বাইড়া যায়। বয়স হইছে। কত কথা মনে আসে। মনের জোর কইমা আসে।

শরাফত

গেরামে একডা কানাঘুষা হুনলাম বাজান।

নেয়ামত

কি

শরাফত

শের আলী আর মাস্টারও এবার ক্যান্ডিডেট হইতে পারে।

নেয়ামত

শের আলী অইতে পারে। মাস্টার অয় ক্যামনে। তার আছেড়া কি? থাকনের মধ্যে ঐ স্কুলের চাকরি। সেইটাও আমার হাতের মুঠোয়।

শরাফত

মানুষড়া কিন্তু খারাপ না বাজান। দেখলেই ভক্তি শ্রদ্ধা লাগে। একড়া কথা মাস্টার সাব প্রায়ই কন, জগৎরে ফাঁকি দিতে চাও দাও। কিন্তু নিজেরে ফাঁকি দিওনা। কথাটা মনে আমার গাঁইথা গ্যাছে, তাই যহন ভাবি-

নেয়ামত

বাবা শরাফত। বয়স আপনের অনেক কম। এই বয়সে মনে দুর্বলতা আসা খারাপ লক্ষণ। আপনি মাস্টারের লগে বেশি মেলামিশা করবেন না।

শরাফত

ক্যান বাজান?

নেয়ামত

হাতি প্যাকে পড়নের কষ্টটা আমি বুঝি। এই লোক ভাঙ্গে কিন্তু মচকায় না, ভয়টা আমার ঐখানে। জানি, গেরামের মানুষ তারে ভক্তি শ্রদ্ধা করে। আমি করি না কারণ আমি জানি, আমি কোনোদিন গনি মিয়া মাস্টার হইতে পারুম না। সেও আমারে পছন্দ করে না, কারণ হাজার চেষ্টা করলেও সে কোনোদিন নেয়ামত মণ্ডলের মতো হইতে পারবে না। এইডাই অইল গিয়া শেষ কথা। চলেন। আপনারে সুপারীর বাগানটা দেখাইয়া আনি।

(প্রস্থান, অন্যদিক থেকে ময়না ও গয়নার প্রবেশ)

ময়না

(গুনগুন করে) কোনদিন আসিবেন বন্ধু

কইয়া যাও কইয়া যাওরে।

(মজনু ঢোকে। ময়না তার সাথে ধাক্কা খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়।)

মজনু

কিরে? তোর আবার হইলোডা কি? খালি টককা ফড়িং এর মতন ফাল পাড়ছ। 

ময়না

কই, আমি তো—

মজনু

আরে ছেমরি, আমার চোখেরে ফাঁকি দিয়া ফুলের উপর ভোমরা বইবার পারে না। তুই আমারে ফাঁকি দিবি?

ময়না

দূর। তুমি যে কি কও না কও মজনু ভাই ।

মজনু

আইবো, আইবো, গাছের ডগায় একটু বিলাতি বাতাস লাগছে তো? হের লাইগ্যাই নড়নচড়নটা একটু বেশি। এক্কেরে শক্ত কইরা ধর। নানান কিছিমের বাতাস। 

[গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

(প্রস্থান)

ময়না

মজনু ভাইটা যে কি?

গয়না

আস্তা পাগল একটা—

ময়না

পাগল। তয় হুঁশের পাগল। ঠিক জায়গা মতন গিয়া ধরে।

গয়না

বাদ দে, অহন ক

ময়না

কি কমু?

গয়না

আইবো কখন।

ময়না

কেডায়?

গয়না

উহ্! কেডায় আবার। কাসু।

ময়না

কি জানি। বাজান তো কয় সামনের গরমের বন্ধে ।

 

গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক

 

গয়না

ময়না-

ময়না

হু

গয়না

তুই কি ঢাকা শহরেই চইল্যা যাবি?

ময়না

বোধঅয়, অবশ্য মাঝে মইধ্যে গ্রামেও আহুম।

গয়না

কইলজাটা মাঝে মইধ্যে ছ্যাঁত কইরা উঠে।

ময়না

ক্যান?

গয়না

কই ঢাকা শহর। আর কই এই গাঁও গিরাম । 

ময়না

দূর পাগল, হুন, মাঝে মইধ্যে তোরে নাইয়োর দিয়া যামু না?

গয়না

হাছাই?

ময়না

ওমা! তুই মনেটা করছোস কি? ভাবছস, ঢাকা শহরে যাইয়া তোরে ভুইল্যা যামু?

গয়না

তোরে চিড়ি লেখে?

ময়না

উঁহু!

গয়না

কস কি । এই একডা কথা লুকাইলি।

ময়না

আমার না বড্ড ডর করে রে ।

গয়না

ক্যান। কিয়ের ডর?

ময়না

ঐখানকার চলন ফিরনই নাকি আলাদা । যদি কোনো ভুলটুল অয়? 

গয়না

আরে পাগল। থাইকতে থাইকতে সব শিকথা যাবি না?

ময়না

ঢাকা শহরটা দেখনের লাইগ্যা মনটা আমার খালি আকুপাকু করে। আর এতো কিসসা হুনছি বাপের মুখে, চোখের সামনে ছবির মতন ভাসে। তোর মনে আছে? বটগাছের তলে মজনু ভাইয়ের পুঁথি হুইন্যা ফিক কইরা হাইস্যা উঠছিলি? 

 

google news logo

 

গয়না

কোন দিন?

ময়না

আরো গত বিশতলবার দিন রাইতে। ঐ যে বেহেস্তি পুঁথি পড়তেছিল। হুর পরীগো কথা। নানান কিছিমের মেওয়া। বেহেস্তি সরবত। আমার ক্যান জানি খালি মনে হয়, ঢাকা শহরটা ঐ রকমই একটা কিছু।

[গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

গয়না

হুঁ। আইচ্ছা। (গজ)

ময়না

কি? কিছু কই?

গয়না

না থাক।

ময়না

ওমা থাকবো ক্যান। ক

গয়না

শরাফতটা কেমন?

ময়না

মাইনষে তো ভাল কয় না, তয় বাপের মতো খারাপ না। ক্যান? আবার নতুন কিছু ঘটছে?

গয়না

না। এই আর কি।

ময়না

আরো কিছুদিন দ্যাখ। পুরুষ মানুষের মন। ফিরতেও তো পারে।

গয়না

কিন্তু

ময়না

কি?

গয়না

না, থাইক।

ময়না

থাকবো ক্যান। ক?

গয়না

থাক, সব কথা কি আর কওন যায়?

ময়না

গয়না, তোর এমন কি কথা আছে যা আমাদেরও কওন যায় না।

গয়না

আছে, আছে, অনেক কিছু আছে। এমন কিছু কিছু কথা থাকে যা কওয়াও যায় না । হিসাব মিলে না। তবু চেষ্টার শ্যাষ নাই। আশার পঙ্খি মনের কাছে গুন গুন কইরা কয়-দেখ না। যদি মিইল্যা যায়? বেবাক খোয়াব, আশা, চোখের সামনে দেখতেছি পোকায় খাওয়া জামগাছটা ভাইঙ্গা পড়তেছে। তবু মন আশায় বুক বাইনদা কয় গাছটা নাও পড়তে পারে।

ময়না

কি হেঁয়ালি করছ।

গয়না

আমাগো আছেই বা কি, কিছু একটা আগলাইয়া ধরা, থাকনের মধ্যে ঐতো । একটু আশা, কি জানি হয়তো খোয়াব, ঐ নিয়াই তো আছি। ঐডাও যদি এতো তাড়াতাড়ি ভাইঙ্গা পড়ে তয় বাঁচুম কি নিয়া। (প্রস্থান)

ময়না

গয়না, গয়না, গয়না, হুন, যাইস না। কথা হুইন্যা যা। মাইনষের মন। তাও আবার মাইয়া মানুষ। (শরাফত আগে ঢুকে লক্ষ্য করছিল)

 

 

অনাদিনাথ বসু । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

শরাফত

ময়না, ও ময়না।

ময়না

কও

শরাফত

গয়না রাগছে?

ময়না

তোমার মনে কি অয় ।

শরাফত

কেমন কেমন জানি লাগলো ।

ময়না

কেমন কেমন লাগলো?

শরাফত

ভাংগাছ?

ময়না

হইছেটা কি গয়নার?

শরাফত

গয়নার কি অইচে আমি কমু ক্যামনে?

ময়না

তুমি জান না?

শরাফত

না।

ময়না

জান না?

শরাফত

(হতভম্ব হয়ে) গয়না কিছু কইছে তোরে?

ময়না

আমারে কিছু কইলে তোমারে কিগামু ক্যান।

[গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

শরাফত

কিছু কয় নাই?

ময়না

না।

শরাফত

কসম কাইট্যা ক

ময়না

কি কমু?

শরাফত

তোরে কিছু কয় নাই।

ময়না

না ।

শরাফত

অ! আমি তো-

ময়না

কি!

শরাফত

না, কিছু না।

ময়না

কি ব্যাপার, কিছু একটা ঘটছে মনে অয়?

শরাফত

ঘটবে কি, গয়না তো কিছু কয় নাই।

ময়না

গয়না কয় নাই, তুমি কও ।

শরাফত

আমি কিছু জানি না। স্যার কই ।

ময়না

একটু আগে কই জানি গ্যাল।

শরাফত

অ। স্যারের কাছে আইছিলাম, যাই।

ময়না

শরাফত ভাই!

শরাফত

হু

ময়না

হঠাৎ কইরা-

শরাফত

কি!

ময়না

তোমারে য্যান ক্যামন ক্যামন লাগতেছে ।

 

 

দুলিয়া চলচ্চিত্র । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

শরাফত

(ভয় পেয়ে) ক্যামন লাগতেছে?

ময়না

মুখ চোখ ক্যামন শুকাইয়া গেল মনে অয়।

শরাফত

তাই লাগতেছে?

ময়না

মনে অয়। হঠাৎ কইরা খুব ভয় পাইয়া গ্যাছ।

শরাফত

ভয়। কিয়ের ভয় । ভয় লাগবো ক্যান। আমি কি কিছু করছি? আমি আমি ঐ সবের কিছু জানি না ।

ময়না

কি সবের কিছু জান না?

শরাফত

ঐ আর কি-

ময়না

কি?

শরাফত

আহ্! খামাখা মেজাজটা আমার গরম কইরা দিসনাতো ময়না? খারাপ অইয়া যাইবো কইলাম, যা, নিজ কামে যা। 

ময়না

আ। ঠিক আছে যাই।

শরাফত

ময়না হুন। 

ময়না

আবার কি।

শরাফত

জানি, গয়নার কি অইছে আমি জানি। অথচ আমি কিছুই জানি না । 

ময়না

তোমার পাগলামি দেখনের সময় আমার নাই। গেলাম ।

শরাফত

হুন হুন, বেকতেই কয়, রক্তের ধারা নাকি কোনোদিন বদলায় না, আমিও এইডা বিশ্বাস করি। তবুও আমার ভাবতে ভালো লাগে বদলায়, রক্তের ধারাও বদলায়। ব্যস, ঐ ভাবা পর্যন্ত শ্যাষ। সাহস নাই ।

ময়না

সাহস অয়।

শরাফত

সাহস হয় না, সাহস আসে না। ময়না, আমার চাইর পাশে একটা শক্ত সুতার জাল । যার ভিতরে জীবন আষ্ঠেপৃষ্ঠে বান্ধা। বাইর অইতে মন চায়। কিন্তু পারি না, জন্ম- জন্মান্তরের অভ্যাস তো! যাই ।

(ময়না এবং শরাফতের প্রস্থান। বিপরীত দিক থেকে লাঠি হাতে উত্তেজিত নিমাই-এর প্রবেশ। হৈ চৈ শুনে বাদবাদি সবার প্রবেশ)

নিমাই

যা, যা কইলাম, যা তার টেংরি আমি আইজ ভাইঙ্গা দিমু। আমার লগে চালাকি। আমারে ফাঁকি দিয়া আরেকখানে বাসা বাঁধবা?

গনি

কি। অইছে কি? নিমাই কাহা ।

নিমাই

খবরদার কইলাম, কাছে আইবি না। গজব দিমু। কহর দিমু। নির্বংশ কইরা দিমু। এই আমি কইলাম । দেখি কোন রাস্তা দিয়া যাস।

মজনু

 লক্ষণ কিন্তু সুবিধার ঠেকে না মাস্টার। আল্লায় জানে, কার ঘরে কোন মরণ পড়লো।

গনি

দূর মিয়া। যতসব আজগুবি।

মজনু

কাহা । ও কাহা। কি অইছে, গন্ধ পান?

নিমাই

লোবানের গন্ধে ভর কইরা আহে। আতরের গন্ধে ভর কইরা আহে। ঠাণ্ডা বাতাসে সমস্ত শরীর শিরশির কইরা কাঁপে। ওহ।

মজনু

যা ভাবছিলাম তাই । সবাই আল্লাহ আল্লাহ করেন। কাহার এই পাগলামীর ধাত আমার মুখস্ত গতবার শামসুর পোলা মারা যাওনের আগের দিনের ঘটনাটা মনে আছে আপনাগো? সেইবার, গিরামে যহন কলেরার মড়ক লাগলো ঠিক তার আগের দিন নিমাই কাহার পাগলামীর কথা ভুইল্যা যান নাই নিশ্চই।

(গুঞ্জন ওঠে)

গনি

দুর মিয়া, যত্তোসব অন্ধ বিশ্বাস। বুড়া অইলেই মানুষের মন বিগড়াইয়া যায়। উল্টা-পাল্টা জিনিস দেখে, মানুষরে মনে অয় গাছ। গাছরে মনে অয় মানুষ। আর তো-মরাও-

নিমাই

হুঁস। দেহা যায় ছোঁয়া যায় না। ঠোঁট কাঁপে কথা কয় না। ঘাটের মরা ঘাটে বইস্যা ডাকি আর ডাকি, আয় আমারে তুইলা নিয়া যা। ছেলে মেয়ে বৌ আত্মীয়স্বজন একে একে সবাই পার পাইয়া গ্যাল। আমি একা একা আর কদ্দিন। তিন কাল গিয়া শ্যাষ কালেরও শেষে ঠেকলাম। এতো মানুষের জীবন নয়, শকুনের জীবন ।

[গনি মিয়া একদিন ৪র্থ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

গনি

কাহা ও কাহা! আপনি আমার লগে চলেন তো।

নিমাই

ছাইড়া দে। ছাইড়া দে কইতাছি মাস্টার 

গনি

আসেন তো সবাই ধরেন একটু। বুড়া মানুষ উল্টা-পাল্টা দ্যাখে। ধরেন (সবাই ধরাধরি করে নিয়ে যায়। মজনু একা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।) 

মজনু

দেহা যায়, ছোঁয়া যায় না। ঠোঁট কাঁপে কথা কয় না। কি দেহা যায়? কি দ্যাহেন নিমাই কাহা?

(গয়না সহ ময়না ঢোকে)

ময়না

মজনু ভাই, ও মজনু ভাই। একা একা কার লগে কথা কও। মজনু ভাই । আরে ও মজনু ভাই ।

 

 

অনাদিনাথ বসু । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

(মজনু সম্বিত ফিরে পায়)

মজনু

কেডা ও ময়না?

ময়না

কি অইছে তোমার?

মজনু

না, কিছু না।

ময়না

একডু আগে চিল্লাচিল্লি হুনলাম । 

মজনু

নিমাই কাহা। ছিটটা আবার উঠছে।

ময়না

আবার! 

গয়না

গাটা হঠাৎ ছমছম কইরা উঠল ক্যান?

মজনু

ও কিছু না, বাদ দে। তা কিছু কইবি ? 

ময়না

না। ঐ আর কি, চিল্লাচিল্লি শুনলাম-

মজনু

(গয়নাকে) তোর খবর কি?

গয়না

ভালো। 

ময়না

মজনু ভাই, গয়নার মনটা না খুব খারাপ।

মজনু

ক্যান, কি অইছে তোর?

গয়না

না কিছু না। এমনি।

ময়না

মজনু ভাই পুঁথি হুনাইবা ?

মজনু

না। মন ভালো নাই।

ময়না

পড়না মজনু ভাই।

গয়না

(হেসে) হ

মজনু

ঠিক আছে। অরা সব আইয়া পড়বো। তোরা এখানেই থাক। বইস্যা বইস্যা হুন। 

(মজনু বটগাছের গোড়ায় চলে যায়। পুঁথি পড়া শুরু করে। লোকজন ধীরে ধীরে জড়ো হতে থাকে।)

 

 

গনি মিয়া একদিন নাটক :  ৫ম শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান
গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান

প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক

প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা

কুশীলব

নিমাই :  জন মার্টিন

গনি মিয়া : এস এম সোলায়মান

মজনু : মিজান মুহাম্মদ শাহীন

নেয়ামত : মধু

শরাফত : নাদের চৌধুরী

শের আলী : মিজান

জামাত মোহাম্মদ: আশীষ খন্দকার

শমশের : আখতার

বারেক : মুকুল

ময়না : ফেরদৌসী হাবীব চিঠি

গয়না : মৌসুমী

জনৈক :  শাহ আলম কবীর, দেবাশীষ বড়ুয়া, শাহীন, মনসুর, দিলান,রিপন, জর্জ, বুলবুল

গয়নার বাপ : জহির আহমেদ

পিয়ন : শেখ শানে মাওলা

 কলাকুশলী

নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান

মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ

সহকারী : হাবিবুর রহমান, সুনীল বাবু

আলোক নিয়ন্ত্রণ :  কামরুল হাসান স্বপন

পোষাক ও পোস্টার ডিজাইন : অশোক কর্মকার

মঞ্চসামগ্রী :  মিজান

গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান

বটগাছ নির্মাণ : হাবিবুর রহমান

আলোকচিত্র : আমিনুর রহমান আজম

 

গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক

শোন তবে কহি আমি, কহি নছিহত 

শুনি, কহিব যে বেহেস্তের খবর

বেহেশত পয়দা করেন সাঁই, দুনিয়াতে রাখে নাই,

আছে ছয় আসমানের ওপর 

নেক বান্দা বেহেশত যাবে, বড় আরামেতে রবে,

শোন তবে বলি সে খবর

এক এক ঘর তার, দেখিতে কি চমৎকার,

হবে এই দুইন্যা বরাবর।

মেওয়া খাও তামশা করো, হুর নিয়ে শুয়ে থাক, 

মেহেনত তকলিফ নাহি আর

হুর সাথে রঙ্গ কর, যেথা ইচ্ছা সেথা ফির,

এইখানেতে সব কিছু তোমার

পথে ঘাটে কোনখানে, আওরত মরদ দুইজনে 

যদি কেউ লাগে কভু জোড়া

আল্লার হুকুমে এসে, ফেরেশতা তাহার পাশে, 

ঘিরিয়া করিবে পর্দা খাড়া।

[গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

গয়না

যাহ ! অসভ্য।

ময়না

আরে হ, ঐ রহমই হুনছি।

গয়না

কস্ কি. আমি তো চিন্তাই করতে পারি না।

ময়না

আমরা তো গাঁও গিরামে থাকি, ঐখানে কি গেছি কোনোদিন?

গয়না

তুই পারবি?

ময়না 

আরে একবার যাইয়া লই না, দেহিস তখন। আমার আর তর সয়না, হে যে কখন পাশ কইরা ফিরবো।

গয়না

খোয়াবে দ্যাহস?

ময়না

কত দেখলাম । টেরেইনে উইঠ্যা এক্কেরে ঢাহা শহরে। কি যে সোন্দর। কেবল বাত্তি আর বাত্তি। লাল নীল গোলাপী। এই উচা উচা দালান, বিরাট বিরাট বাড়ি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বড় বড় দোকান। তাকে তাকে সাজানো আঙ্গুর, বেদনা,নাশপাতি। যা ইচ্ছা খা, পরান ভইরা খা।

মজনু

সেই চার দরিয়ার, শোন কহি সমচার, জানো এই পানি আছে ভরা/আল্লাহ তালার মেহেরেতে দুয়েম দরিয়া তাতে, জানিবে তাই দুধ আছে পুরা/তেছরা দরিয়ার বিছে শারাবান তাহুরা আছে, আরো কতো আছে নিয়ামত/চৌথা দরিয়ায় শুধু কেবলি 

জানিবে মধু, দোছরা নাম বলেত সহদ 

হাতে মেওয়া নাও খাও বাড়িবে হিম্মত 

খুশি হইয়া হুরের সাথে কর মহব্বত 

খুশবুই জানিবে তাতে যেমন মেশকের 

মেওয়া খাবে না কমিবে হবে সেথা ফের 

মুখের লব হইতে মেওয়া নরম জানিবে 

সব হইতে শিরিন পিঠা বেহেশতে খাইবে 

মেওয়া ফল খাইয়া শোকর করবে সর্বজনে 

শোকর করে যেথায় ইচ্ছা যাবে সেইখানে 

কোন রূপ দুঃখ ক্লেশ বেহেশত খানায় নাই 

খুশি আর আরামেতে রহিবে সবাই 

মোটা তাজা হবে সবে শোন সমাচার 

বেহেশতের মধ্যে মউত হবে না কাহার 

খুশিতে হয়রান এ্যায়ছা হইবে সকলে 

চারিদিক চেয়ে রবে আপনাকে ভুলে 

গয়না

আমার মগর ভাল খাওনের লোভ। ঢাকায় আমি পাক্কা একডা মাস বইস্যা বইস্যা ঠেং এর উপর ঠেং তুইলা দিয়া খামু। তখন কিন্তু কিছু কইবার পারবি না।

ময়না

আস্ত পাগল। ঐহানে আবার খাওনের অভাব আছে নি। সাধে কি মাইনষে কয়, ঢাহা শহরে মায়া একবার যারে ধরছে, হে আর ফেরত আইবার পারে না। আর ফেরৎ আইস্যাই-বা কাম কি। গাঁও গিরামে এত দলাদলি, এর মাথা ও খায়, ওর মাথা এ খায়। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন

গয়না

আইচ্ছা! কত বড় ঢাকা শহর? মানুষজন কেমন? 

ময়না

বাজানের মুখে হুনছি—উত্তর দিকের সীমানা দিয়া একবার হাঁটা শুরু করলে দক্ষিণের শেষ সীমানা পর্যন্ত পাকা দেড় দিন লাগে। অবশ্য কাউরে হাঁটতে অয়না । যেইখানে যাইতে চাস তোরে উড়াজাহাজের মাথায় বসাইয়া বোঁ-ও-ও কইরা উড়াইয়া নিয়া যাইব । গাড়ি ঘোড়া শান শওকতে সে এক এলাহি কারবার। আর মানুষগুলানও মাশাআল্লাহ। কথাবার্তা, চাল-চলন, আদব কায়দায় সব কিছুরে হার মানায়। গতবার কাসু যহন গিরামে আইল, দ্যাহস নাই? চেহারা সুরত মাশাআল্লা খুইল্যা গ্যাছে।

গয়না

পাগল অইয়া গেলি নি। হাসছ ক্যান। ঐ ময়না।

 

গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক

 

ময়না

না, নিজের কথা নিজে একবার ভাবলাম, বাজানরে তো জানসই। চব্বিশ ঘণ্টা মাথার মধ্যে খালি একটাই চিন্তা কামু উকিল অইবো, আমার লগে বিয়া দিবো, মণ্ডল গো লগে মামলা কইরা জিইত্যা আবার আলা মিয়া জমিদার। আমি খালি বাজানরে খোঁচাই। বাজান রাগ করে। তবুও কই—বাজান তুমি এত বেশি আশা কর ক্যান আল্লায় না করুক যদি বিপরীতটা হয়? তখন তো পিছাবার রাস্তা পাইবা না। কারে কি কই। এহন দেখি নিজের মাথায়ও চব্বিশ ঘণ্টা একটাই খোয়ার। ঢাকা আর ঢাকা।

গয়না

হ! বেকতের মানে অইলো গিয়া কপাল।

ময়না

আশা তো আছে। আল্লায় জানে সামনে কি-

গয়না

তয় আমার কি মনে অয় জানিস?

ময়না

কি

গয়না

আমার মনে অয় মরন বিনা গতি নাই ।

ময়না

গয়না, তোর অইছেডা কি আমারে একটু কইবি?

গয়না

অইবো আর কি।

ময়না

আমার মনে অয় কিছু একটা তুই লুকাস।

গয়না

নিমাই দাদা কয়, জীবনটাই অইতেছে নাকি লুকোচুরির খেলা। কেউ কারো চেহারা খোলসা কইরা দ্যাহে না, দ্যাখায় না। পাছে ধরা পইড়া যায়। জীবন তো নয়। নেশা, ভাং ধুতরার নেশা যতোক্ষণ থাকে, এই খেলাও ততোক্ষণ চলে। তারপর নেশার গলুই যহন উল্টাইয়া যায়—মানুষ তহন নিজেরে নিজে দ্যাহে, একা, একদম একা ।

[গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

কোরাস

(গান) ওরে ভুল ভুল ভুল

জীবন মানেই ভাং ধুতরার ফুল

নেশা আছে যতোক্ষণ পীরিত থাকে ততোক্ষণ 

নেশার গলুই উলটে গেলে চোখে শর্ষে ফুল।

গয়না

কাইল রাতে মরা মারে খোয়াবে দ্যাখলাম, আমারে ডাক দিয়া কয়, কিরে আর কতো টো টো কইরা ঘুইরা বেড়াইবি। সাঁস নামছে, ঘরে আয়।

ময়না

তোরে একটা কথা কই?

গয়না

ক!

ময়না

তুই শরাফতের আশা ছাইড়া দে । হে তো মানুষ না, জানোয়ার একটা ।

গয়না

ঠিকই কইছস। তয় বড্ড দেরি অইয়া গ্যাছে।

ময়না

কিয়ের দেরি?

গয়না

ঐ আর কি। ভাং ধুতরার নেশা। নেশাও শেষ, নিজের দিকে যহন চোখ মেইল্যা দেখি—আবিষ্কার করি সারা শরীরে বিষাক্ত ঘা, দুর্গন্ধ যুক্ত পুঁজ নিয়া আমিও নিমাই দাদার মতন একা।

ময়না

কি হেঁয়ালি করস, কি অইছে খুইল্যা ক

গয়না

মরনে বড় কষ্ট, না?

ময়না

মইরা তো দেহি নাই কোনোদিন। কমু ক্যামনে। 

গয়না

আইজ দুপুরে আমাগো পোয়াতি গাভিটা মইরা গ্যাল। এক্কেরে চোখের সামনে মরনের কষ্টটা দ্যাখলাম। আহারে কি যে ছটফটানি। দেইখ্যাই কইলজাটা ঠাণ্ডা হইয়া যায়। চোখ দুইডা মনে অয় ভিতর থাইকা চুইটা বাইরে ছিটকাইয়া পড়বো। চোখের মনি একবার এই কোনা থেইক্যা ঐ কোনা, আবার ঐ কোনা থেইক্যা এই কোনা, সেকি ছুটাছুটি ময়না। নিমাই কাহার সেই লুকোচুরি খেলা।

সমস্ত শরীরডা দুমড়াইয়া মোচড়াইয়া আহারে সে যে কি কষ্ট। আতকা দেখি নাই, কিছু নাই। কষ্ট নাই, খিচানি নাই। খালি চোক্ষের কোনায় এক ফোটা কি দুই ফোটা পানি জমাট বাইন্ধা আছে। সেই জমাটও ভাঙলো। আস্তে আস্তে গড়ায়া পড়লো কামড় খাওয়া জিহ্বা বরাবর, না জিহ্বা পর্যন্তও পৌঁছাইতে পারলো না। তার আগেই শুকাইয়া শ্যাষ।

ঐখান থেকে চক্ষু পর্যন্ত একটা দাগ। ময়না, সেই গালের মাঝকান থেইক্যা দ্যাখলাম, আমি দ্যাখলাম আমার জিহ্বায় কামড় খাওয়া মুখ, পচা মাংসের দুর্গন্ধে নিশ্বাস আটকাইয়া আসে, সমস্ত মুখ ভর্তি লাল দগদগে ঘা, কিলবিল কিলবিল করে ময়লা নালার নোংরা পোকা, ক্যাট ক্যাট কইরা খায় জমাট সাদা পুঁজ, দুর্গন্ধ-গুহ। 

গয়না

আইচ্ছা! গাভীটা মরনে যে কষ্ট পাইছে—পেডের বাচ্চাটাও কি 

ময়না

মরনের কষ্ট যে কি, হে যদি আজরাইলে জানতো-

মজনু

খোদা কহে আজরাইল শোন বাত তুমি 

সকলের জান লইতে হুকুম দিলাম আমি 

মউতের পিয়ালা পিতে হইবে তোমারে 

এই বাতে দয়া মোর নাই কারও তরে 

যদি না করিছ দয়া কাহার ওপরে 

জানের মায়া কি যে মায়া জানাব তোমারে। 

মরনের কষ্ট ক্যায়সা তোমারে জানাই। 

জান ধর আলাদা করিব দুই ঠাঁই 

খোদা কহে আজরাইল বাত মেরা লও 

হেথা হতে আরশের নিচে চলে যাও। 

খাড়া হও আরশের নিচে তুমি গিয়া 

শুয়ে থাক ডাইন হাত মাথার নিচে দিয়া 

ফের কহে আজরাইল কয়ে আওয়াজেতে 

জান বাহির কর তুমি আপন শরীর হতে 

আজরাইলও দুই হাত দরাজ করিয়া 

শরীর মাঝে পেটের ভিতর দিল চালাইয়া 

কান্দি কান্দি জারে জারে হইয়া আপনি

মরার এত কষ্ট তাহা না জানিতাম আমি 

জানিলে এমন ভার না লইতাম আমি। 

জান ধরে এত দরদ দিয়া ছিলে তুমি 

আপনার জান কবচ করিতে আপনি 

এমন ভয়াল আওয়াজ করিল তখনি 

আসমান জমিনে কেহ জিন্দা থাকিলে 

সেই আওয়াজ শুনে ভাই মরিত সকলে।

(গয়নার বিকট চিৎকারে সবাই পুঁথি পাঠের আসর থেকে ছুটে আসে) 

ময়না

কিরে কি হইছে গয়না। গয়না ডরাইছস? গয়না, কথা কসনা ক্যান।

মজনু

দেখি দেখি, আরে এতো ফিট অইয়া গ্যাছে। ধরেন তো মিয়ারা, একটু হাত লাগান, গয়নার বাপ গ্যাল কই। শমসের, গয়নার বাপরে খবর দাও।

(সবাই ধরাধরি করে নিয়ে যায়, কোরান শরীফের সুর ভেসে আসে। বিপরীত দিক থেকে নিমাই এবং শমসের ও বারেক ঢোকে)

বারেক

(নিমাইকে) আপনি? আপনি এক নম্বরের কুফা। এক এক সময় এক এক রকমের পাগলামী করেন আর আজাব নাইম্যা আসে আমাগো উপর। যান, যান এইখান থেইক্যা।

[গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

(নিমাই চলে যায়। গনি ঢোকে)

গনি

ময়না, ময়না। শমসের, বারেক, কি অইছে? কি অইছে আমার মায়ের?

 

গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক

 

শমসের

ময়নার কিছু অয় নাই, ঐ তো ময়না । 

গনি

কি অইছে? কি অইছে মা?

ময়না

বাজান, গয়না (কাঁদতে কাঁদতে গয়নার বাপ ঢোকে)

গয়নার বাপ 

মাস্টার। মাস্টার, আমার সর্বনাশ অইছে। আমার কপাল ফাটছে মাস্টার, ফাটছে। 

গনি

অইছেড়া কি। কইবাতো। (কানে কানে বলে) কন কি. সর্বনাশ, কেডায়?

গয়নার বাপ 

আর কেডায়, ঐ হারামির বাচ্চা।

শমসের 

এইডা কি মগের মুল্লুক নি, গয়নার বাপ শালিস ডাক তুমি ।

বারেক

আপনারে বহুবার কইছি মাস্টার। এত ভদ্রতা দিয়া দুইন্যা চলে না, অহনও কই । ধরেন, এইডাই সময়, শালার চশমখোররে ধরেন। 

গয়নার বাপ 

আমি সমাজে মুখ দ্যাহামু ক্যামনে। অহন আমি কি করি?

শমসের

কইলাম না? শালিশ ডাক তুমি।

জনৈক

চিন্তা কর কি মিয়া, আমরা কি মইরা গেছি নাকি? 

মজনু

তোমাগো বাঁইচ্যা থাকনের কোনো লক্ষণও তো দেহি না।

গনি

(দৃঢ়তা নিয়ে) গয়নার বাপ, উঠ। মেরুদণ্ড সোজা কইরা খাড়াও মিয়া, মাইয়া আমার ঘরেও আছে। কষ্টটা আমিও বুঝি। খালি একবার সাহস কইরা খাড়াও।

(শের আলী ঢোকে)

শের আলী 

মাস্টার, এখনকার সময় কিন্তু আপনার। ধরেন, এইবার শক্ত কইরা ধরেন।খবরদার ম্যান ফুটবার না পারে। 

জনৈক

শের আলী ভাই। আপনি থাকবেন তো আমাগো লগে।

শের আলী

মাস্টারের লগে কথা আমার অইয়া গ্যাছে, আমি আছি। আপনাগো পিছনে আমার সাপোর্ট আছে। দেরি করবেন না মাস্টার, আগান। এখনি হচ্ছে গিয়া আপনার মোক্ষম সময় যান। সবাইরে নিয়া যান। বললাম তো আমি আছি, আপনারা আগান।

গনি

আপনি না বললেও আমি আগাইতাম। চলেন সবাই। (সবাই চলে যায়)

শের আলী

আমি না বললেও আপনি আগাইতেন। জানি মাস্টার। খুব ভালো করেই জানি। আর জানি বলেই আমি আগ বাড়াইয়া বললাম- মাস্টার আগান। এইখানেই আমার রাজনৈতিক মহত্ত্ব।

(শের আলী চলে যায়, জামাত ও নেয়ামত ঢোকে)

নেয়ামত

গ্যাল, গ্যাল, সব গ্যাল। মান সম্মান আমার আর কিছুই রইলো না। বাবা শরাফত, আমার মান-সম্মান সব ধুলিস্যাৎ কইরা দিলেন। জামাত মোহাম্মদ সাব, অহন আমি কি করি। আপনি তো কত জনের কতো উপকার করলেন। আমারে এবারের মতন বাঁচাইয়া দ্যান। আজীবন আমি আপনার পায়ের তলায় থাকুম ।

জামাত

ঘটনা যাহা শুনিলাম, তাহা বড়ই মর্মান্তিক। এই জীবনে কত বড় বড় ঘটনা লইয়া ডিল করিয়াছি। রাষ্ট্রীয় বাজেট, অর্থনৈতিক পলিসি, রাজনৈতিক পোলারাইজেশান, করি নাই কি । কিন্তু গ্রাম বাঁচাইতে আসিয়া এমন একটি সাধারণ, অতি সাধারণ অথচ অসাধারণ একটি ঘটনার মুখোমুখি হইতে হইবে তাহা স্বপ্নেও ভাবি নাই । 

 

google news logo

 

নেয়ামত

আমি এহন কি করি? আমার মান সম্মান

জামাত

চুইংগাম খাইয়াছেন? না খাইলেও নিশ্চয়ই দেখিয়াছেন। ইহা এক প্রকার লেবেস। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ইহা চুষিয়া চুষিয়া খায়। মিষ্টি হইলেও আদতে ইহা একটি রবারের দলা। ইচ্ছা করিলে ইহাকে টানিয়া টানিয়া অনেক লম্বা করা যায় আবার মুহূর্তেই দুই আঙুলে টিপ দিয়া দলা মোচা করিয়া আগের অবস্থায় আনা যায়। বুঝিয়াছেন? 

[গনি মিয়া একদিন ৫ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

নেয়ামত

না।

জামাত

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সব ধরনের ঘটনা দুর্ঘটনায় ইহা একটি কমন ফর্মুলা। এই ফর্মুলাতেই সর্বক্ষেত্রে আমরা প্রাধান্য বিস্তার করিয়া চলিয়াছি। আপনার ক্ষেত্রেও একই ফর্মুলা প্রয়োগ করিব, যদি মনে করি টানিয়া লম্বা করার দরকার, করিব। যদি মনে করি উহাকে গোলাকার পিও অবস্থায় রাখা দরকার, রাখিব। এইবার বুঝিয়াছেন?

নেয়ামত

কিছু কিছু ।

জামাত

তাহাতেই চলিবে, চলেন। (দু’জনের প্রস্থান।)

 

 

গনি মিয়া একদিন নাটক :  ৬ষ্ট শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান
গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান

প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক

প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা

কুশীলব

নিমাই :  জন মার্টিন

গনি মিয়া : এস এম সোলায়মান

মজনু : মিজান মুহাম্মদ শাহীন

নেয়ামত : মধু

শরাফত : নাদের চৌধুরী

শের আলী : মিজান

জামাত মোহাম্মদ: আশীষ খন্দকার

শমশের : আখতার

বারেক : মুকুল

ময়না : ফেরদৌসী হাবীব চিঠি

গয়না : মৌসুমী

জনৈক :  শাহ আলম কবীর, দেবাশীষ বড়ুয়া, শাহীন, মনসুর, দিলান,রিপন, জর্জ, বুলবুল

গয়নার বাপ : জহির আহমেদ

পিয়ন : শেখ শানে মাওলা

 কলাকুশলী

নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান

মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ

সহকারী : হাবিবুর রহমান, সুনীল বাবু

আলোক নিয়ন্ত্রণ :  কামরুল হাসান স্বপন

পোষাক ও পোস্টার ডিজাইন : অশোক কর্মকার

মঞ্চসামগ্রী :  মিজান

গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান

বটগাছ নির্মাণ : হাবিবুর রহমান

আলোকচিত্র : আমিনুর রহমান আজম

 

গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক

(বিরতির পর সালিশের দৃশ্য, একটি বড় চেয়ার রাখা আছে বিচারপতির জন্য । একজন দুইজন করে লোক ঢুকছে। জামাত মোহাম্মদ এখনো আসেন নি।)

[গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

নেয়ামত

বাবা শরাফত, যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়া গিয়াছে, শত চেষ্টা করিলেও ফিরাইবার কোনো উপায় নাই। কাজেই সাহস নিয়া সালিশের মোকাবিলা করিবেন। কোনো প্রকার দুর্বলতাকে মনে ঠাঁই দিবেন না।

শরাফত

মাস্টার সাব কি সালিশে আইসবে বাজান?

নেয়ামত

বোধঅয়। ক্যান বাজান?

শরাফত

না। উনি থাকলে-

নেয়ামত

ডরের কিছু নাই বাজান। আমি তো আছি। আপনি পরিষ্কার একটা কথাই বলবেন, গয়নার লগে আপনার কোনো সম্পর্ক আছিল না, ঠিক আছে?

শরাফত

জ্বি।

নেয়ামত

একটা কথা খেয়াল রাখবেন। আমার ট্যাকা আছে। ওগোর কিছু নাই। ট্যাকা দিয়া দুইন্যা কিনা নেওন যায়। মাস্টার তো কোন ছার। কি, সাহস হয়? 

শরাফত

হয় বাজান। এইবার সাহস অয়, আপনি চিন্তা করিবেন না কোনো শালা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

নেয়ামত 

সাবাশ বাজান।

(জামাত মোহাম্মদ ঢোকে। সবাই দাঁড়ায়।)

গনি

আইজকে এমন একটা বিষয় নিয়া আমরা সালিশে বইছি যেইটার লগে পুরা গিরামের মান-সম্মানের ব্যাপার জড়িত। জড়িত আর একজনের জীবন মরনের ব্যাপার। গয়নার বাপ কই?

গয়নার বাপ 

এইতো, আমি এইখানে।

গনি

বাদি তো আপনি, কাজেই সামনে আসেন।

শের আলী

(গনিকে) শক্ত কইরা ধরেন মাস্টার। আমি আপনার সাপোর্টে আছি।

গনি

তাইলে শুরু করা যায়, না কি কন সবাই।

শের আলী

মাস্টার সাব, তার আগে আমার দুইখান কথা আছে। তো কথা হইল গিয়া পরথমে সালিশের রায় দুই পক্ষই মানতে রাজি আছে কি না।

জনৈক

ন্যায্য অইলে মানুম না ক্যান।

শের আলী 

দুই নম্বর কথা অইলো গিয়া এই সমস্ত সালিশ বিচারে একজন মুরুব্বি লাগে। আমাগো গিরামের কৃতি সন্তান জনাব জামাত মোহাম্মদ সাহেব এখানে আছেন, আমার অনুরোধ এই দায়িত্ব আমরা তেনার হাতে ছাইড়া দিই। (সবাই চুপচাপ। জামাত উঠে দাঁড়ায়।)

 

গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক

 

জামাত

আচ্ছালামু আলাইকুম। আমার বিন্দুতম ইচ্ছা ছিল না এই জাতীয় কোনো ঘটনার সহিত নিজেরে জড়াই। তবু আসিয়া যখন পড়িয়াছি একটা কিছু হইবেই। আমি জিজ্ঞাসা করিতে চাই না, সালিশের বিচারক হিসাবে আপনারা আমাকে মানেন কি না। যদি নাও মানতে চান তাহা হইলেও আমার দায়িত্ব হইবে আপনাদের মানানো এবং ইহার জন্যও নির্দিষ্ট ফর্মুলা আমার হাতে রহিয়াছে। একা একা বিচার করিয়া দুর্নাম অথবা সুনামের ভাগিদার হইতে চাই না। আর তাই আরও দুইজন ব্যক্তি সালিশ করিবেন। আপনারা নাম প্রস্তাব করেন।

জনৈক

আমি গনি মিয়া মাস্টারের নাম প্রস্তাব করি।

সবাই

হ, হ। মাস্টার।….

জামাত

বোঝা গ্যাল, উনি একজন পপুলার ব্যক্তি। মাস্টার সাহেব আসেন। আমি রাখ ঢাক কথা বলি না। যাহা বলি স্পষ্ট বলি। পূর্ণ গণতন্ত্রে আমার আস্থা নাই বিধায় দ্বিতীয় ব্যক্তি আমি মনোনীত করিব এবং তিনি হবেন জনাব শের আলী মিয়া, আসেন শের আলী। শুরু করেন।

গনি

বলেন।

নিয়ামত 

শরাফত আপনার ছেলের মতন। তারে আপনি অত্যন্ত স্নেহ করেন। আমি জানি

গনি

আমার সব ছাত্ররেই আমার ছেলের মতন দেখি ।

নিয়ামত

পোলাপান মানুষ একডা ভুল করলোইবা। মাস্টার, আমার সম্মানের ব্যাপার। আপনি ইচ্ছা করলেই সালিশের মোড় ঘুরাইয়া দিতে পারেন। সামনে ইলেকশান ।আপনারে আমি খুশি কইরা দিমু।

[গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

জনৈক-১

কিরে অইলোডা কি মাস্টার দেহি চেয়ারম্যানের লগে ফুসফাস করে ।

জনৈক-২

মাস্টাররে আবার হাত করলো নি? 

জনৈক ৩ 

দূর মিয়া। তোমাগো ঈমান বড় লক্কর ঝক্কর, বিশ্বাস রাখ।

গয়নার বাপ 

কারো তো কিছু অইবো না। কপাল যারটা পোড়ছে, খালি হেই পোড় থাকবো।

নিয়ামত

(মাস্টারের হাত ধরে) মাস্টার। আমি স্বীকার করি। আপনার লগে আমি বহু খারাপ ব্যবহার করছি। জানিনা বিশ্বাস করবেন কি না, এর পরক্ষণেই মনটা আমার খারাপ অইয়া গ্যাছে। যত বিবাদই হোক, এইটাতো ঠিক তুমি, আমি, লেদা, আমরা ছিলাম বাল্যবন্ধু। সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে — মাস্টার, কিছু একটা করন যায় না? 

গনি

দেখা যাক, কি করা যায়? আসেন, ঠিক আছে শুরু করেন।

জামাত

আপনাদের কথাবার্তা শ্যাষ?

গনি

জি। শ্যাষ।

জামাত

ঠিক আছে। প্রথমে বাদি, কি নাম?

বারেক

গয়নার বাপ।

জামাত

গয়নার বাপ। আসেন

গয়নার বাপ 

আমি আর কি কমু। আপনারা তো বেবাকেই জানেন। আমার মা মরা মাইয়া গয়না, চেয়ারম্যান সাবের পোলা শরাফত আলী হেরে-

জামাত 

যাহা বলিবেন, সত্য বলিবেন। মিথ্যা বলিবেন না ।। 

গয়নার বাপ

আপনেরা তো জানেনই—

জামাত 

আমরা কিছুই জানি না। আপনি বলেন।

গয়নার বাপ 

আমার মা মরা মাইয়াটারে শরাফত আলী- 

মজনু

ধুর মিয়া, খালি গাই গুই করেন। অর্ধেক কথা প্যাডে অর্ধেক কথা বাইরে।চেয়ারম্যান সাবের পোলা আর গয়না দুইজনে মিইল্যা লাভ করছিল। অহন গয়নার পেড়ে বাচ্চা। এইডা অইলো গিয়া কথা। আমি তো এইখানে কোনো প্যাঁচগোঁজ দেখি না। দুইজনেই পোলাপান মানুষ। ভুল কইরা একখানা ঘটনা না অয় ঘটাই ফেলছে, দুইডারে মিলাইয়া বিয়া পড়াইয়া দ্যান। ব্যাস, মামলা শ্যাষ।

জামাত

এত সহজে যদি সকল সমস্যার সমাধান হইয়া যাইত, তাহা হইলে দুনিয়াতে আইনের এত প্যাঁচগোজ থাইকতো না। 

মজনু

প্যাঁচগোজ তো মিয়া মানুষেই বানায়। খামাকা বেকাতেরা কথা বাদ দিয়া সোজাসুজি কামটা সারাইয়া ফেললে হয় ।

[গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

জামাত 

আমি অসন্তুষ্ট হইতেছি । আপনি বিচারের কাজে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করিতেছেন ।

শের আলী

জামাত সাব, পাগল, ফকিরি লাইনের মানুষ। গিরামে বেকতেই তারে মজনু পাগলা কয়। মজনু, এইটা অন্য লাইন। তুমি বুঝবা না। কাজেই চুপ কইরা থাক। 

মজনু

আপনাগো সুবিধা অয়, না? ঠিক আছে থাকলাম । তয় সত্য কিন্তু গোপন থাকে না।

জামাত

বড় বেয়াড়া পাবলিক তো! 

গনি

বাদ দেন জামাত সাব।

জামাত 

কি বললেন, জামাত সাহেব? ঠিক আছে। বিবাদী শরাফত মণ্ডল। 

বারেক 

(গয়নার বাপকে) মাস্টারের কেইসটা কি, এত ফাল পাড়লো, আর এহন চুপচাপ।

 

গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক

 

গয়নার বাপ 

আল্লায় কার মনে কি রাখছে ক্যামনে কই।

নেয়ামত

বাজান শরাফত মণ্ডল আসেন। তয় জামাত সাহেব, আমার একখান কথা, শরাফত আমার একমাত্র পোলা অন্যায় কারে কয় আমি শিখাই নাই। সব সময় চেষ্টা করছি আমার মতো করে মানুষ করতে। আল্লায় আমারে আপনাগো দশ জনের দোয়ায় বিষয় সম্পত্তি কম দেয় নাই। আমি মরলে বেবাক সম্পত্তির মালিক শরাফত আলী। সেই লোভে বহু মানুষ মাইয়া গছাইয়া আমার পোলারে ফাদে ফেলনের চেষ্টা করছে। মগর আল্লাহ বাঁচানেওয়ালা। কথাটা একটু খেয়াল রাখবেন।

জামাত

শরাফত মণ্ডল, যাহা বলিবেন, সত্য বলিবেন, মিথ্যা বলিবেন না। 

শরাফত 

বাজানের কথাই ঠিক। সম্পত্তির লোভে বহু মানুষ মাইয়া গছাইবার চেষ্টা করছে। কত রকমের যাদু টোনা করছে আমারে ।

জামাত

তারপর?

শরাফত

পইত্যেক সময় আপনাগো দশজনের দোয়ায় আমি বাঁইচ্যা আইছি। 

জনৈক 

এইবার বাচন নাই ।

শরাফত

 ঐ কেডা । কোন হারামির বাচ্চা আওয়াজ ন্যায়। টান দিয়া জিহ্বা খুইল্যা লমু।

জামাত 

উত্তেজিত হইবেন না এবং ভুলিয়া যাইবেন না আপনি এখনো আসামীর কাঠগড়ায়। যাহা বলিতেছিলেন, বলেন

শরাফত

ঐ গয়নার চরিত্র খারাপ। বহু চেষ্টা করছে আমারে বিয়া করতে। কিন্তু আমি হের ফাদে পা দেই নাই। এই জাতীয় কোনো ঘটনাও ঘটাই নাই। কারণ মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে তার চরিত্র। আমি নির্দোষ।

জামাত 

গয়নার বাপ, শরাফত তো অস্বীকার করে।

গয়নার বাপ

এত বড় জুলুম আল্লায় সইবো না। আমার মাইয়াটারে বিয়া করবার লোভ দেখাইয়া হের সর্বনাশ করছে।

জামাত

সর্বনাশের পক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ আছে?

গয়নার বাপ 

পেরমান।

নেয়ামত

হেইডা নাই। বেবাক কান কথা ।

মজনু

আছে। আমার কাছে আছে।

জামাত

কোন পাগলের সাক্ষী এখানে গ্রহণযোগ্য নয়।

জনৈক

 মজনু মিয়া যে পাগল হের কোনো পেরমান আছে?

নেয়ামত

দুর মিয়া। এইডা একটা কথা কইলা? কেডায় না জানে যে হে একডা পাগল । 

জনৈক-২

 তাইলে এই গিরামের কেডায় না জানে যে, আপনের পোলার লগে গয়নার পীরিত আছিল?

সবাই

হ! হ! আমরা জানি।

জনৈক-১ 

শরাফত, তুমি তাইলে স্বীকার যাইবা না, না?

শরাফত

 না

জনৈক-১

গয়নার লগে তোমার কোনো সম্পর্ক আছিল না।

শরাফত

না।

জনৈক

সম্পর্কই যদি না থাকে তবে গত পূর্ণিমার রাইতে গাংগের পাড়ে কিয়ের এত কথাবার্তা কইতেছিলা তুমি আর গয়না।

শরাফত

মিছা কথা।

জনৈক-২

আইচ্ছা, গেল মাসের সাত তারিখে রাইতের বেলায় আপনি গয়নার ঘরে টোকা দিতেছিলেন। চোর মনে কইরা গয়নার চাচা আপনারে জাপটাইয়া ধরে। আপনি কইছিলেন—হাওয়া খাইতে বাইর অইছেন। মানুষ হাওয়া খাইতে গাংগের পাড়ে যায়। আপনি গয়নার বাড়িতে গ্যালেন ক্যান?

জনৈক-৩

এইডাও কি মিছা কথা?

শের আলী 

কথা কন, কথা কন, জবাব দ্যান।

শরাফত 

(মুখ নিচু করে) মিছা কথা।

বারেক

এইডাও মিছা কথা, ঐড়াও মিছা কথা। তয় সত্য কথা কোনটা (নিরুত্তর) 

গনি

জামাত সাব। যদি অনুমতি দ্যান, তবে দুইটা কথা কই।

নেয়ামত 

কন। আপনি কিছু কন মাস্টার।

গনি

বাবা শরাফত। ধর কথার কথা, যদি পেরমান অয় তুমি দোষী তয় গয়নারে বিয়া করবা?

শরাফত

না 

গনি

পেরমান হইলেও করবা না।

শরাফত 

দরকার হয় ট্যাকা দিয়া পেরমানের মুখ বন্ধ করুম।

গনি

তুমি যদি দোষই না করবা তয় ট্যাকা দিয়া পেরমানের মুখ বন্ধ করা লাগে ক্যান? 

নেয়ামত 

মাস্টার, এইটা কিন্তু কথা ছিল না।

গনি

অনেক কথাই ছিল না নেয়ামত সাব। বাবাজি, আমি তো একজন মাস্টার মানুষ, নানান কিছিমের ছাগল পিটায়া মানুষ করি। তার মইধ্যে তুমিও একজন । তো তুমি যে আবার কোন জাতের ছাগল সেইটাতো আমি ভাল কইরাই জানি(পকেট থেকে চিঠি বার করে)

[গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

নেয়ামত

মাস্টার, অহনও সময় আছে।

গনি

আমার নাই।

নেয়ামত

তুমি আমার বাল্যবন্ধু, মাস্টার।

গনি

ছিলাম। জামাত সাব, এই যে দ্যাহেন চিডি। গয়নার কাছে লেখা একডা চিঠি কথা অইলো চিঠিড়া লেখলো কেডা। শরাফত, এই হাতের লিখাড়া কার? নিশ্চই চিনবার পারছ। দুই জনেই চিনছ। ঠিক কইছি না বাপ!

 

google news logo

 

শরাফত

স্যার, আমি কিছুই কইবার পারুম না ।

গনি

সবার কথা না অয় বাদই দিলাম। আমি তো তোমার মাস্টার। তোমার বাপরে আমি পছন্দ করি না। কিন্তু তোমারে তো আমি আমার ছেলের মতন দেখি। আমার কাছে শরমের কি আছে বাপ। তোমার বয়সই বা কত। ভুল তো মানুষেই করে। স্বীকার করতে দোষ কি?

শরাফত

দোষ! দোষের কথা জিগাইলেন না স্যার। স্বীকার করলেই তো সব ল্যাঠা চুইকা যায়। কিন্তু কয়টা স্বীকার করুম? কতদূর পর্যন্ত স্বীকার করুম। দোষ তো আমার না। দোষ আমার রক্তের। একবার স্বীকার করলেই যে চৌদ্দ পুরুষের গোড়া ধইরা টান মারে। আমার আইজকের একটা দোষ স্বীকারে কি আপনাগো খুব বেশি একটা লাভ অইবো?

নেয়ামত

খবরদার, স্বীকার যাইবেন না বাজান। তাইলে আমার মান-সম্মান কিছুই থাকে না।ফকিরের মাইয়ারে আমি ঘরের বউ কইরা আনতে পারুম না।

শরাফত

(এই প্রথমবারের মতো দৃঢ়তা নিয়ে বাপের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়) বাজান, আমি গয়নারে বিয়া করুম। 

(ছুটে এসে ময়নার প্রবেশ, ওকে উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে।)

ময়না

আর বিয়ার দরকার নাই। নিম গাছের আগায় গয়নার তরতাজা শরীর ঝুলতেছে। গয়নার গলায় ফাঁস পড়ছে। (সবাই ছুটে যায়) বাজান, বাজান আমি বেবাক দেখছি। গয়নার কামড় খাওয়া জিভ দেখছি। কুঁচকানো শরীর দেখছি। খিচানি খাওয়া চোয়াল দেখছি। চোখ ফাইট্যা ভিতরের মনি দুইটা পাতার গোড়ায় ভাসে। বাজান, বাজান আমি বেবাক দেখছি। গয়নার ভিতরে আমি আজরাইলের সুরত দ্যাখছি।

গনি

চুপ কর মা, চুপ কর। তুই ডরাইছস। ঐ সব কিছু না। সাহস আন মনে – (ভিতর থেকে গয়নার লাশ নিয়ে ঢোকে। সবার হাতে শেষকৃত্যের সরঞ্জাম। সাদা কাপড়ে ঢাকা গয়নার শরীর। দূর থেকে করুণ সুরে কোরান তেলাওয়াত, ময়না ভয়ে আরও কুকড়ে যায়) 

ময়না

এইডা কি? এইডা কি বাজান? কিয়ের আওয়াজ পাওন যায় ।

গনি

কই! কিছু না তো!

ময়না

ঐ তো! হুন, হ্যাঁ হ্যাঁ। ঐতো।

গনি

ও কিছু না মা। তোর শোননের ভুল

ময়না

মগর আমি যে পরিষ্কার হুনবার পাই। অনেক দূর থেইক্যা, কেডায় ডাকে বাজান। মনে অয় য্যান কাউরে ডাকে। কারে ডাকে বাজান? ক্যান ডাকে? (মজনু, বারেক ও শমসের ঢোকে)

গনি

তুই ঘরে যা মা। তোর বারেক কাহারে নিয়া যা। আমি একটু পরেই আইতেছি। বারেক, ময়নারে নিয়া যা। 

মজনু

মাস্টার। বেবাক খোয়াবের মতন লাগে। কারে বিশ্বাস করি। নিজেরে? না-

শমসের

চুপ। নিমাই কাহা ।

(নিমাই ঢোকে, উদভ্রান্ত)

মজনু

কাহা, ও কাহা । কি অইছে আপনার? অমুন কইরা এক দৃষ্টিতে কি দ্যাহেন? 

নিমাই

কিছু না। কিছু না। একে একে সবাই চলে যায়। আমার যাওনের রাস্তা নাই। গোরস্থানের তাজা শকুন আমি নিজের ছাওয়ালের মাংস ঠোকরাইয়া ঠাকরাইয়া খাই। 

মজনু

কাহা । আমার কিন্তু বিশ্বাস অয় না। সত্যিই কি কিছু দ্যাহেন?

নিমাই

হস্। আবার।

মজনু

কি

নিমাই

সাপের লাহান কি য্যান আগাইয়া আসে শব্দ করে না। এই দেখি, এই দেখি না। আতকা আওয়াজ হুনি ফোঁস, একবার মনে অয় কারো দীর্ঘ নিশ্বাস, আবার মনে অয় কোনো জন্তুর ফোঁস ফাঁস। সামনে, ডাইনে, বাঁয়ে, পিছনে চক্ষু ঘুরাই। নাই,কিছু নাই । কিছুই যদি নাই তয় কিয়ের আওয়াজ পাই। এই দেখি এই নাই। চক্ষের পলকে কোথায় পালায়। নিশীথ রাইত। মানুষ নাই। জন নাই। একটা পশু পাখির নড়ন চড়ন পর্যন্ত নাই।

গাছ গাছালিগুলা পর্যন্ত নিশ্বাস ফেলতে ভয় পায়। তয় কিয়ের শব্দ পাই? আকা সারাটা শরীর শিরশির কইরা উঠে। কানের পর্দা ফাইট্যা পড়ে বাজ। আওয়াজ মজনু। কেবলই ভাঙ্গনের আওয়াজ। আক্রোশের হুঙ্কার, সেই মিশমিশ্যা কালা অন্ধকার কইলজা ফানা ফানা কইরা কাউরে য্যান ডাকছে। আচমকা দেখি- না, নদীর পাড় ভাঙছে। (পজ) গয়নার দারুন শ্যাষ ?

গনি

নিমাই

যাই ।

মজনু

কই যান?

নিমাই

ঐখানে। (চলে যায়)

গনি

মজনু, বিশ্বাসের ভিটা মাঝে মাঝে আলগা অইয়া যায় ক্যান?

 

গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক

 

মজনু

ঈমানের জোর কম বলে।

গনি

ঈমান মানেও তো বিশ্বাস, তয়?

মজনু

ভিতটা শক্ত কর। কথাতো মাস্টার পরিষ্কার। ভাল কাম কর। আখিরাতে ভাল ফল পাইবা খারাপ কাম করবা 

গনি

দোজখে যাইবা, তাইতো?

মজনু

গনি

আর বেহেশত মানেই তো চৌথা দরিয়া, শারাবান তহুরা-মাইনে লোভ। যে আখিরাতের কাম করে, সেও ঐ লোভই করে। আমিও দুনিয়ার কাম করি বাঁচনের লোভে। ভেদটা কোন জায়গায়?

মজনু

পরথমটা অনন্তকাল আর শেষেরটা ক্ষণকাল ।

গনি

দোনটাই লোভ। লোভ মানেই পাপ । দুনিয়ায় লোভী অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভাইঙ্গা নিজের ফায়দা লুটে। আর আখিরাতের লোভী দুনিয়ার রস থেইক্যা নিজেরে বঞ্চিত কইরা সারাটা জীবন মইরা থাকে।

মজনু

মাস্টার, তোমার বিশ্বাস তোমার। আমার বিশ্বাস আমার। (প্রস্থান)

গনি

হ্যাঁ মজনু। আমার বিশ্বাস আমার। কারণ আমি গনি মিয়া। জমিদার। (চলে যেতে শুরু করে । হঠাৎ করে উদভ্রান্ত শরাফতকে দেখে একটু ভয় পায়। )

গনি

কেডা? 

শরাফত

আমি

গনি

আমি।

শরাফত

শরাফত

গনি

ও তুমি শরাফত।

শরাফত

গনি

কোইথেকে আইতেছ?

শরাফত

ঐখান থেইক্যা।

গনি

আ। তো আমারে কিছু কইবা?

শরাফত

আমি আপনার লগে যামু।

গনি

আমার লগে?

শরাফত

আপনার লগে ।

গনি

(ভয় পেয়ে) ক্যান বাজান?

শরাফত

আমার কিছু কথা আছে।

গনি 

দেখ বাবা, সালিশে যা কিছু হইছে— 

শরাফত

এই যে এতবড়, এতবড় একটা ঘটনা ঘটলো-

গনি 

আমার দোষ নাই বাজান। এ ছাড়া আমার অন্য কোনো রাস্তা ছিল 

শরাফত 

তার পরেও বাঁচনের কোনো রাস্তা থাকে? (নিজের প্রতি আক্রোশ) 

গনি

গণি মাথা গরম কইরোনা শরাফত। মাথা ঠাণ্ডা কর।

শরাফত 

আর কেউনা। শুধু একজন। শুধু একজন, সে ময়না। ময়না জানতো-

গনি 

না বাজান। বিশ্বাস কর। ময়না এসবের কিছু জানে না। ময়নার কোনো দোষ নাই । 

[গনি মিয়া একদিন ৬ষ্ঠ শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান]

শরাফত

ময়না জানতো তার সব কথা। জানতো তার সাধ, আশা। 

গনি 

তুমি ময়নার দোষ নিওনা বাপ, ও আমার মা মরা মাইয়া, তার কোনো ক্ষতি কইরো না ।

শরাফত 

আমি শুধু ময়নারে কমু আমি ভাল না, বদমাইশ, জোচ্চর, খুনি।

গনি 

বাজান, তোমার যা কওয়ার আমারে কও। যা করার আমারে কর। ময়নারে না।বিশ্বাস কর। ও নির্দোষ।

শরাফত

তারপরেও আমি মানুষ। আমার মধ্যেও কান্দন আছে, মায়া আছে, মমতা আছে। ময়না, যদি কোনোদিন তার সাথে তোর সাক্ষাৎ হয়, যদি কোনো দিন অরে খোয়াবেও দেখিস কইছ, আমি অরে নষ্ট করছি। আমি অরে ভালোবাসছি। আমার কষ্ট, আমার যন্ত্রণা, আমার দুঃখ, আমার বেদনা, আমার ভালোবাসা, আমার পাপ সব একাকার ঐ ফলবতি বৃক্ষে। যেই বৃক্ষ ছায়া দেয়, স্বস্তি পায় না। ফল ধরায়, রাখতে পারে না। (কান্না)

গনি

ছিঃ ছিঃ। আমি কি ভাবলাম, কি মনে করলাম। অন্তরের এই দীনতা আমি ঢাকুম ক্যামনে? তাইলে কি এত দিনের সঞ্চিত বিশ্বাস, এত অহঙ্কার সব মিথ্যা? তাইলে কি এইটাই ঠিক, মনুষ্যত্ব আর সততার খোলস আজীবন আমি লালন কইরা চলছি আর একজন ভণ্ড, লোভী, ফাঁকিবাজ, নীচ, হীন, দরিদ্র গনি মিয়া? কোনটা ঠিক। আমি? না খোলস? (শরাফতের কাছে গিয়ে) বাবা শরাফত, তোমার শরীর খারাপ বাবা, মনের ওপর বহুৎ ধকল গ্যাছে। যাও, বাড়ি যাইয়া বিশ্রাম নাও। কাইল সকালে বাড়ি আস। তোমার লগে অনেক গল্প করুম নে, যাও বাবা (শরাফত চলে যায়। অন্ধকার।)

 

 

গনি মিয়া একদিন নাটক :  ৭ম শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৭ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান
গনি মিয়া একদিন ৭ম শ্লোক [ নাটক ] এস এম সোলায়মান

 

প্রযোজক দল : ঢাকা পদাতিক

প্রদর্শনীর স্থান : মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকা

কুশীলব

নিমাই :  জন মার্টিন

গনি মিয়া : এস এম সোলায়মান

মজনু : মিজান মুহাম্মদ শাহীন

নেয়ামত : মধু

শরাফত : নাদের চৌধুরী

শের আলী : মিজান

জামাত মোহাম্মদ: আশীষ খন্দকার

শমশের : আখতার

বারেক : মুকুল

ময়না : ফেরদৌসী হাবীব চিঠি

গয়না : মৌসুমী

জনৈক :  শাহ আলম কবীর, দেবাশীষ বড়ুয়া, শাহীন, মনসুর, দিলান,রিপন, জর্জ, বুলবুল

গয়নার বাপ : জহির আহমেদ

পিয়ন : শেখ শানে মাওলা

 কলাকুশলী

নির্দেশনা : এস এম সোলায়মান

মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : জামিল আহমেদ

সহকারী : হাবিবুর রহমান, সুনীল বাবু

আলোক নিয়ন্ত্রণ :  কামরুল হাসান স্বপন

পোষাক ও পোস্টার ডিজাইন : অশোক কর্মকার

মঞ্চসামগ্রী :  মিজান

গীত ও সুর : এস এম সোলায়মান

বটগাছ নির্মাণ : হাবিবুর রহমান

আলোকচিত্র : আমিনুর রহমান আজম

 

গনি মিয়া একদিন ৭ম শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৭ম শ্লোক

 

গনি মিয়া একদিন ৭ম শ্লোক

(আলো জ্বললেই দেখা যাবে মজনু বটগাছের তলায় বসে একা একা পুঁথি পড়ছে)।

মজনু

হিসাব করিয়া দ্যাখ দোজখ আছে সাত 

মরনের পরে কেচ্ছা শোন মেরা বাত

সব দোজখ হইতে বড় দোজখ হাবিয়া

আগুনের দোজখ ভাল হিমলা চাহিয়া (ময়নাম ঢোকে)

গুনাহ করে পাপীগনে রবে এরা সারে 

বাচ্চা রবে আজাবেতে আগুনের জিজিরে

আগুনের জিঞ্জিরে তারা কয়েদ হইবে

আগুনের কুণ্ডেতে তারা হামেশা জ্বলিবে (শরাফত ঢোকে) 

পরনারী সম্ভোগ করিবে যে লোকে

দোজখের মালিক যখন দেখিবে তাহাকে 

আগুনের মুদ্‌গর তার মাথাতে মারিবে।

দোজখের নিচে তারে লইয়া ফিরিবে 

নিয়া গিয়া লটকাবে জিভেতে বান্ধিয়া

সাপ বিচ্ছু দিবে কত পায়েতে লাগাইয়া।

ময়না

শরাফত ভাই ।

শরাফত 

কিছু কবি?

ময়না

কই গেছিলা?

শরাফত

গোরস্থানে।

ময়না

শরাফত

কাসুর খবর কি ময়না ?

ময়না

ভাল।

শরাফত

আইতেছে কখন?

ময়না

পরীক্ষা তো শেষ। বোধ অয় এই মাসেই।

শরাফত

তোর কপালডা হাছাই ভালা। গয়নার বড় সখ ছিল। তোর লগে কিছুদিন গিয়া ঢাকা থাকবো।

ময়না

সখতো আমারও ছিল। হেরে নাইয়র নিয়া যামু। কত কি করুম। হাছাই কইছিল গয়না। অত আশা করাটা ভালানা । 

শরাফত

আমিও বোধ হয় চইল্যা যামু।

ময়না

কই?

শরাফত

ঢাকা। ভাল্লাগেনা। রাত্রে ঘুম অয়না একফোঁটা। মাথার মধ্যে খালি চব্বিশ ঘণ্টা দাউ দাউ কইরা আগুন জ্বলে। এক এক সময় ইচ্ছা হয়, গয়নার মতন আত্মহত্যা করি।

ময়না

আত্মহত্যা করতে সাহস লাগে। তোমার সাহস নাই। পারবানা।

শরাফত

হাছাই কইছস। আমার সাহস নাই। (পজ) আইচ্ছা ময়না। যারা গলায় ফাঁসি দ্যায় হেগোর বেশি আজাব হয় না?

 

গনি মিয়া একদিন ৭ম শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৭ম শ্লোক

 

মজনু

ফেরেশতা আগুনের গোর্জ মারিবে মাথায়

না মরিবে ছারখার হইবে সেখায়

কাহারে করিবে আজাব ফেরেশতা পেটেতে

নাড়ি ভুড়ি বাহির তার হবে পেট হতে

পানি বিনে তাহারা হয়রান হইবে

ফেরেশতা জাহেমের পানি খাইতে বলিবে

দুরন্ত পিয়াসে সবে সেই পানি পিবে

গোস্ত পোস্ত কলিজা সব গলিয়া পড়িবে

আরো আছে শোন সবে শোন দিয়া মন

যেই নারী পর পুরুষ করিবে আপন

আধা ছেলে পেটে রবে আধা বাহির হবে

পেটের যত নাড়ি ভুড়ি ছিটকায়ে পড়িবে। 

(শরাফত ইতোমধ্যে চলে গেছে। ময়নার চোখে দোজখের বীভৎসতা। পুঁথির শেষে নিমাইকে দেখে চিৎকার করে উঠে, মজনু ছুটে আসে, নিমাই হতভঃ) 

মজনু

ময়না, ঐ ময়না, কি অইছে রে তোর। ওমা তুই তো দেখি মিরগি রোগীর মতো কাঁপছস। কি ডরাইছস?

(ময়না চারদিকে তাকায়। আশ্বস্ত হবার চেষ্টা করে) কি দ্যাখছস মা? 

নিমাই

মজনু! এই ময়না মনে অয় আমারে দেইখ্যাই ডরাইছে।

মজনু

কি মা? কাহারে দেইখ্যা ডরাইছস?

ময়না

কি

মজনু

কাহা। আপনিও দিনকে দিন যে কি অইতেছেন। সময় অসময় যেইখানে সেইখানে ঘুইরা বেড়ান। আর আপনার মুখের তো কোনো ট্যাকস নাই। যখন যা ইচ্ছা কইরা বেড়ান।

নিমাই

আমি কি করলাম বাপ? জ্ঞানত কোনোদিন কারো কোনো ক্ষতিও তো করি নাই। 

ময়না

আপনি ক্ষতি করেন না, কিন্তু আপনাকে দেখলে ক্ষতি অয়। আইজ ময়না আপনারে দেইখ্যা ডরাইছে, গত পরশু শামছুর পোলা ছোড় পোলাপান তো আপনের ডরে অস্থির। অরা তো ছোড়। রাইতের বেলায় আপনারে দেখলে আমার নিজের শরীরেই কাঁপন ধরে। (পজ) মনে কিছু নিয়েন না কাহা। মানুষের ক্ষতি কইরা কি লাভ। আপনি ঘর থুনে বাইর অইয়েন না। গিরামের মানুষ কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপতেছে। (প্রস্থান)

নিমাই

মানুষ মরলে পচে। আমি বাঁইচ্যা থাইক্যাও পইচ্যা গেছি। সারা শরীরে আমার বিষাক্ত দুর্গন্ধ। আমি মানুষ। অথচ মানুষই আমারে দেইখ্যা ভয় পায়। ঘাটের মরা আমি হায়রে সাধের মানব জীবন। শেষতক এও আমারে দেখাইলা 

(ময়না ঐ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। গান পারে লয়ে যাও আমায়। ধীরে ধীরে নিমাইয়ের প্রস্থান। গনি মিয়া খুব উচ্ছাস নিয়ে ঢোকে)

গনি

ময়না

ময়না

কি, বাজান!

গনি

সুখবর আছে মা। আমার যে কি খুশি লাগতেছে।

ময়না

কি খবর বাজান।

গনি

আমার কাসু আইতেছে। খবর পাইছি। পাক্কা খবর। এই মাসের শেষের আইয়া পড়বো। ঠিক করছি, গোটা গিরামের মানুষরে দাওয়াত কইরা খাওয়ামু। তিন দিনের গান বাজনার উৎসব করুম। দুই মোদি আর বিয়ার দিন।

ময়না

গয়না বড় আশা করছিল—

গনি

আমি আর দেরি করুম না। বুঝস না? হে তো উকিল মানুষ। কত ব্যস্ত থাকবো। চাইর পাশে শত শত মক্কেল। হ। এই মাসই বিয়ার কামটা সারলেই তয় আমার শাস্তি। অমন সোনার টুকরা ছাওয়াল। অইবো না? নিজের হাতে পিটাইয়া মানুষ করছি না?

ময়না

বাজান। আমার খালি ডর করে।

গনি

কিসের ডর মা?

ময়না

গয়নার মনেও তো কতো আশা ছিল, শ্যাষ শ্যাষ-

গনি

 তুই কিয়ের লগে কি মিলাস মা? কই আসমান আর কই জমিন। সাহস রাখ মা,সাহস রাখ।

ময়না

কি জানি। আমার কিছু ভাল লাগে না। খালি মনে অয় সারাক্ষণ হে আমার লগে ঘুরঘুর কইরা ঘুইরা বেড়ায়।

গনি

ঠিকই ছাঁকাইয়া ধরছিলাম নেয়ামত মণ্ডলরে। বহু বছরের আক্রোশ। মাঝখান দিয়া মাইয়াটা গলায় ফাঁসি দিয়া সর্বনাশটা ঘটাইয়া দিলো ।

ময়না

গয়না কার সর্বনাশ করলো বাজান? তোমার না? হায়রে স্বার্থ, লোভ! তোমার যদি সর্বনাশ হয় তয় গয়নারটা কি? তোমার একবারও মনে অইলো না এতবড় একটা কেলেঙ্কারির পর গয়না বাঁচতে পারে না। আইজকা গয়নার জায়গায় যদি আমি অইতাম। কি করতাম বাজান?

গনি

ময়না?

ময়না

রাগ খালি তোমার একার না। রাগ আমারও আছে। তুমি যতবার রাগবা আমি ততবারই কমু ৷ গয়নার মরনের কারণ শুধু শরাফত না। তোমরাও। কারণ তোমরা শালিস করতে যাও নাই, নিজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে গেছিলা।

(ময়না রেখে চলে যায়, গনি মিয়া বটগাছের সাথে কথা বলে) 

গনি

গয়না? গয়না কেডা, আমার লগে কিয়ের সম্বন্ধ। ঐ রকম কত হাজার হাজার গয়না জন্মায় আর মরে তাতে কার কি আসে যায়। অরা পুটি মাছ অইয়া জন্মায় আর বোয়াল মাছের আহার জোগায়। আমি পুঁটি মাছ না জলজ্যান্ত হাংগর। পুকুরের যান বাঁধা ঘাট না আমার লক্ষ্য সমুদ্দুর। আমার আশাও সমুদ্দুর। ছোড বেলায় পড়ছিলাম । অহনো পড়াই।

ঘোড়ায় চলিল, আছার খাইল, আবার চলিল, উঠিয়া দৌড়িল। কাপড় খসিল, আসন নড়িল। শরীর কাঁপিল, জড়িয়া ধরিল। সাহস বাড়িল, চড়িতে শিখিল । এইডাই শ্যাষ কথা। একটা পাগলা ঘোড়ারে বশ মানাইতে গিয়া সারাটা জীবন কাটাইয়া দিছি সাহস বাড়ছে। বশও মানছে। দুই হাতে শক্ত কইরা ধইরা রাখছি তার লাগাম। অহন তো আগানোরই সময়। কাসু এই মাসেই। আইতেছে। এই সমাজের নিরীহ জন্তু গনি মিয়া মাস্টারের দিন শ্যাষ।

সামনের দিন আলা মিয়ার নাতি গনি মিয়ার। দশ গিরামের মাথা গনি মিয়া। আবার গাছের আগায় আগায় সোনালি ধান, চলন বিলের সমুদয় মাছ, বিস্তৃত সরিষার ক্ষেত, পশ্চিমের গজারির বন, সুপারির বাগান, সোনার গড়াগড়ি জমিদার বাড়ি, বেবাক কিছু আমার। (নেপথ্যে মাস্টার। ও মাস্টার)

 

গনি মিয়া একদিন ৭ম শ্লোক
গনি মিয়া একদিন ৭ম শ্লোক

 

গনি

কেডা. (শের আলী ও জামাত ঢোকে)

শের আলী

দ্যাখেন মাস্টার কারে নিয়া আইছি।

গনি 

আরে। জামাত মোহাম্মদ সাব। কি সৌভাগ্য আমার আপনি আমার বাড়িতে?

জামাত

 যাক, দুশ্চিন্তা মুক্ত হইলাম ।

গনি 

দুশ্চিন্তা। কিয়ের দুশ্চিন্তা।

জামাত

 

শের আলী । এক মিনিট। (এক পাশে নিয়ে যায়) আপনার এখানে আসিবার পূর্বে আমি বড়ই শঙ্কিত ছিলাম। পাছে আপনি আমাকে লেদা বলিয়া সম্বোধন করিয়া বসেন।

গনি 

ছিঃ ছিঃ কি যে বলেন। ঐদিন আমি—

জামাত

বেশি আবেগ তাড়িত হইয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সমাজপতিদের বেশি আবেগতাড়িত হওয়াটা অবাঞ্ছনীয় । কঠোর এবং বাস্তববাদী হইয়া সব কিছু ডিলিং করতে হইবে । তবে হ্যাঁ যদি খুব বেশি করিয়া বাল্যবন্ধুর কথা মনে পড়ে তবে আড়ালে আবডালে কানের কাছে মুখ রাখিয়া চুপ করিয়া লেদা বলিয়া ফেলিবেন। তবে সবার সামনে স্ট্যাটাস বজায় রাখিতে হইবে। অর্থাৎ তুমি নয় আপনি এবং লেদা নয় জামাত মোহাম্মদ। বুঝিয়াছেন?

গনি 

জি

জামাত

আসেন শের আলী। প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শেষ করিয়া লই

গনি 

জামাত সাব। চলেন ভিতরে যাই। একটু বসি।

জামাত

নষ্ট করনের মতো সময় আমার হাতে নাই। টাইম ইজ মানি। (ময়না ঢুকে, হাতে গনির প্রয়োজনীয় কোন কিছু)

ময়না

বাজান তোমার (অন্যদের দেখে চুপ করে যায়) 

গনি

ময়না, এই দিকে আয় মা জামাত সাব, আমার একমাত্র মাইয়া ময়না। আপনেরে তো কইছিই। সামনের মাসে ইনশাআল্লাহ্ বিয়া। 

হাল

শোকর আলহামদুলিল্লাহ। শুনিয়া অত্যন্ত প্রীত হইলাম। মেয়ে আপনার যথার্থই ভাগ্যবতী।

গনি

আপনাগো দশজনের দোয়া। ত ঠিক আছে মা, যা।

জামাত

ছেলে ওকালতি পাশ করিবে এইবার।

গনি

জি

জামাত 

একটা উকিল জামাই পাশে থাকিলে চিন্তা কি, কি বলেন শের আলী।

শের আলী

আল্লায় মাস্টারের কপাল ফিরাইছে। হাজার হোক জমিদারি বংশ। 

জামাত

আমি অযথা এতদিন নেয়ামত মণ্ডলের পিছনে সময় নষ্ট করিলাম। উহার জনপ্রিয়তা দেখি শূন্যের কোঠায়। পলিটিক্‌স একটা কথা আছে—কনডম মাল নিয়া টানা হেঁচড়া করিতে নাই। কাজে কাজেই নিয়ামত মণ্ডল বাদ। এইবারে ফ্রেস রিক্রুটম্যান্ট। গনি মিয়া মাস্টার। নামের শেষটায় ক্যামন একটু দুঃখ দুঃখ ভাবটা চাংগা করিয়া দেওয়া যায়, ঠেকায় কে ফর্মুলায় ফেলিয়া ইহাকেও ডিগনিফাইড ব্যবসায় রূপ দেয়া যায়। মাস্টার।

গনি

বলেন।

জামাত

সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ৷

শের আলী 

কি সিদ্ধান্ত ?

জামাত

গিরামের পরবর্তী চেয়ারম্যান গনি মিয়া মাস্টার। এখন হইতেই প্রচারণার কাজ শুরু করিয়া দেয়া ভালো । শর্ত কিন্তু একটাই । আপনার পরেই কিন্তু আমার ইলেকশান।

গনি

জামাত সাব। আপনি খালি আমার দিকে একটু সুদৃষ্টি দ্যান। আমার টাকা নাই । কিন্তু জনসমর্থন আছে। আপনার ইলেকশানে আমি জানপ্রাণ দিয়া খাটুম। এই তো বুঝিয়াছেন। গিভ এন্ড টেক দেয়া এবং নেয়া, ব্যবসার প্রথম শর্ত। আমি নিশ্চিত, আপনাকে মানুষ বানানো যাইবে। ঠিক আছে। অতি সত্ত্বর আপনার ইলেকশনের বাজেট ঠিক করিয়া আমার সহিত দেখা করিবেন । 

গনি

আপনার বহুৎ মেহেরবানি।

জামাত

আর একটা কাজ। এলাকায় কয়খান স্কুল, কয়খান মাদ্রাসা, এতিমখানা, ক্লাব আছে, তাহার একটা লিস্টি নিয়া যাইবেন। আমার ইলেকশানের পূর্বে ঐ সমস্ত জায়গায় এন্ট্রি নিতে হইবে তো আর কোন প্রতিষ্ঠানে কতো টাকা দান করা যায় তাহারও একটা আনুমানিক হিসাব নিয়া আসিবেন।

 

google news logo

 

গনি

ইনশেআল্লাহ। আর জামাত সাব।

জামাত

বলেন।

গনি

আমার সম্পত্তির ব্যাপারটা?

জামাত

জামাই বাবাজি ফিরিয়া আসিলেই শক্ত করিয়া একটা পিটিশান লিখিয়া দিবে। উকিল মানুষ। প্যাঁচগোঁজ ভালোই বুঝিবে। বাদবাকি তদবিরের কাজ আমার হাতে ছাড়িয়া দিবেন।

গনি

আপনার দয়ার কথা আমি জীবনে ভুলুম না। 

জামাত

তো! কথা তো শ্যাষ। সব কিছু ফাইনাল। যাইতে পারি এইবার।

গনি

চলেন। আপনারে একটু আগাইয়া দিয়া আসি। (চলে যেতে যেতে, কিছুদূর গিয়ে জামাত ফিরে শের আলীকে বলে)

জামাত

সবুর করেন, সবুরে মেওয়া ফলে। (প্রস্থান) 

শের আলী 

আমি অহন কি করি। গর্দভের মতন খালি সবুর করতে থাকুম । পরবর্তী চেয়ারম্যান গনি মিয়া মাস্টার। অতএব শের আলী, তুমি বইস্যা বইস্যা আঙুল চুষ। তবে আশার কথা, খেলাটা বেশ জইমা উঠছে। আমি আবার ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে পছন্দ করি। নেয়ামত মণ্ডলের দিন শ্যাষ। বাকি থাকে মাস্টার। কোনদিক দিয়া আগাই ।

(প্রস্থান, বিপরীত দিক থেকে গনি এবং ময়নার প্রবেশ) 

জামাত

এই যে মামনি আমার, কি? কইছিলাম না? আমাগো দুঃখের দিন শ্যাষ। জামাত সাব তাই কইয়া গ্যাল। গিরামের মানুষ ধরছে। আমারে চেয়ারম্যান বানাইবার চায়। জামাত সাবে ইলেকশানের খরচ দিবার চায়। আমারে কথা দিছে সব জমিজমা তদবির কইরা উদ্ধার করাইয়া দিবো। আমার যে কি সুখ রে মা। এই মাসেই আইতেছে কাসু। এরপর খালি তরতর কইরা সিঁড়ি বাইয়া ওপরে ওঠা, যতো দ্রুত পারন যায়। যত জোরে ঘোড়া ছুটান যায়।

ময়না

কাসু কোনদিন আইবো বাজান?

গনি

আমার হিসেবে তো দুই চাইর দিনের মধ্যে আইয়া পড়নের কথা । 

ময়না

এতো দেরি করে ক্যান? (লজ্জা পেয়ে) দূর। আমি যে কখন কারে কি কই। তালগোল পাকাইয়া যায়।

গনি

পাগলী মা আমার, হুন মা। জামাই আর তুই তো থাকবি ঢাকা শহরে। আর তোর এই বুড়া ছেইলেটা পনের দিন গিরাম আর পনের দিন তোগর লগে কি থাকতে দিবি না? 

ময়না

বাজান! তুমি না খালি আমার লগে মস্‌করা কর ।

(একজন পিয়ন ঢোকে)

পিয়ন

মাস্টার সাব। আপনের চিডি। (চলে যায়)

ময়না

কার চিডি বাজান? কার চিঠি?

গনি

হু! কি কইছিলাম না? দুই চাইর দিনের মধ্যে আইয়া পড়বো। নিশ্চই আগুনের খবর দিয়া চিডি দিছে। (মজনু যাচ্ছে) মজনু ভাই, আরে ও মজনু ভাই । কই যাও।

মজনু

কামে যাই ।

গনি

ধুর। থোও তোমার কাম। এদিকে আহ

মজনু

অইলোডা কি মাস্টার। বুড়া ময়সে ভীমরতি ধরলো নি। পোলাপাইনের মতন চিল্লাফাল্লা শুরু করলা

গনি

(একটু নীরব থেকে) আরে বও মিয়া, বও। দ্যাহ কার চিডি আইছে।

মজনু

কার চিডি।

গনি

কার আবার। আমার জামাই বাবাজির ।

ময়না

বাজান। তুমি না-

গনি

আমাগো কাসুর।

মজনু

কাসুর চিঠি? পড় দেহি কি লিখছে? (গনি চিঠি খুলে পড়তে শুরু করে)

গনি

“আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন স্যার। প্রথমেই আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম নিবেন।” দ্যাখছ? দ্যাখছ মিয়া? এরেই কয় আদব কায়দা। অইবো না? আমি পিটাইয়া মানুষ করছি না? আমার চল্লিশ বছরের মাস্টারির জীবন। হা

 

 

ActingGOLN.com, Logo, 252x68 px Dark

 

 

মজনু

তুমি পইড়া যাও না।

গনি

“গিরামের মুই মুরব্বিদের আমার সালাম দিবেন। ময়নারে আমার”- কিরে ময়না। পড়ুম।

ময়না

বাজান, তোমারে না আমি-

গনি

আইচ্ছা, তয় থাক । “পর সমাচার এই যে, আমি আপনাদের দোয়ায় ভালো ভাবেই আইন পরীক্ষায় পাশ করেছি।” কেল্লাফতে, মজনু ভাই। জামাই আমার পাশ করছে। উকিল হইছে। আল্লায় মুখ তুইল্যা চাইছে। এইবার? এইবার যাইব কই মণ্ডল বাড়ি আর নেয়ামত মণ্ডল। আমার হক্কের সম্পত্তি। হুঁ।

“স্যার আপনার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারব না। আমি জানি অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করে আপনি আমার পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন।” বুঝলা মজনু ভাই, এরেই কয় ঈমানের জোর।

মজনু

পইড়া যাও ।

গনি

“আমি জানি, এই চিঠি পড়ে আপনি প্রচণ্ড ব্যথা পাবেন। তবুও সত্য যা তাকে কখনো এড়ানো যায় না।”

মজনু

কি অইলো । থামলা ক্যান। পড়।

গনি 

আমার ডান চোখটা হঠাৎ কইরা নাচা শুরু করল ক্যান!

(রেকর্ডে কাসুর গলা ভেসে আসে)

“ঢাকা শহরে থেকে আপনার বদৌলতে পড়াশোনা করে পাশ করলাম। গ্রামের কাসু এই শহরে এসে কদ্দুর কি শিখেছে জানি না। তবে তার আকাঙ্ক্ষার পরিমাণ এখন গগনচুম্বী। দেশের গণ্ডি পার হয়ে সুদূর আমেরিকার উচ্চ ডিগ্রি আমার এখনকার একমাত্র ধ্যান, একমাত্র স্বপ্ন দোষ নেবেন না স্যার।

আমি বহুবার বহুভাবে গ্রামের কাসুকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি, পারি নি। কারণ এরি মধ্যে আমারি খোলসে আর এক নতুন কাসুর জন্ম হয়ে গ্যাছে। আমাদের সেই গ্রাম, পরিচিত পরিজন টুকরো টুকরো স্মৃতি, নাকি বিস্মৃতি বলবো সবই এখন দুঃসহ অতীত। আপনারা যেই কাসুকে চিনতেন, এই শহরের জনারণ্যে তার মৃত্যু ঘটেছে।

অনেকবার নিজের কাছে নিজে জানতে চেয়েছি কার ভুলে এতোবড় সর্বনাশটা হলো। পরে দ্যাখলাম, ব্যাপারটা আর কিছুই না, সময় এবং অবস্থানের ব্যবধান। জানি, ক্ষমা পাবো না। তবুও বলছি, সম্প্রতি আমি আমার এক সহপাঠিনীকে বিয়ে করেছি “

(মাস্টারের হাতে দুমরানো মোচড়ানো চিঠি। হতভম্ভ হয়ে ময়নার দিকে তাকিয়ে আছে, ময়না মজনুর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কোরাসের হামিং।)

ময়না

মজনু ভাই, তোমার বেহেশতি পুঁথিটা আমারে একটু পড়াইয়া হুনাইবা। ঐ যে-“সেই চার দরিয়ার, শোন কহি সমাচার, জানো এই পানি আছে ভরা আল্লাহ তালার মেহেরেতে, দুয়েম দরিয়া তাতে, জানিবে তায় দুধ আছে পুরা। কিংবা “তেছরা দরিয়ার বিছে, শারাবান তহুরা আছে, এ সকল বেহেশতি নিয়ামত, চৌথা দরিয়ায় শুধু কেবলি জানিবে মধু, দোছরা নাম বলেত সহদ ক্যামন গরগর কইরা গ্যালাম না? বাজান, তোমার মনে পড়ে?

খুব ছোড কালের কথা। কতই বা বয়স তখন, ইস্কুলের পড়া একদম মুখস্ত করতে পারতাম না, তা নিয়া বাজানের সেকি রাগারাগি। একদিন তুমি আমারে কইছিলা – পড়া মুখস্ত করতে পারলে একটা ময়ুর পঙ্খি কিনা দিবা। মারা রাইত আমি ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে মুখস্ত করলাম- পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল, কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল। সকালে ঘুম থেইক্যা উইঠা পড়লাম, “পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল। কাননে কুসুম কলি ঝরিয়া পড়িল ।” ভুইল্যা গেছি।

বেবাক খাইয়া বইস্যা আছি। হেই দিন আমারে তুমি খুব মারছিলা দ্যাহ, হাত দিয়া দ্যাহ, হেই মাইরের দাগ অহনো আছে। বাজান, আইজকে কিন্তু আমি পুরা মুখস্ত পারছি। মজনু ভাইরে জিগাও । এক তিল ভুল অয় নাই। আইজকে ময়ূর পঙ্খি যদি না পাই ভয় তোমারে আমি ছাড়ুম না। জিগাও, আবার জিগাইয়া দ্যাহ, পরথম দরিয়ায় দুধেল সায়র, দোছরা দরিয়ায় শারাবান তহুরা, তেছরা দরিয়ায় বেহেশতি শরবত, চৌথা দরিয়ায় অমৃত মধু।

কি বাজান? পারছি না? (হাসতে থাকে) তোমারে তো আগেই কইছিলাম, অত খোয়াব আমারে দ্যাহাইও না। তোমার কি. তিন কাল গিয়া শ্যাষ কালে ঠেকছ। কিন্তু আমি? বাজান, তোমাগো কাসু মিয়ারে লিইখ্যা জানাও। ময়না ঢাকায় আইতেছে। (প্রস্থান)

 

ActingGOLN.com, Logo, 252x68 px White

 

 

গনি

আমার চল্লিশ বছরের মাস্টারির জীবন। সারাটা জীবন আমি গাধা পিটাইয়া মানুষ করছি। মজনু ভাই তোমার পুঁথির কোথাও কি একটু লেখা নাই, কি করলে এই জীবনটা আরো দীর্ঘ করা যায়। এ তো বড় কম সময় রে মজনু। না হয় আমি আর একবার আরো সাবধানে পা ফেইলা চেষ্টা কইরা দেখতাম যদি পারন যায়। অথবা এমন কোন কাজ যা করলে আবার মানুষ রূপে পুনর্জন্ম নেয়া যায়, তেমনি কিছু করা, এমন কিছু কি নাই যা করলে, না কি যে বলি না বলি। (প্রস্থান এবং শের আলী ঢোকে)

শের আলী

মজনু তাই

মজনু

কও।

শের আলী

সামনের দিনটা কিন্তু আমার নেয়ামত মণ্ডল শ্যাষ। মাস্টারও যায় যায়। এরপরেও আগানটা কি ঠিক অইবো।

মজনু

কি কও, না কও মিয়া।

শের আলী

মাস্টারের কথা কইতেছিলাম, চেয়ারম্যান হওনের ইচ্ছা এখনো রাখে? 

মজনু

রাখবো না ক্যান? অইছেডা কি?

শের আলী

রাখা ভাল, খারাপ না, তয় শনিটা মাস্টারের খুব কাছ দিয়া ঘুরতেছে এবং শেষ চালটাও আমার হাতে, আইচ্ছা চলি। (প্রস্থান) 

মজনু

লক্ষণটা দেখি খুব খারাপ। মাস্টাররে সাহস যোগান দরকার।

(মজনু চলে যায়। ময়না ঢোকে। নিজের ব্যর্থতাকে ঢাকা দেয়ার জন্য অস্বাভাবিক আচরণ। গুনগুন করে গান গাইছে। মুখে সুগন্ধি মাখছে। পরনে তার উজ্জ্বল রংয়ের শাড়ি। ময়নার এমন আচরণ যেন কোথাও কিছু হয় নি। শরাফত ঢোকে ময়নার মুখে গুনগুন গান । কোরাসের কন্ঠেও একই গানের রেশ)

শরাফত

ময়না।

ময়না

উঁ। কি, কিছু কইবা ।

শরাফত

কি করস!

ময়না

ডাংগুলি খেলি।

শরাফত

কাসু চিডি লেখছে না?

ময়না

হ! ।

শরাফত 

কি লিখছে?

ময়না

ওমা! ক্যান, তুমি কিছু হুন নাই? সারা গিরামে ঢি ঢি পইরা গ্যাছে। ময়না অসতী, অনুক্ষণা, এই সেই কত কি!

শরাফত

যাই ক! আমাগো কপালডাই খারাপ।

ময়না 

ক্যান? খারাপের কি আছে। ভাল সব ভাল।

শরাফত

 রং লেইপ্যা কি মন ঢাকন যায়।

ময়না

দূর। ঢাকাঢাকির কি আছে? মেঘ কাটলেই চান। জ্বল জ্বইল্যা পূর্ণিমার রাত। 

শরাফত 

কাইল রাতে না গয়নারে আবার খোয়াবে দ্যাখলাম।

ময়না

আমারে একটু দ্যাখলা না?

শরাফত 

(অবাক হয়ে) তোর অইছেডা কি একটু কইবি আমারে।

ময়না

আইচ্ছা। ভাল কথা। তুমি না কইছিলা, একদিন ঢাকা শহরে চইল্যা যাবা ।

শরাফত

 হুঁ।

ময়না

আমারে সাথে নিবা?

শরাফত

এইডা কি সম্ভব রে পাগল?

ময়না

ক্যান। অসম্ভব অইবো ক্যান। আমি তোমার লগে যামু। (পজ) কিছু না। খালি কয়েকটা দিন আমারে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া ঢাকা শহরটা দেখাইবা। আমি এখান থেইক্যা চিল্লান দিয়া কমু, গয়না, তুই যা কইছিলি মিছা। দ্যাখ হাছাই আমি দুধেল দরিয়ার পিছে বইয়া তেছরা দরিয়ার শরাবান তহুরার সুগন্ধি পাইতেছি। থোকা থোকা আঙুর ফল, বেহেশতি মেওয়া — শরাফত ভাই। আমারে যাইতেই অইবো, কও, কও নিবা আমারে?

 

ActingGOLN.com, Logo, 252x68 px Dark

 

শরাফত

ময়না, আমি তো আমারে চিনি, আমার ডর করে, হাছাই ভর করে, পাছে তোরেও আমি নষ্ট কইরা ফেলি ।

ময়না

নষ্ট। কিসের নষ্ট, কার নষ্ট। বেহেশতের হুর পরীগো লগে এত অবাধ মিলামিশা কইরা বেহেশতবাসী সুফি বান্দা নষ্ট অয় না। দুইন্যাতে তুমি আমি এক লগে থাকলেই নষ্ট অমু? শরাফত, নষ্ট মনে করলে নষ্ট। মনে না করলে কিছু না। সব কথার শেষ কথা, আমি পৌঁছাইতে চাই।

শরাফত

হাছাই যাবি? তয় চল। কাইলকেই।

ময়না

না না। কাইল না। অহনি। কাক পঙ্খিও টের পাওনের আগে।

(ওরা দু’জন চলে যায়। নিমাই ঢুকে ওদের গমন পথের দিকে তাকায় এবং বিশ্রিভাবে হেসে উঠে। মঞ্চে অন্ধকার নেমে আসে। একটানা ঝি ঝি পোকার ডাক। আলো জ্বলবে। এখন প্রথম রাতের শেষ দিক। গুটিসুটি মেরে বসে আছে গনি মিয়া। হাতে কাজ করা পুরনো আমলের পাঞ্জাবি, রূপার গড়গড়ি)

গনি

আমার দাদার হাতের নিশানা। আচকান আর পাঞ্জাবি। আচকানটা পইরা দাদা। আমার এইভাবে মাহফিলে বইতো। বিচার আচার করতো কিন্তু টুপি? এই তো, পরলাম, গলায় একখান সোনার চেইন না হলে মানায়? ঠিক আছে। তাও পরলাম । (চিৎকার করে) ঐ হারামজাদা শের আলী, আমার পাম্পসু কই। ও আনছস? ঠিক আছে, যা। (ছেড়া রাবারের জুতাটা পরে) আমার রূপার গড়গড়ি। নেয়ামত। ঐ নবাবের বাচ্চা।

কথা কানে যায় না? সাজা, তামাক সাজা। হু! কি বিশ্রি গন্ধ। হারামির বাচ্চা। তোরে না কতোবার কইছি—দিল্লীর শাহী তামুক সাজাবি আমার জন্য। এই সমস্ত সস্তা তামুক দেখলেই আমার গা উগলায়, চাকর-বাকরদের পিঠে নিজে দোররা না মারলে এরা ঠিক উলটা কামটাই কইরা বসে। হারামির বাচ্চা শুয়রখোর। নামা। নামা চোখ নামা। চাবকাইয়া চামড়া তুইল্যা নিমু না? সাজা, তামুক সাজা। আর একটু দে। হ্যাঁ! ঠিক আছে। (টানে) আহ্! কি আরাম। (ব্যস্তভাবে মজনু ঢোকে ) 

মজনু

মাস্টার। মাস্টার।

গনি

কও!

মজনু

ময়না কই।

গনি

ঘরে নাই ।

মজনু

নাই মানে?

গনি

অহনও ফিরে নাই।

মজনু

তুমি কিছু হুন নাই?

গনি

হুনছি।

মজনু

কি হুনছ?

গনি

ময়না আমার আর এক ছাত্র শরাফতের হাত ধইরা বাইর অইয়া গ্যাছে। 

মজনু

এই দিকে তো নেয়ামত মণ্ডল লোকজন নিয়া দল পাকাইতেছে। লক্ষণ তো ভাল মনে অয় না, মাস্টার।

গনি

আমি কি করুম।

মজনু

আহা! ভালমন্দ একটু খুইজ্যা দেখবা না?

 

ActingGOLN.com, Logo, 252x68 px White

 

গনি

আমার ভাল মন্দের কথা কেডায় ভাবলো মজনু? না, ময়না নামের কেউ আমার কখনো ছিল না। আমি চিনি না। নামও শুনি নাই কোনোদিন। (লোকজন নিয়ে নেয়ামত ঢোকে)

নেয়ামত

এই যে চশমখোর মাস্টার, কই। তোমার ঐ বজ্জাত মাইয়াটা কই। আমার শরাফত কই। আমার দুধের ছাওয়ালটারে মাইয়ারে দিয়া টোপ ফালাইয়া এত বড় সর্বনাশটা করলা। (গর্জে ওঠে) কই। শরাফত কই?

মজনু

শরাফত কই, মাস্টার কইবো ক্যামনে? দুধের ছাওয়াল যখন তয় পরিবারের কাছে গিয়া খবর নিলেই পারেন।

নেয়ামত

চুপ কর মিয়া। এইটা তোমার পাগলামির জায়গা না । কথা কও না ক্যান মাস্টার। জবাব দাও, কই, শরাফত কই। তোর মাস্টারগিরি আইজকে আমি ছুটাইয়া দিমু। ঐ আমগাছের লগে ঝুলাইয়া পিটামু তোরে। (এগিয়ে যায়)

মজনু

(ক্ষেপে গিয়ে) খবরদার চেয়ারম্যান। আর এক পাও আগাইলেই কিন্তু খুনাখুনি অইয়া যাইবো কইলাম । বাড়াও, আর এক কদম সামনে বাড়াও। দেখি তোমার কত সাহস? (নেয়ামত হতভম্ব, মজনুকে কখনো এভাবে রাগতে দেখে নি) আমি তো বুঝি না তোমরা মানুষ না জানোয়ার। মানুষটাতো এমনিতেই আধমরা হইয়া গ্যাছে। আর কত (শের আলী ঢোকে)

শের আলী 

চেয়ারম্যান সাব। ধরা পড়ছে। দুইটা মিইল্যা ঢাকা যাওন ধরছিল। তয় ঢাকা পর্যন্ত যাইতে অয় নাই । গঞ্জেই ধরা খাইছে।

নেয়ামত 

আমার শরাফত? শরাফত কই?

শের আলী

আপনি খালি খালি চিন্তা করেন। আপনের পোলা আপনার চাইতেও সেয়ানা। বাপের নাম রাখছে।

নেয়ামত 

আমিও ছাড়ুম না শের আলী। আমি কাইলকেই সালিশ ডাকুম ।

শের আলী 

অবশ্যই ডাকবেন। আমি জামাত সাবরে খবরটা দিতে গেলাম। কাইলকের সালিশেই সমাপ্তি এবং শের আলী। (প্রস্থান)

নেয়ামত

আপনারা ঐ চশমখোর মাস্টারের বিচার করবেন। সাহস কত। আমার লগে টক্কর দিবার আছে। ঐ চরিত্রহীন মাস্টাররে আমি আর স্কুলে রাখমু না। গনি মিয়া মাস্টারের চাকরি অহন থেইক্যা নট। বাকিটা কাইলকে বুঝমুনে। চলেন সবাই। (প্রস্থান)

মজনু

চিন্তা কইরো না মাস্টার। আমরা অহনো আছি। দেখি, কে কি করবার পারে। তুমি ঘরে যাও। আমি ময়নারে নিয়া অহনি আইতেছি। (প্রস্থান, বটগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। একে একে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে, আচকান, রূপার গড়গড়ি)

গনি

কত বয়স তোমার? একশো? দুইশো? কত ঝড়-ঝাপটা গেছে। তবুও ক্যামন বুক টানটান কইরা খাড়াইয়া আছ। তোমার শরীরের আনাচে কানাচে এখনো ভরা যৌবন পূর্ণিমার চাঁদের মতন ঝিলিক দিয়া হাসে। সাধের জীবন আমার। তোমার মতন দীর্ঘ অইলো না ক্যান? তাইলে তো আমি আবার নতুন কইরে সব কিছু শুরু করতে পারতাম। আইচ্ছা! তোমার এই অসংখ্য শেকড়ের মতন নতুন কইরা আমারে জন্ম দিতে পারো না?

কোনো সাধারণ কৃষাণের ঘরে, অতিরিক্ত আশা যেখানে মানুষরে কলুইর বলদের মতন ঘানি দিয়া টানায় না? মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবন এখনো ভালো করে শুনতে পাইলো না টিনের চালায় বৃষ্টির সঙ্গীত নৃত্য । গাংগের কুলুকুলু ধ্বনি, সমুদ্দের বিশাল নিশ্বাস আর বাদলা দিনের পাগলা বাতাস । শুধু একবার, শুধু একবার আমারে নতুন কইরা জন্ম দাও। আমি মুক্ত বাতাসে পরান ভইরা নিশ্বাস লই। একবার জন্ম দাও আমি আমার কৈশোরের সমস্ত দিন গুলান ফিরাইয়া লই।

একবার জন্ম দাও। আমি মুক্ত বাতাসে পরান ভইরা নিশ্বাস লই। একবার জন্ম দাও আমি আমার কৈশোরের সমস্ত দিন গুলান ফিরাইয়া লই। একবার জন্ম দাও আমি আমার কৈশোরের সমস্ত দিন গুলান ফিরাইয়া লই। একবার, একবার শুধু জন্ম দাও আমি যৌবনের সমস্ত রূপ রস গন্ধে সিনান কইরা দাম্ভিক মানববৃক্ষ হইয়া খাড়াইয়া রই। জন্ম দাও, জীবন দাও।

(গনি মিয়া নুয়ে পড়ে। কোরাসের আবহের সাথে ভেসে আসে কোরান তেলাওয়াত । গনি মিয়া বিড়বিড় করে জীবনের সংলাপ উচ্চারণ করতে থাকে—“জন্ম দাও, জীবন দাও।” মুখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় নিমাইকে, সমস্ত ক্ষোভ যন্ত্রণায় বিভৎস চিৎকার করে পড়ে যায়। কোরাস সাদা কাপড় পড়িয়ে দেয়।) 

গনি

আমার মাটির ঘরে জন্ম যেন হয় গো বারেবার

আমি চাইনারে সুখ দাও ভরা দুখ ওগো অন্তরে আমার।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment