আশিস গোস্বামীর “বাংলা নাট্য সমালোচনার কথা” বইয়ের ভূমিকা

গত পর্বে আশিস গোস্বামীর “বাংলা নাট্য সমালোচনার কথা” বইয়ের বিমলকুমার মুখোপাধ্যায় এর লেখা ভূমিকাটি প্রকাশিত হয়েছিলে। এবার প্রকাশ করা হল জনাব আশিস গোস্বামীর নিজের লেখা ভূমিকাটি। নাটক, অভিনয় সহ সংশ্লিষ্ট সকল মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু জানতে সাহায্য করতে পারে ভেবে আমাদের ওয়েবে যুক্ত করে দিলাম। আশা করি কাজে লাগবে।

ActingGOLN.com Logo 252x68 px White আশিস গোস্বামীর "বাংলা নাট্য সমালোচনার কথা" বইয়ের ভূমিকা

“বাংলা নাট্য সমালোচনার কথা” বইয়ের ভূমিকা – আশিস গোস্বামী

সম্ভবত ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট মঞ্চ। আমি হলে ঢোকামাত্রই শ্রীমতী শোভা সেন বললেন, ‘উৎপল (দত্ত) তোকে ডাকছে। হলে এসেই তোর খোঁজ করেছে।’ আমি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম, কোনো দোষ করে ফেলেছি কি? শোভাদিকে বললাম, আজ তো ‘এপিক থিয়েটার’-এর ‘কল্লোল সংখ্যা প্রকাশিত হবার কথা। সেটা বেরিয়েছে কি? শোভাদি বললেন, ‘হ্যাঁ, তারপরই তোর খোঁজ করেছে।’

ওই সংখ্যাটির কিছু দায়িত্ব আমার ছিল। তাই নিশ্চিত গালমন্দের কথা ভেবেই হাজির হলাম উৎপলদার সামনে। কিন্তু এ কী কাণ্ড! আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর চওড়া বুকের মাঝে তখন আমার নিশ্চিত পুরস্কার প্রাপ্তি—‘এ সংখ্যার সবচেয়ে ভালো লেখা হয়েছে তোমার। তাই লাল সেলাম’। আর কী চাই আমার! এমন মানুষের কাছ থেকে এমন প্রাপ্তি ক’জনের জোটে। ওঁরাই পারতেন এমন ভাবে সব উজাড় করে ভালোবাসা দিতে।

আশিস গোস্বামী
আশিস গোস্বামী

তারপর আমার কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন কোথা থেকে সংবাদপত্রের ক্লিপিংসগুলি জোগাড় করেছি, কোন লাইব্রেরিতে গিয়েছি ইত্যাদি সব। মেকআপ রুমে ঢোকার আগে বললেন, ‘এরকম কাজ ভীষণ জরুরি, ইতিহাসের স্বার্থেই জরুরি, ওই কাজ বড়ো আকারে করো। আমার কানে এখনও অহরহ সেই কথাগুলিই মন্ত্রোচারণের মতো বেজেই চলেছে। আমার বর্তমান কাজটি সেই মন্ত্রোচারণের প্রথম ফসল বলা যেতে পারে।

আমাদের দেশে কোথাও নাট্য সমালোচনা নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। অথচ এই ধারাটিকে বাদ দিয়ে রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসও পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে না। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় মুখোপাধ্যায়-এর মতো মানুষেরা বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছিলেন এবং সেই কাজে সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রেরই সাহায্য নিয়েছিলেন কিন্তু সেই সাহায্যকারী মাধ্যমটি নিয়ে কোনো অধ্যায় রচনা করেননি। তবে তাঁরাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নাট্য সমালোচনা ইতিহাসের স্বার্থে কতখানি প্রয়োজনীয়। আকর গ্রন্থগুলি আশ্রয় করেই আরও অনেক নাট্য ইতিহাস, অভিনয়ের ইতিহাস রচিত হয়েছে কিন্তু নাট্য সমালোচনার কোনো ঐতিহাসিক ধারা নিয়ে কোনো চর্চা হল না।

এই অনালোচিত দিকটির প্রতি প্রথম মনোনিবেশ ঘটিয়েছিলেন আমার প্রিয় অধ্যাপক ড. বিমল কুমার মুখোপাধ্যায়। নাট্যজগতের সঙ্গে সম্পর্ক দূর থেকে হলেও তিনি এই অভাব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। সদ্য এম এ পাশ করা শেষ বেঞ্চের একটি ছেলের কাছে কেন তিনি এ কথা বলেছিলেন জানি না। তার ইচ্ছে আর উৎপলদার আদেশ আমাকে আজীবনের মতো এই কাজে নিযুক্ত করে দিল।

বাংলা নাট্য সমালোচনার কথা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আরও উপলব্ধি করলাম, এ কাজ প্রায় আজীবন ধরে করে যেতে পারলেও সম্পূর্ণ হবে না। কারণ, বহু পত্র পত্রিকার তো কোনো হদিসই নেই। সম্পাদকই জানেন না তাঁর পত্রিকার কোনো কপি আছে কি নেই! গ্রন্থাগারগুলি সুনিয়ন্ত্রিত নয়, থিয়েটারওয়ালারা সঞ্চয়ী নন ফলে অসম্পূর্ণতা থাকবেই। যতগুলি পত্র-পত্রিকার উল্লেখ করেছি, ততগুলি নিয়ে আলোচনা করতে পারিনি। প্রথম তিনটি অধ্যায়ের কয়েকটি পত্রিকা দেখতেই পাইনি, অন্যান্য কিছু বইয়ে তার উল্লেখ ও আলোচনা থেকেই আমার আলোচনার গতিপথ ঠিক করে নিতে হয়েছে। তবে যতটুকু পেয়েছি তাকে পুরোপুরি সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করেছি।

আমি নিজেই জানি আমার গবেষণাকর্মের কোথায় কতটুকু ফাঁক রয়ে গেছে। যেমন, ‘ভগ্নদূত’ পত্রিকার সময়কাল জানি কিন্তু কতগুলি সংখ্যা ঠিক কোন দিন থেকে কার সম্পাদনায় প্রকাশিত হত জানি না। একই অবস্থা ‘রূপমঞ্চ’র ক্ষেত্রেও। প্রকাশক্ষণ জানি না। ‘প্রসেনিয়াম পত্রিকার প্রথম বর্ষের কোনো সংখ্যাই পাইনি। কেবলমাত্র দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের বেশ কয়েকটি সংখ্যা, আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক শ্রী অক্ষয় মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গোডাউন থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম।

বাংলা নাট্য সমালোচনার কথা - আশিস গোস্বামী
বাংলা নাট্য সমালোচনার কথা – আশিস গোস্বামী

সেই সংখ্যাগুলি থেকেই পত্রিকা সমালোচনার মোটিভকে ধরবার চেষ্টা করেছি। ড. বিষ্ণু বসু ‘গণনাট্য’ পত্রিকার দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকাশনাগুলি ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও সলিল চৌধুরী সম্পাদিত ‘গণনাট্য’ পত্রিকার সন্ধান মেলেনি। তবে ওই সময়ের দু-একটি সমালোচনা অন্যত্র খুঁজে পেয়েছি। ‘গন্ধব’র সমালোচনাগুলি দিয়েছেন ‘গন্ধব’র তৎকালীন সম্পাদক শ্রী নৃপেন্দ্র সাহা। এভাবেই আমার আলোচনার পথকে খুঁজে নেবার চেষ্টা করেছি।

এই সমস্ত পত্র পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কারও সঙ্গে হয়তো আলোচনা করেছি কিন্তু এই বইয়ে লিখিত অথবা মুদ্রিত বিষয়ের ওপরেই জোর দিয়েছি। আমার মতামত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি বলা-কথার ভিত্তিতে নয়, প্রামাণ্য বিষয়ের ভিত্তিতে। সেই কারণেই দৈনিক পত্রিকা বা সাময়িক পত্রিকাগুলির যে সংখ্যা গুলি হাতে পেয়েছি কেবলমাত্র সেই সংখ্যাগুলির সমালোচনার ভিত্তিতেই তার ঐতিহাসিকতা খুঁজবার চেষ্টা করেছি।

আমার এই প্রচেষ্টা কতখানি সঠিক এবং প্রয়োজনীয় তা বিচারের ভার, যিনি পাঠক তাঁরই। তবে তাঁর কাছে আমার বিনীত নিবেদন, অনেক ফাঁক-ফোকরের সন্ধান তিনি পাবেন কিন্তু বাংলায় এ ধরনের আলোচনার প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে না পাওয়াটাকে যেন ক্ষমাশীল মনে মেনে নেন। আমি সতত সচেষ্ট থাকব একে সম্পূর্ণতা দানে—এ অঙ্গীকার রাখছি।

আমার কৃতজ্ঞতার তালিকার প্রথম নাম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বাংলা বিভাগের প্রধান, রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক ড. বিমল কুমার মুখোপাধ্যায়েব—তিনিই প্রথম ‘এরকম কাজ হয়নি, অথচ হওয়া দরকার’—এ কথা যেমন বুঝিয়েছিলেন; তেমনি আমার মতো অনুল্লেখিত ছাত্রকে এই বজে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কোনো শব্দই যথেষ্ট নয় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে। যেমন জানি না, প্রখ্যাত নট-নাট্যকার-পরিচালক উৎপল দত্তকে, কোন্ শব্দে শ্রদ্ধা জানাব? এখন সব কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি।

এই ধরনের কাজে সবচেয়ে উৎসাহী আর একজন মানুষের কাছেও ঋণী—তিনি নৃপেন্দ্র সাহা। তাঁর ভাবনার বহু প্রতিফলন আছে আমার কাজে। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি পত্রিকার সম্পাদক নৃপেন্দ্রদা গোটা কাজের পিছনে অনবরত তাগাদা দিয়েছেন। কৃতজ্ঞ আলোর কবি শ্রী তাপস সেনের কাছেও। অনেক অনুসন্ধান তাঁরই মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। তবে এসব কথা আজ থেকে অনেক বছর আগের। বর্তমানে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন, কাজ করছেন। সমবেত চেষ্টার একটা সঠিক অর্থ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে।

কৃতজ্ঞ দুই বাংলার প্রিয় মানুষ হায়াৎ মামুদ আর পরমাত্মীয় রহমত আলী ও ওয়াহিদা মল্লিক জলির প্রতি। কৃতজ্ঞ ড. বিষ্ণু বসুর কাছে। এ কাজের নানা কৌতূহল নিরসন করেছেন তিনিই। এ ছাড়া বন্ধু অনীত রায় ও স্কুলের সহকর্মীদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বীজেশ সাহা আমার অনেকদিনের বন্ধু। প্রতিভাস থেকে এই প্রকাশনায় ওর সহযোগিতা আজীবন মনে থাকবে।

এই কাজের জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, জাতীয় গ্রন্থাগার, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ এবং নাট্যশোধ সংস্থার কাছে বিশেষভাবে ঋণী। যতটুকু তথ্যাদি সংগ্রহ করতে পেরেছি, তা এদেরই সহায়তায়। আমার সহধর্মিনী সুমিত্রা বহু লাইব্রেরির কাজ করে দিয়েছে। আর বাবা, এবং দীপের কথাও বলতে হয়।

শেষে বলি, মায়ের কথা। মা কতকাল আগে থেকে এমন একটা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, উঁচু পাহাড় ডিঙোনোর স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন এখনও যেমন তিনি লালন করেন, আমাকেও লালিত করার নিয়ত চেষ্টারই ফসল এই গবেষণাটি। তাই এ সবটুকুই তাঁর জন্য রইল। সকলের কাছে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

আশিস গোস্বামী

[ ১৫-১২-২০১০ ]

আরও পাড়ুন :

Leave a Comment