সাত রাজার ধন এক মানিক আমাদের সত্যজিৎ। প্রিয় অড়হর ডাল, সোনা মুগের ডাল। একসময় খুব মাংস খেতেন, পরে সপ্তাহে একদিন। মুরগি খুব পছন্দ করতেন একটা সময়,এখন গা-সওয়া। ভাল ইলিশ,ভাল রুই মাছ ছাড়া অন্য মাছ তেমন পছন্দ করতেন না, তবে ভেটকি মাছের ফ্রাই আলাদা একটা ব্যাপার। ভালবাসতেন না সব্জি খেতে,ব্যতিক্রম কড়াইশুটি। শক্তিগড়ের ল্যাংচা,জয়নগরের মোয়া, রাজস্থানের জিলিপির সঙ্গে মিষ্টির মোস্ট ফেভারিটের তালিকায় আছে নতুন গুড়ের সন্দেশ বোথ কড়া অ্যান্ড নরম পাক।
সত্যজিৎ রায় ধোঁকার অন্ধ ভক্ত, বিশেষত জন্মদিনের বিশেষ পদে। অবশ্য বিখ্যাত হওয়ার পরে জন্মদিনে ভক্তদের এড়াতে গৃহত্যাগ করে অজ্ঞাতবাস করতে হয়। হোটেলে প্রিয় ধোঁকা পেতেন না। লালমোহনবাবু উপস্থিত থাকলে মনে করিয়ে দিতেন তপ্ত বৈশাখ আমাদের উপহার দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ কে,সত্যজিৎ রায় কে। বলা বাহুল্য শেক্সপিয়ারের জন্ম এই বৈশাখে।
সত্যজিৎ রায় নিজে জানিয়েছেন তাঁর জন্ম ভোর রাতে ইংরেজি মতে সোমবার ২ মে,বাংলায় রবিবার ১৯ বৈশাখ।
সত্যজিৎ রায় আক্ষরিক অর্থেই আমাদের সাত রাজার ধন এক মানিক। চাকরি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন। বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে গ্ল্যামার আছে, মাইনেটা সব নয়। যখন পথের পাঁচালী’ ছবি করার সিদ্ধান্ত নিলেন তখনও আদি উপন্যাস পড়া হয় নি। অর্থাভাবে ‘পথের পাঁচালী’ যখন অকাল মৃত্যু নিশ্চিত তখন বিধানচন্দ্র রায়ের সাথে বেলা সেনের মাধ্যমে কিভাবে পরিচয় সেই গল্প আজ হয়ত কারও অজানা নয়। তবে মানিকবাবু কৃতজ্ঞ, তিনি যে চিত্রপরিচালক হতে পেরেছেন, বিজ্ঞাপন অফিসে কাজ করতে হয়নি সব কৃতিত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের।
বাংলা কিন্তু সত্যজিৎ রায় খুব একটা পড়তেন না, শান্তিনিকেতনে গিয়ে সেই অবস্থায় পরিবর্তন হয়। দিলীপ গুপ্ত একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তারাশঙ্করের ‘ কবি’ পড়েছেন কিনা। পড়েন নি শুনে রাগ করে একটা বই এনে উপহার দিয়ে তাতে লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যে যিনি গোল্লাজ্ঞানী সেই সত্যজিৎ রায় কে।
মানিকবাবুর জীবনের অভিধানে ঘোর অপছন্দের ছিল সময় নষ্ট করা। একবার বোম্বেতে প্লেনের সময়সূচিতে গোলমাল হওয়ায় যাত্রা দেড়দিনের জন্য স্থগিত হয় । যাত্রীদের তোলা হল হোটেলে। কিন্তু হোটেলের কামরা তখনও খালি হয় নি। লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে হবে। সত্যজিৎ রায় সময় কাটানোর জন্য কাগজ বের করে পিতা সুকুমার রায়ের ‘ আবোলতাবোল’ ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেললেন। বাংলা কবিতাগুলো স্মৃতিতে ছিল। সেই বই যথা সময়ে বিলেত থেকে প্রকাশিত হয়।
‘পথের পাঁচালী’র পরে গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেল।ক্রমেই জীবিতকালে কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন সত্যজিৎ রায়। আক্ষরিক অর্থেই ‘ পথের পাঁচালী’র বিশ্ববিজয় রবীন্দ্রপরবর্তী বাঙালির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনা।
ইংরেজি ক্যালেণ্ডারে সেদিন ২৬ এপ্রিল, বিকেল পাঁচটা,আর কয়েকটি দিন পরে সত্যজিৎ রায় ৬৯ হবেন। সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত সাহিত্যিক শংকর কে। প্রথম প্রশ্ন ছিল আপনার উচ্চতা কত? খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন ” কয়েক বছর আগে মাপ নিয়েছিলাম -ছ’ফুট সাড়ে চার ইঞ্চি। এখন বলতে পারব না,বুড়ো হাইট কমে যায় বলে গুজব আছে”।
সত্তরে পা এগিয়ে দিয়েও তিনি তখন সৃষ্টির মধ্যগগনে। বলেছিলেন তাঁর কাছে খুব তৃপ্তির বাচ্চাদের রিঅ্যাকশন। ভীষণ ভাল লাগলে ওরা চিঠি দেয়, টেলিফোন করে,ওটা খুব তৃপ্তিদায়ক। আজ বাঙালির সাত রাজার এক মানিক সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সংকলনে : অরুণাভ সেন
তথ্যসূত্র: সত্যজিৎ রায় সাক্ষাৎকার সমগ্ৰ সম্পাদক সন্দীপ রায় সহযোগী সম্পাদক সোমনাথ রায় , নিবন্ধ সত্তরে সত্যজিৎ, সাক্ষাৎকার শংকর, আনন্দবাজার পত্রিকা (১/৫/১৯৯০)