কবরী সারোয়ার

কবরী সারোয়ার, আসল নাম মিনা পাল, একজন বাংলাদেশি অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকের বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের নায়িকা ছিলেন। তিনি একটি অভিনয় ও আজীবন সম্মাননাসহ দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ছয়টি বাচসাস পুরস্কার এবং মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেছেন।

কবরী সারোয়ার

কবরী সারোয়ার । বাংলাদেশি অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও রাজনীতিবিদ

কবরী সারোয়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য

পুরো নামকবরী সারোয়ার
জন্ম১৯ জুলাই ১৯৫০
জন্মস্থানচট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী
জাতীয়তাবাংলাদেশী
পেশাঅভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও রাজনীতিবিদ
মৃত্যু২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল

কবরীর প্রারম্ভিক জীবন

কবরী সারোয়ার ১৯৫০ সালের ১৯শে জুলাই চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলাতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান বোয়ালখালী হলেও শৈশব ও কৈশোর বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরীতে। তার জন্মনাম মিনা পাল। পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে কাজ শুরু করেন।

কবরী সারোয়ার । বাংলাদেশি অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও রাজনীতিবিদ

 

কবরীর কর্মজীবন

কবরী সারোয়ার এর চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় সুতরাং চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। তিনি জরিনা চরিত্রে অভিনয় করেন। সুরকার সত্য সাহা সুভাষ দত্তকে তার খোঁজ দেন। কবরীর ছবি দেখে দত্ত তাকে পছন্দ করেন এবং তাঁকে অডিশনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ডেকে পাঠান। কণ্ঠ ও সংলাপ পরীক্ষার পর দত্ত তাকে জরিনা চরিত্রের জন্য নির্বাচন করেন। এরপর দত্তের পরামর্শে চলচ্চিত্রটির লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার নাম পরিবর্তন করে “কবরী” রাখেন। চলচ্চিত্রটি তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। সেখানে চলচ্চিত্রটি এবং কবরীর অভিনয় প্রশংসিত হয়। এছাড়া চলচ্চিত্রটি ১৯৬৫ সালে ফ্রাংকফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কৃত হয়।

এরপর উর্দু ভাষার বাহানা ও সোয়ে নদীয়া জাগে পানি এবং লোককাহিনি-নির্ভর সাত ভাই চম্পা (১৯৬৮) দিয়ে সফলতা অর্জন করেন। আবির্ভাব (১৯৬৮) চলচ্চিত্র দিয়ে রাজ্জাকের সাথে তার জুটি গড়ে ওঠে। এই জুটির জনপ্রিয় ও সফল চলচ্চিত্রগুলো হলো ময়নামতি[৪](১৯৬৯), নীল আকাশের নীচে (১৯৬৯), ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০), দর্প চূর্ণ (১৯৭০), কাঁচ কাটা হীরে (১৯৭০), দীপ নেভে নাই (১৯৭০), স্মৃতিটুকু থাক (১৯৭১), রংবাজ (১৯৭৩)।

কবরী সারোয়ার লালন ফকির (১৯৭২) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। সাহিত্যনির্ভর তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)-এর রাজার ঝি এবং সারেং বৌ (১৯৭৮)-এর নবিতুন তার অন্যতম সমাদৃত দুটি কাজ। দ্বিতীয়োক্ত কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তিনি সুজন সখী (১৯৭৫) ও দুই জীবন (১৯৮৮) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আরও দুটি বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। তার অভিনীত তিতাস একটি নদীর নাম ও সাত ভাই চম্পা চলচ্চিত্র দুটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এর সেরা দশ বাংলাদেশি চলচ্চিত্র তালিকায় যথাক্রমে প্রথম ও দশম স্থান লাভ করে।

কবরী সারোয়ার । বাংলাদেশি অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও রাজনীতিবিদ

 

তার সংগীতধর্মী লোককাহিনি-নির্ভর সাত ভাই চম্পা (১৯৬৮) ব্যবসাসফল হয়। এটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এর সেরা দশ বাংলাদেশি অনেক চলচ্চিত্র তালিকায় দশম স্থান লাভ করে। এই বছর আবির্ভাব (১৯৬৮) চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে রাজ্জাকের সাথে তার জুটি গড়ে ওঠে। সেই সময়ে উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে শবনম-রহমান ও শাবানা-নাদিম জুটির মতন জনপ্রিয় জুটির সাথে পাল্লা দিয়ে তারা বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এই জুটির জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি বলেন, “আমরা এমন আবেগ ঢেলে অভিনয় করতাম, ছবির প্রণয়দৃশ্যগুলো হয়তো খুবই স্বাভাবিক এবং জীবন্ত হয়ে উঠত।” এই বছর তার অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হলো বাঁশরী, অরুণ বরুণ কিরণমালা, শীত বসন্ত ও চোরাবালি। ১৯৬৯ সালে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র পারুলের সংসার। এই বছর রাজ্জাকের বিপরীতে কাজী জহিরের ময়না মতি ও নারায়ণ ঘোষ মিতার নীল আকাশের নীচে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে রাজ্জাক-কবরী জুটি যে আগুনে পুড়ি, ক খ গ ঘ ঙ, দর্প চূর্ণ, কাঁচ কাটা হীরে, ও দীপ নেভে নাই চলচ্চিত্রে একসাথে কাজ করেন। এই বছর তিনি সুভাষ দত্তের বিনিময় চলচ্চিত্রে বাক্-প্রতিবন্ধী এক তরুণী চরিত্রে অভিনয় করেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ লেখা হয়, “ছবির মূল সম্পদ ছিল কবরীর অসাধারণ অভিনয়। কোনো সংলাপ ছাড়া এই চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন যে অভিনয় দক্ষতার তা কবরীর আয়ত্তাধীন ছিল।” চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল হয় এবং বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম ধ্রুপদী চলচ্চিত্রে পরিণত হয়। এছাড়া তিনি ১৯৭০ সালে তিনি কাজী জহিরের পরিচালনায় মীনা নামে একটি উর্দু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র জয় বাংলা। এই বছর তিনি লালন ফকির (১৯৭২) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭৩ সালে তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র রংবাজ। এই চলচ্চিত্রে তিনি পর্দায় লাস্যময়ী রূপে আবির্ভূত হন এবং তার চটুল অভিব্যক্তি দর্শকের নজর কাড়ে। চলচ্চিত্রটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়। একই বছর তিনি ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)-এর রাজার ঝি চরিত্রটি তার অন্যতম সমাদৃত কাজ।এটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এর সেরা দশ বাংলাদেশি চলচ্চিত্র তালিকায় শীর্ষ স্থান লাভ করে।

 

কবরী সারোয়ার । বাংলাদেশি অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও রাজনীতিবিদ

 

১৯৭৫ সালে তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র প্রমোদ করের সুজন সখী। এটি সেই বছরের অন্যতম ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে তাঁর দ্বিতীয় বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বউ উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুনের নির্মিত একই নামের (১৯৭৮) চলচ্চিত্রে নবিতুন চরিত্রে অভিনয় করে সমাদৃত হন এবং এই কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন।[১৫] ১৯৭৮ সালে তিনি আবদুল্লাহ আল মামুনের দুই জীবন (১৯৮৮) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আরেকটি বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন।

২০০৫ সালে তার পরিচালিত আয়না ছবি মুক্তি পায়।

 

রাজনৈতিক জীবন

কবরী সারোয়ার ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

 

কবরী সারোয়ার
কবরী সারোয়ার

 

ব্যক্তিগত জীবন

কবরী সারোয়ার প্রথমে চিত্ত চৌধুরীকে বিয়ে করেন। সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি সফিউদ্দীন সরোয়ারকে বিয়ে করেন। ২০০৮ সালে তাদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী পাঁচ সন্তানের মা ছিলেন। ২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘স্মৃতিটুকু থাক’ প্রকাশিত হয়।

 

মৃত্যু

কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ১৩ দিনের মাথায়, ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল রাত ১২টা ২০ মিনিটে ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

 

কবরী সারোয়ার

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment