উত্তম কুমার (অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়)

উত্তম কুমার এর জন্ম উত্তর কলকাতার আহিরিটোলায়। পরে ভবানীপুরে চলে আসেন। চক্রবেড়িয়া স্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ার পরে সাউথ সুবার্বন স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করে গভর্নমেন্ট কমার্সিয়াল কলেজে সান্ধ্য বিভাগ থেকে ১৯৪৫ সালে বি. কম. স্ট্যান্ডার্ড পাস করেন। স্কুলে পড়ার সময় গয়াসুর (ছোট) এবং বলরামের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসা পান। কলেজ শিক্ষা চলাকালীন নিধানবাবুর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন। কিছুদিন পোর্ট কমিশনারস অফিসে চাকরিও করেছেন।

 

উত্তম কুমার (অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

উত্তম কুমার (অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

উত্তম কুমার অল্প বয়সে পাড়ার নাট্যদলে অভিনয় করতেন। চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় ভোলা আঢ্য পরিচালিত মায়াডোর (হিন্দী, ১৯৪৭) ছবিতে। ছবিটি মুক্তি পায় নি। পরবর্তী অভিনয় নীতিন বসু পরিচালিত দৃষ্টিদান (১৯৪৮)। এই ছবিতে তিনি নায়ক অসিতবরণের ছোটবেলার ভূমিকায় অভিনয় করেন। নব্যেন্দুসুন্দর পরিচালিত কামনা (১৯৪৯) ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

অরুণকুমার, উত্তম চট্টোপাধ্যায়, অরূপকুমার ইত্যাদি নামে অভিনয়ের পর উত্তমকুমার নামে প্রথম অবতীর্ণ হন সহযাত্রী (১৯৫১) ছবিতে। ১৯৫১ পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রায় সব ছবিগুলিই বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়। প্রথম সাফল্য নির্মল দে পরিচালিত বসু পরিবার (১৯৫২)।

উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রথম ছবি নির্মল দে পরিচালিত সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩) অভাবনীয় আর্থিক সাফল্য পায়। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তাদের জুটি করে নির্মিত তিরিশটি ছবির অধিকাংশই দর্শক সমাদর লাভ করেছে। ৩৪ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে উত্তমকুমার তৎকালীন সময়ের বেশিরভাগ নায়িকার সাথেই কাজ করেছেন।

 

উত্তম কুমার (অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

সুচিত্রা সেন ৩০, সুপ্রিয়া দেবী ৩৭, সাবিত্রী চ্যাটার্জী ২৬, অরুন্ধতী দেবী ৮, অপর্ণা সেন ১১, মালা সিনহা ৭, সন্ধ্যারাণী ৭, মাধবী ৩, শর্মিলা ঠাকুর ৩. অল্পনা ভৌমিক ৬, কাবেরী বসু ৫, আরতি ভট্টাচার্য ৫, মঞ্জু দে ৪, সবিতা চ্যাটার্জী B, অনুভা গুপ্তা ৪, তনুজা ৩, ছবিতে তাঁর সাথে নায়িকা হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছেন।

সমগ্র চলচ্চিত্র জীবনে ২০০টিরও বেশি ছবিতে রোমান্টিক নায়ক হিসাবে উত্তম ডাক্তার, কবি ও লেখক, সাংবাদিক, গায়ক, উকিল, বিপ্লবী প্রভৃতির ভূমিকা ছাড়াও খলনায়ক চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। অন্তত ১টি ছবিতে দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

উত্তম অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র রামপ্রীতি (সাড়ে চুয়াত্তর, ১৯৫৩), ভূতনাথ (সাহেব বিবি গোলাম, ১৯৫৬); থিরুমল (মরুতীর্থ হিংলাজ, ১৯৫৯); হিমু (শুন বরনারী, ১৯৬০); কৃষ্ণেন্দু (সপ্তপদী, ১৯৬১); বিজন বিহারী (শিউলিবাড়ি, ১৯৬২); শতদল (জতুগৃহ ১৯৬৪); অরিন্দম (নায়ক, ১৯৬৬); এন্টনী (এন্টনী ফিরিঙ্গী, ১৯৬৭); স্যাটা বোস (চৌরঙ্গী, ১৯৬৮); রঞ্জন (অপরিচিত, ১৯৬৯), ইন্দ্রজিৎ (কলঙ্কিত নায়ক, ১৯৭০); অনঙ্গ (নিশিপদ্ম, (১৯৭০); কালিগতি (ধন্যি মেয়ে, ১৯৭১); মাধব দত্ত (স্ত্রী, ১৯৭২); উদাস (বনপলাশির পদাবলী, ১৯৭৩); মিঃ বাসু (যদি জানতেম, ১৯৭৪); ঘনাদা (যদুবংশ, ১৯৭৪): অনুপম (নগর দর্পণে, ১৯৭৫); নীতিশ (মৌচাক, ১৯৭৫); সূর্যকিশোর (সন্ন্যাসী রাজা, ১৯৭৫) ইত্যাদি।

 

উত্তম কুমার (অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

যে সব পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, অগ্রদূত, অগ্রগামী, দেবকী বসু, পীযূষ বসু, অসিত সেন, অজয় কর, তপন সিংহ, যান্ত্রিক, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, নীরেন লাহিড়ী, সলিল দত্ত, সলিল সেন প্রভৃতি।

চলচ্চিত্র অভিনয়ের পাশাপাশি হারানো সুর (১৯৫৭), সপ্তপদী (১৯৬১), ভ্রান্তিবিলাস (১৯৬৩), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), অতুগৃহ (১৯৬৪) এবং গৃহদাহ (১৯৬৭) ছবিগুলি প্রযোজনাও করেছেন। পরিচালক হিসাবে উত্তমকুমার কাজ করেছেন চারটি ছবিতে। নিজের চিত্রনাট্য অবলম্বনে পরিচালনা করেন শুধু একটি বছর (১৯৬৬) ও বনপলাশির পদাবলী (১৯৭৩) এবং পীযূষ বসুর চিত্রনাট্য অবলম্বনে কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১)।

চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার দায়িত্বও উত্তম পালন করেছেন অন্তত দুটি ছবিতে। ছবিগুলি হল শচীন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬) এবং পীযূষ বসু পরিচালিত সব্যসাচী (১৯৭৭)। বাংলা ছবি ছাড়াও আলো সরকার পরিচালিত ছোটি সি মুলাকাত (১৯৬৬), বন্দী (১৯৭৮), শক্তি সামন্ত পরিচালিত অমানুষ (১৯৭৪), আনন্দ আশ্রম (১৯৭৭), এস. এস. বালান পরিচালিত নিশান (১৯৭৮), গুলজার পরিচালিত কিতাব (১৯৭৯) ছাড়াও প্লট নাম্বার ফাইভ (১৯৮১) এবং দেশপ্রেমী (১৯৮২) প্রভৃতি হিন্দী ছবিতেও অভিনয় করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ছোটি সি মুলাকাত ছবিটি তাঁর প্রযোজনায় তৈরি হয়।

 

উত্তম কুমার (অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) । বাংলা চলচ্চিত্রের অভিধান

 

শিল্পী সংসদের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নায়ক উত্তমকুমার চলচ্চিত্র ছাড়াও নাট্যাভিনয়েও অংশ নিয়েছেন। ১৯৫৩-৫৪ সালে স্টার থিয়েটারে শ্যামলী নাটকে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সাথে টানা দু’বছরেরও বেশি পেশাদার রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করেছেন। তাঁর স্মৃতিতে দক্ষিণ কলকাতায় উত্তম মঞ্চ নির্মিত হয়েছে, এছাড়াও অ্যালবার্ট রোডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে উত্তমকুমার সরণী। টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনটিও তাঁর নামে নামাঙ্কিত।।

১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া চিড়িয়াখানা এবং এন্টনী ফিরিঙ্গী ছবিতে অভিনয়ের জন্য ভারত সরকারের ভরত পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও উত্তম তিনবার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টদের বিচারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে সম্মানিত হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান অমানুষ ছবির জন্য।

প্রকাশনা উত্তমকুমারের আত্মজীবনী নবকল্লোল পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালে সপ্তর্ষি প্রকাশনা থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ অনুলিখিত উত্তমকুমারের আত্মজীবনী ‘আমার আমি’ প্রথমে মিত্র ও ঘোষ এবং পরে দে’জ পাবলিশিং থেকে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়।

এছাড়াও জীবেন্দু সরকার সম্পাদিত ‘উত্তমকুমার’ আলোর আসর থেকে ১৯৯৫ সালে, বিমল চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘মহানায়ক উত্তমকুমার’ চারুপ্রকাশ থেকে ১৯৮০ সালে, সত্যজিৎ সেনের লেখা ‘অচেনা উত্তম’ সোনার বাংলা প্রকাশনা থেকে ১৯৯৬ সালে এবং সোমা. এ. চ্যাটার্জীর লেখা উত্তমকুমার দি আলটিমেট হীরো গ্রন্থটি রূপা থেকে ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়।

 

google news , গুগল নিউজ
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

চলচ্চিত্রপঞ্জি :

  • ১৯৪৮ : দৃষ্টিদান;
  • ১৯৪৯ কামনা;
  • ১৯৫০ : মৰ্য্যাদা;
  • ১৯৫১ : ওরে যন্ত্রী, সহযাত্রী, নষ্টনীড়
  • ১৯৫২: সঞ্জীবনী বসু পরিবার, কার পাপে;
  • ১৯৫৩ সাড়ে চুয়াত্তর, লাখ টাকা, নবীন যাত্রা, বউঠাকুরাণীর হাট;
  • ১৯৫৪ : মনের ময়ূর, ওরা থাকে ওধারে, চাঁপা ডাঙার বউ, কল্যাণী, মরণের পরে, সদানন্দের মেলা, অন্নপূর্ণার মন্দির, অগ্নিপরীক্ষা, বকুল, গৃহপ্রবেশ, মন্ত্রশক্তি;
  • ১৯৫৫ : সাঁঝের প্রদীপ, অনুপমা, রাইকমল, দেবত্র, শাপমোচন, বিধিলিপি, হ্রপ, উপহার, কঙ্কাবতীর ঘাট, রাতভোর, ব্রতচারিণী, সবার উপরে;
  • ১৯৫৬ : সাগরিকা, সাহেব বিবি গোলাম, লক্ষহীরা, চিরকুমার সভা, একটি রাত, শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক, শ্যামলী, ত্রিযামা, পুত্রবধূ, শিল্পী, নবজন্ম
  • ১৯৫৭ হারজিৎ, বড়দিদি, যাত্রা হলো শুরু, পৃথিবী আমারে চায়, তাসের ঘর, সুরের পরশে, পুনর্মিলন, হারানো সুর, অভয়ের বিয়ে, চন্দ্রনাথ, পথে হল দেরী, জীবন তৃষ্ণা;
  • ১৯৫৮ : রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, বন্ধু, মানময়ী গার্লস স্কুল, ডাক্তারবাবু, শিকার, ইন্দ্রাণী, যৌতুক, সূর্যতোরণ;
  • ১৯৫৯ : মরুতীর্থ হিংলাজ, চাওয়া পাওয়া, বিচারক, পুষ্পধনু, গলি থেকে রাজপথ, খেলাঘর, সোনার হরিণ, অবাক পৃথিবী;
  • ১৯৬০ : মায়ামৃগ, রাজাসাজা, কুহক, উত্তর মেঘ, হাত বাড়ালেই বন্ধু, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, সখের চোর, শহরের ইতিকথা, শুন বরনারী;
  • ১৯৬১: সাথীহারা, অগ্নিসংস্কার, ঝিন্দের বন্দী, নেকলেস, সপ্তপদী, দুই ভাই;
  • ১৯৬২ : বিপাশা, শিউলিবাড়ি, কান্না,
  • ১৯৬৩ : শেষ অঙ্ক, নিশীথে, উত্তর ফাল্গুনী, উত্তরায়ণ, ভ্রান্তিবিলাস, সূর্য্যশিখা, দেয়ানেয়া; ১৯৬৪ : বিভাস, জতুগৃহ, নতুন তীর্থ, মোমের আলো, লালপাথর;
  • ১৯৬৫ থানা থেকে আসছি, রাজকন্যা, সূর্যতপা;
  • ১৯৬৬ রাজদ্রোহী, শুধু একটি বছর, নায়ক, শঙ্খবেলা, কাল তুমি আলেয়া,
  • ১৯৬৭ নায়িকা সংবাদ, জীবন মৃত্যু, গৃহদাহ, : চিড়িয়াখানা, এন্টনী ফিরিঙ্গী;
  • ১৯৬৮: চৌরঙ্গী, তিন অধ্যায়, গড় নাসিমপুর, কখনো মেঘ;
  • ১৯৬৯ : সাবরমতী, চিরদিনের, শুকসারী, কমললতা, মন নিয়ে, অপরিচিত;
  • ১৯৭০ : কলঙ্কিত নায়ক, বিলম্বিত লয়, দুটি মন, রাজকুমারী, নিশিপদ্ম, মঞ্জরী অপেরা;
  • ১৯৭১: এখানে পিঞ্জর, জয়জয়ন্তী, ধন্যি মেয়ে, নবরাগ, জীবন জিজ্ঞাসা, ছদ্মবেশী;
  • ১৯৭২ : বিরাজ বৌ, আলো আমার আলো, অন্ধ অতীত, স্ত্রী, ছিন্নপত্র, মেমসাহেব, হার মানা হার;
  • ১৯৭৩ : বনপলাশির পদাবলী, কায়াহীনের কাহিনী, রাতের রজনীগন্ধা, সোনার খাঁচা, রৌদ্রছায়া:
  • ১৯৭৪: রক্ততিলক, আলোর ঠিকানা, যদি জানতেম, যদুবংশ, রোদনভরা বসন্ত, বিকেলে ভোরের ফুল, অমানুষ;
  • ১৯৭৫ : মৌচাক, আমি সে ও সখা, অগ্নীশ্বর, নগর দর্পণে, কাজললতা, প্রিয় বান্ধবী, সন্ন্যাসী রাজা, বাঘবন্দী খেলা;
  • ১৯৭৬ : হোটেল স্নো ফক্স, আনন্দমেলা, মোমবাতি, সেই চোখ, নিধিরাম সর্দার, বহ্নিশিখা, চাদের কাছাকাছি;
  • ১৯৭৭ : রাজবংশ, সব্যসাচী, অসাধারণ, ভোলা ময়রা, সিস্টার, জাল সন্ন্যাসী, আনন্দ আশ্রম;
  • ১৯৭৮: দুই পুরুষ, বন্দী, নিশান, ধনরাজ তামাং;
  • ১৯৭৯ ; ব্রজবুলী, দেবদাস, সুনয়নী, নব দিগন্ত, শ্রীকান্তের উইল, সমাধান;
  • ১৯৮০ পঙ্খীরাজ, রাজনন্দিনী, আরো একজন, দর্পচূর্ণ, দুই পৃথিবী, রাজা সাহেব;
  • ১৯৮১ : ওগো বধূ সুন্দরী, অনাবরাহ, সূর্যসাক্ষী, প্রতিশোধ, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী,
  • ১৯৮২ : ইমন কল্যাণ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment