বার্লির কৌটো আর বিস্কিটের ভাঙা টিন সম্বল করে তিনি রঙ্গমঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন আলোর নতুন ভাষা। সাদামাটা উপকরণ দিয়ে শুরু হলেও তাঁর আলোয় ভরা মঞ্চে যেন কবিতা ও ছন্দের এক নবযুগের সূচনা ঘটেছিল। গোটা দেশ জুড়েই তাঁর বিস্তার বর্ণময়। তিনি তাপস সেন—ভারতীয় নাট্যমঞ্চ ও আলো ডিজাইনের কিংবদন্তি।
হোঁচট খাওয়া এক বৃদ্ধ, আলোয় আলোকিত এক ইতিহাস
বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ধরে লালবাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এক অশীতিপর বৃদ্ধ। এলোমেলো সাদা চুল, কোমরে ঝোলানো ক্যাথিটার। এক পথচারী এগিয়ে এসে ধরলেন তাঁকে, সহায়তা করলেন হাঁটতে। তখনই এক তরুণ নাট্যকর্মী চিনতে পেরে বললেন,
— “তাপসদা, কী হয়েছে? কোথায় যাচ্ছেন?”
বৃদ্ধ মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
— “কানের যন্ত্রটা কাজ করছে না, দোকানে যাচ্ছি। কিন্তু দোকানটা কোথায় যেন ভুলে গিয়েছি।”
তরুণ তাঁকে কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। এভাবেই শহরের ব্যস্ত রাস্তায় হোঁচট খাওয়া এক বৃদ্ধই ছিলেন সেই তাপস সেন, যাঁর নাম পাঁচ দশক ধরে বাংলা থিয়েটারের বিজ্ঞাপনে প্রায় অবধারিতভাবে লেখা থাকত—
“আলো: তাপস সেন”।
আজকের এই নড়বড়ে মানুষটির ভেতরে লুকিয়ে আছে আলোর এক মহীরুহ, যিনি মঞ্চসজ্জার ভাষা বদলে দিয়েছেন।
প্যারাডাইস কাফের দিনগুলি
দেশ তখন সদ্য স্বাধীন। হাজরা মোড়ের কাছে প্যারাডাইস কাফে—যেখানে ভিড় জমত প্রায় কপর্দকহীন কিছু যুবকের। কফির কাপ আর সিগারেটের ধোঁয়া মিশে তৈরি হতো স্বপ্নভঙ্গ ও নতুন স্বপ্নের নকশিকাঁথা।
এই আড্ডার নিয়মিত মুখ ছিলেন—মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। মাঝেমধ্যেই আসতেন সলিল চৌধুরী, উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। প্রায় সবারই পায়ের তলায় মাটি মজবুত ছিল না, তবে সবার ভেতরেই দাউ দাউ করে জ্বলছিল এক শিল্পানুভূতির আগুন।
হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় নিউ থিয়েটার্সে সম্পাদনার কাজ করতেন, তাই সবার চোখে তিনি ছিলেন “ক্যাপিটালিস্ট”। আর একদিন তিনিই নিয়ে এলেন নতুন এক ছেলেকে—তাপস সেন।
রাজনীতি থেকে আলো
নিউ থিয়েটার্সে সৌরেন সেনের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন তাপস। শুরুতে টাকাকড়ি কিছু পেতেন না। তাঁর অতীতও ছিল রাজনৈতিক লড়াইয়ে ভরা। এসইউসিআই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, রাত জেগে পোস্টার সাঁটতেন, ‘গণদাবী’ বিক্রি করতেন, এমনকি গ্রেফতারও হয়েছিলেন।
ঋত্বিক-মৃণালদের দলে তিনি ছিলেন “অন্য পক্ষের” মানুষ। তবু শিল্পের টানে সেই ভেদাভেদ টিকে থাকেনি। ১৯৫০ সালে ঋত্বিক ঘটকের নাটক “জ্বালা”-তে প্রথম আলো পরিচালনা করেন তাপস সেন। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর শিল্পযাত্রা, যা একসময় ভারতীয় থিয়েটারের ইতিহাস বদলে দেয়।
আঁধারে সলতে
আলো জ্বালানোর আগে যেমন সলতে পাকাতে হয়, তেমনি তাপস সেনের জীবনেরও একটি প্রস্তুতির অধ্যায় ছিল। যদিও তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল অসমে, কিন্তু বাবা মতিলাল সেন কর্মসূত্রে দিল্লিতে চলে আসেন। পরিবার থাকত ১১ নম্বর সিকন্দর প্লেসের তিন কামরার কোয়ার্টারে।
তাপসের শিল্পচর্চার সূচনা হয় রাইসিনা বেঙ্গলি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। শিক্ষক প্রতাপ সেন তাঁর হাতে আঁকার প্রথম পাঠ দেন। অন্য শিক্ষক সুশীল রায়চৌধুরীও তাঁকে শিল্পচেতনা জাগাতে সাহায্য করেন। দুর্গাপুজো ও সরস্বতী পুজোর সময় স্কুলে নাটক হত, আর ছোট্ট তাপস অভিনয়ের চেয়ে বেশি আকৃষ্ট হতেন আলো ও যন্ত্রপাতির দিকে।
১৯৪১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করে দিল্লি পলিটেকনিকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হন। তবে অল্পদিনের মধ্যেই পড়াশোনা ছেড়ে দেন। তত দিনে দিল্লির নাট্যজগতে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন “লাইটওয়ালা বাঙালি বাবু” হিসেবে। যে নাটকই হত, ডাক পড়ত তাপসের।
১৯৪৪ সালে দিল্লিতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শাখা খোলা হলে তাপস ছিলেন তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সেখানেই গুরু প্রতাপ সেনের সঙ্গে জীবনের প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ করেন—পরশুরামের গল্প অবলম্বনে ছায়ানাট্য ভুশণ্ডীর মাঠে।
পাশাপাশি তিনি চাকরিও করছিলেন—প্রথমে নিউ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল, পরে আরউইন হাসপাতাল, এবং শেষে দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে সিপিডব্লিউডি-র বিদ্যুৎ বিভাগে। মাইনে ভালো হলেও শিল্পীসত্তা হাঁপিয়ে উঠছিল। ১৯৪৫-৪৬-এর সময় দেশ উত্তাল—আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার চলছে লালকেল্লায়। তাপস কাছ থেকে দেখেছেন মোহন সিং, শাহনওয়াজ খান, গুরবক্স সিং ঢিলোঁদের। প্রতিদিনই আসতেন জওহরলাল নেহরু। কিন্তু পাড়ায় ফিরে এসব গল্প করলে বন্ধুরা মজা করত—“গুল দেওয়ার আর জায়গা পেলি না!”
বম্বে টু কলকাতা
১৯৪৬ সালে চাকরি ছেড়ে তিনি চলে গেলেন বম্বে (বর্তমান মুম্বই)। উদ্দেশ্য—ক্যামেরা আর আলোর কাজ শিখবেন। কিন্তু কাজ পাওয়া সহজ ছিল না। বম্বে টকিজ়ে প্রতিদিন উপস্থিত থাকতেন, অথচ ভাড়া দেওয়ার পয়সা পর্যন্ত ছিল না। অনেক সময় দোতলা ট্রামে এক দিক দিয়ে উঠে অন্য দিক দিয়ে লাফিয়ে নামতে হতো কন্ডাক্টর এড়াতে।
একদিন পৃথ্বীরাজ কপূরের নাটক দেখে তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে গিয়েছিলেন। আলো নিয়ে কিছু ধারণা ভাগ করতে চেয়েছিলেন। আধময়লা পাজামা-কুর্তা পরা তাপসকে দেখে পৃথ্বীরাজ বলেন, “ওটা রাজ (কপূর) দেখছে।” বহু বছর পরে পৃথ্বীরাজ যখন আক্ষেপ করেছিলেন, “শম্ভু বা উৎপলের মতো আমার একটা তাপস সেন নেই”, তখন তাপসই তাঁকে এই গল্প মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। তাঁর টান ছিল রঙমহলের দিকে, যেখানে নিউ ইয়র্ক-ফেরত সতু সেন আলো নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এমনকি ঘূর্ণায়মান মঞ্চও বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই দরজা তাপসের জন্য খোলেনি।
কলকাতায় সংগ্রামের দিন
শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই। প্রথমে হাজরা রোডের এক মেসে স্যাঁতসেঁতে ছোট ঘরে থাকতেন, যেটিকে তিনি মজা করে ডাকতেন “ডার্করুম”। পরে সুভো ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন ক্যালকাটা গ্রুপ-এর আস্তানায় বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও নৃত্যশিল্পী অনাদি প্রসাদের সঙ্গে আশ্রয় পান। তখন বংশী এখনও সত্যজিৎ রায়ের শিল্প নির্দেশক হননি।
অর্থকষ্ট ছিল নিত্যসঙ্গী। খবরের কাগজওয়ালার টাকাও বাকি থাকত। প্রতিদিন তাঁর আগমনের আগে তাপস আর মৃণাল পালিয়ে বেড়াতেন। একদিন মুখোমুখি পড়ে তাপসই খবরের কাগজওয়ালার কাছে বিশ টাকা ধার চেয়ে বসেন! এমনকি অভুক্ত থাকার ঘটনাও কম ছিল না। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় একদিন নিউ থিয়েটার্স থেকে ফেরার পথে দেখেন, হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়ির রকে বসে আছেন তাপস—চোখ দেবে গেছে, মুখ ফ্যাকাশে, চুল এলোমেলো। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেন,
— “চারটে পয়সা দিবি? মুড়ি কিনে খাব? দু’দিন পেটে কিছু পড়েনি, জল খেলে বমি হচ্ছে।”
এই সংগ্রামের আঁধারেই পাক খাচ্ছিল তাঁর শিল্পজীবনের সলতে—যা পরে সমগ্র ভারতীয় নাট্যমঞ্চকে আলোকিত করবে।

এবং রক্তকরবী
তাপস সেন কলকাতায় ফেরার আগেই বাংলা নাটকে নতুন যুগের সূচনা হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৪ সালে বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ মঞ্চস্থ হয়ে সাধারণ মানুষের নাট্যআন্দোলনের পথ খুলে দিয়েছিল। তাপসের আলোকশিল্পীর আসল কাজ শুরু হয় বিজনেরই ‘নীলদর্পণ’ নাটক দিয়ে। এরপর তাঁর যোগাযোগ ঘটে তরুণ নাট্যপ্রেমী অমিতাভ চৌধুরী (পরে দেশ পত্রিকার সম্পাদক) ও তরুণ রায় (তৎকালীন কংগ্রেসপন্থী, পরবর্তীতে কলকাতা পুরসভার অল্ডারম্যান)-এর সঙ্গে। তরুণ রায়ের লেখা ‘রূপকথা’ নাটকে সাদা কাচের গ্লোবের সামনে বাঁশপাতা ঝুলিয়ে তাপস প্রথম তৈরি করেছিলেন পূর্ণচাঁদের মায়া। এখান থেকেই তাঁর অভিনব আলোকযাত্রার প্রকৃত সূচনা।
১৯৪৯ সালে শম্ভু মিত্র গঠন করেন বহুরূপী নাট্যদল। জন্মলগ্ন থেকেই সেখানে তাপসের উপস্থিতি ছিল অবিচ্ছেদ্য। ‘পথিক’, ‘ছেঁড়া তার’, ‘উলুখাগড়া’ অতিক্রম করে ১৯৫১ সালে এলো ‘চার অধ্যায়’। শহরের ছাদে গোধূলির আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে, চরিত্রগুলির সিলুয়েট আরও গাঢ় হচ্ছে, আর ট্র্যাজেডি যখন চরমে—তখন দূরে দূরে বাড়ির আলো নিভে এসে দর্শকদের বুক চেপে ধরল। নাট্যমঞ্চে আলোর এক নতুন ব্যাকরণ রচিত হল যেন।
এরপর এল মহাকাব্যিক মঞ্চায়ন—‘রক্তকরবী’। শম্ভু মিত্র দায়িত্ব দিলেন মঞ্চসজ্জার গুরু খালেদ চৌধুরীকে, যিনি আগে গণনাট্য সংঘের ব্যালে স্কোয়াডে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের ১০ মে শিয়ালদহের ইবিআর ম্যানশনে যখন রাজা, নন্দিনী ও বিশুরা অবতীর্ণ হলেন, তখন কলকাতার নাট্যদুনিয়া যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। খালেদের মঞ্চসজ্জা আর তাপসের আলো মিলে সৃষ্টি হল মায়াবী এক জগত, যা বাংলা নাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে রইল।
তখনও রবীন্দ্র সদন বা কলামন্দির ছিল না। কলকাতার প্রধান প্রেক্ষাগৃহ ছিল নিউ এম্পায়ার থিয়েটার। রবিবার ও ছুটির দিনের সকালে নাটক মঞ্চস্থ হত। সিনেমার নাইট শো ভাঙার পর রাত জেগে মঞ্চ প্রস্তুত করে সকালে শো চালানো হতো। বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’-র সাফল্যের পর একের পর এক প্রযোজনা—‘ডাকঘর’, ‘পুতুলখেলা’, ‘পাগলা ঘোড়া’—সবকটিতেই শম্ভুর ভাবনাকে অনুপম আলোকনকশায় প্রাণ দিতেন তাপস সেন।
কলকল্লোলে
এসময় কফি হাউসে পরিচয় হল এক তরুণ নাট্যকর্মীর সঙ্গে—উৎপল দত্ত। সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র, ইংরেজি নাটক, বিশেষত শেক্সপিয়র মঞ্চস্থ করাই ছিল তাঁর মূল ধ্যানজ্ঞান। তিনি প্রথম বাংলা নাটক করলেন সরোজ দত্তের অনুবাদে কনস্তানতিন সিমোনভের ‘সাংবাদিক’। শেষ দৃশ্যে রেডিওতে নায়ক বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ শুনছে, আর প্রায় অন্ধকার মঞ্চে শুধু রেডিওর কাচের আলো ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে আবেগকে চরমে নিয়ে যাচ্ছে—এ দৃশ্যকে জীবন্ত করে তোলেন তাপসের আলো।
সেই থেকে তাপস যুক্ত হলেন উৎপলের লিটল থিয়েটার গ্রুপ (এলটিজি)-এর সঙ্গে। আশ্চর্যের বিষয়, তিনি একই সঙ্গে ছিলেন শম্ভু মিত্রের বহুরূপীরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। শম্ভুর সৌন্দর্যমণ্ডিত নান্দনিক নাটক আর উৎপলের বিপ্লবী রাজনৈতিক নাটক—দুটির সঙ্গেই সমান দক্ষতায় কাজ করতেন তাপস। বলা যায়, তিনি ছিলেন এ দুই মহীরুহের মধ্যে আলোর সেতু।
১৯৫৯ সালে এলটিজি অধিগ্রহণ করল ঐতিহ্যবাহী মিনার্ভা থিয়েটার। উৎপলের ভাবনা ছিল, ধারাবাহিক নাট্যচর্চা চালিয়ে যেতে হলে বড় রঙ্গালয়ে টিকে থাকতে হবে। কিন্তু ‘নীচের মহল’, ‘ছায়ানট’, ‘ওথেলো’—সবই ব্যর্থ হল। একই সময় সপ্তমীতে বিশ্বরূপায় মঞ্চস্থ হল ‘সেতু’ নাটক। শেষ দৃশ্যে মঞ্চে ট্রেন ছুটে আসে দর্শকের সামনে—তাপসের আলোয় সেই দৃশ্য এত বাস্তব হয়ে উঠেছিল যে, দর্শক ভিড় ভেঙে পড়তে চাইছিল!
এরপর এলো ‘অঙ্গার’—কয়লাখনিতে দুর্ঘটনা নিয়ে লেখা নাটক। আসানসোলে এক অফিসারের সহায়তায় খনির অভ্যন্তরীণ কাঠামো দেখে এলেন উৎপল ও তাপস। মঞ্চে নির্মল গুহরায়ের সাজানো খনিতে হুহু করে জল ঢুকছে, শ্রমিকরা ডুবে যাচ্ছে, আর তাপসের আলো ও পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুর দর্শককে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শেষ দৃশ্যে বহু দর্শক অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন।
এরপর এলো ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে জন্ম নিল সিপিএম, আর একই বছরে উৎপল দত্ত মঞ্চস্থ করলেন ঐতিহাসিক নাটক ‘কল্লোল’—১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে লেখা। তাপসের ডাকে সুরেশ দত্ত তৈরি করলেন মঞ্চে জাহাজ। আলো-আঁধারির খেলায় সেই মঞ্চ এতটাই জীবন্ত হয়ে উঠল যে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। কংগ্রেস সরকার নাটককে বিপজ্জনক মনে করে উৎপল দত্তকে গ্রেফতার করে। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়। তবু তাপস, তখন দলের সভাপতি, পোস্টারে লিখলেন—
“কল্লোল চলছে চলবে।”
কলকাতা শহর জুড়ে ছেয়ে গেল সেই পোস্টার। শাসকের রক্তচক্ষু সত্ত্বেও মিনার্ভা থিয়েটার ছিল হাউসফুল।

ইকড়ি মিকড়ি
তাপস সেনের নাম যতটা কিংবদন্তি, তাঁর কাজের সরঞ্জাম কিন্তু ততটাই সাধারণ ছিল। অভিনব আলোর জগৎ তৈরি করেছিলেন তিনি প্রায় হাতখরচা উপকরণ দিয়ে। যখন তিনি কাজ শুরু করেন, তখন অনেক নির্দেশক ও প্রযোজকের কাছেই “আলো” আলাদা কোনো শিল্পমাধ্যম নয়, ছিল নিছক সহায়ক ব্যবস্থা। যন্ত্রপাতি প্রায় ছিল না বললেই চলে। অথচ তাপস জাদু দেখাতেন—জোগাড় করা বনস্পতির টিন, বার্লির কৌটো, বিস্কুটের ভাঙা টিন কেটে-ছেঁটে বানিয়ে ফেলতেন অভিনব আলোকযন্ত্র। তাঁর তৈরি আলো পেত অদ্ভুত সব নাম—“দুধের বালতি”, “ইকড়ি মিকড়ি”, “ইঁদুরকল”!
‘অঙ্গার’-এ খনির দৃশ্যে খনিতে জল ঢুকছে—এটা দেখালেন তিনি এক টুকরো কাটা পলিথিনের চাদর দুলিয়ে। দর্শকের মনে হল সত্যিই খনির ভেতরে জল হুহু করে উঠছে। ‘সেতু’-তে মঞ্চে ট্রেন ছুটল না কোনো বাস্তব যন্ত্রে, বরং একটি কৌটোয় বসানো ব্যাটারি-চালিত ছোট্ট পাখার আলো কাঁপতে কাঁপতে মঞ্চ অতিক্রম করল—দর্শক দেখল হেডলাইট নিয়ে ছুটে আসছে ট্রেন! ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ বাঁশের মাথায় আলো বেঁধে দুলিয়ে দিলেন তাপস, দর্শক দেখল নদীর জলে নৌকায় দুলছে হ্যারিকেন।
এইসব উদ্ভাবনী কাজে শীঘ্রই ডাক পড়ল বম্বের নাট্যমঞ্চে। ১৯৬৫ সালে ‘দ্য স্প্লেন্ডার্ড ওয়ান’ নাটকে তাঁর আলোয় পাহাড় ভেঙে পড়ল, জরথ্রুস্ট নদীর উপর দিয়ে মানুষ হেঁটে গেল। মঞ্চে এমন ভিড় হল, যা ইংরেজি থিয়েটার আগে কখনও দেখেনি। পরে পৃথ্বী থিয়েটারে ফিরোজ আব্বাস খানের ‘দ্য রয়াল হান্ট অব দ্য সান’ এবং ‘মহাত্মা ভার্সাস গান্ধী’-তেও তাঁর কৃতিত্ব ঝলসে ওঠে।
তবে সমালোচকরা অভিযোগ তুলেছিলেন—তাপস মঞ্চে জাদু দেখিয়ে নাট্যরসকে আড়াল করছেন। বিশেষ করে ‘সেতু’ আর ‘অঙ্গার’-এর সময় এই বিতর্ক চড়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তিনি শুধু চমক দিতেন না, বরং আলো এবং অন্ধকারের বহুমাত্রিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নাটককে দিতেন গভীরতর অর্থ। গিরিশ কারনাডের ‘তুঘলক’ হোক বা ‘ছেঁড়া তার’-এর চালাঘরে রৌদ্রছায়া কিংবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘নামজীবন’-এর শুরুতে ভাঙা ঘরের ছাদে ভেসে ওঠা জ্যোৎস্না—তাপসের আলো ছিল কাহিনির আবহ ও দর্শনকে উজ্জ্বল করার মাধ্যম।
শম্ভু মিত্র ও উৎপল দত্ত যুগ পেরিয়েও তিনি ছিলেন অক্লান্ত। থিয়েটার ওয়ার্কশপের ‘চাকভাঙা মধু’, ‘মহাকালীর বাচ্চা’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘বেলা অবেলার গল্প’; নান্দীকারের ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’; থিয়েট্রনের ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’; চুপকথার ‘জন্মদিন’; রঙ্গকর্মীর ‘কাশীনামা’—প্রতিটি প্রযোজনায় তাপসের আলো নাটককে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
পুতুলনাট্যেও তাঁর কাজ দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। সুরেশ দত্তের ক্যালকাটা পাপেট থিয়েটারে ‘আলাদিন’ প্রযোজনা যেন আলোক-জাদুর বিস্ময়। অসংখ্য প্রযোজনার পাশে তাঁর অবদান ছিল নিঃশব্দ অথচ অনিবার্য।
পরিচালক বিভাস চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন,
“আমাদের অশ্বত্থামা বা মহাকালীর বাচ্চা বিশেষ চলেনি। কিন্তু তাপসদার আলোয় কাজ অসাধারণ ছিল। আমরা তাঁকে কতটুকুই বা পারিশ্রমিক দিতে পেরেছি?”
এই আক্ষেপ আসলে প্রমাণ করে—তাপস সেন ছিলেন সেই মানুষ, যিনি মঞ্চে আলো জ্বালিয়ে নাটককে প্রাণ দিতেন, অথচ আলো নিজের দিকে কখনও টানেননি।
নাটকের বাইরে
বাংলা নাট্যমঞ্চে আলোর জাদুকর হিসেবে খ্যাত হলেও তাপস সেনের কর্মজীবনের বড় অংশই কেটেছে থিয়েটারের বাইরের কাজ করে। তাঁর আয়ের মূল উৎসও ছিল সেখানেই। ভারতীয় ঐতিহাসিক স্থাপত্যে তিনি যে “সন এ লুমিয়ের” বা আলো–ছায়ার প্রদর্শনী করেছিলেন, তা ছিল একেবারেই অভিনব। তিনমূর্তি ভবন, সবরমতী আশ্রম, গ্বালিয়র দুর্গ, চুনার দুর্গ, পুরানা কিলা কিংবা আগরার দেওয়ান-ই-আম—সবখানেই তাঁর আলোকনকশা স্থাপত্যকে এক নতুন ভাষায় উপস্থাপন করেছে।
১৯৮২ সালে দিল্লির সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে এশিয়াডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর আলোয় মঞ্চ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। ১৯৮৫ সালে প্যারিসে Festival of India উপলক্ষে আইফেল টাওয়ারই ঝলসে উঠল তাঁর আলোয়। এরপর মস্কো, লেনিনগ্রাদ, তাশখন্দেও তাঁর দক্ষতা আন্তর্জাতিক দর্শকদের অভিভূত করে তোলে।
নৃত্যশিল্পের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ দিনের। চল্লিশের দশকে বালকৃষ্ণ মেননের নৃত্যনাট্যে প্রথম আলোর কাজ করেছিলেন। এরপর অনাদিপ্রসাদের ‘ওমর খৈয়াম’, বৈজয়ন্তীমালার ‘চণ্ডালিকা’, আবার বিরজু মহারাজ, বালা সরস্বতী, মঞ্জুশ্রী, রঞ্জাবতী চাকী সরকার, মৃণালিনী সারাভাই থেকে শুরু করে হেমা মালিনী পর্যন্ত প্রায় সব প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পীর মঞ্চে আলো ফেলেছেন তাপস সেন।
সিনেমাতেও ডাক এসেছিল মূলত বিশেষ এফেক্ট তৈরির জন্য। ১৯৬৯ সালে ভি. শান্তারামের ‘Jal Bin Machhli Nritya Bin Bijli’ ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি। পরে মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘খণ্ডহর’, তপন সিংহের ‘সফেদ হাতি’, অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাবা তারকনাথ’, প্রফুল্ল রায়ের ‘শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ’, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বীকারোক্তি’, অপর্ণা সেনের ‘পরমা’—সবই তাঁর আলোকনকশায় সমৃদ্ধ হয়েছে।
তাঁর অবদানের স্বীকৃতি এসেছিল দেশ-বিদেশ থেকে। ১৯৭২ সালে তিনি পান এশিয়ার শ্রেষ্ঠ লাইট ডিজাইনার সম্মান। ১৯৭৪ সালে পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ১৯৯৩ সালে বিলেতের ব্র্যাডফোর্ডে ফিল্ম, থিয়েটার ও টেলিভিশনের আলোকশিল্পীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞরা মুগ্ধ হন। তাঁকে সম্মানিত করা হয় Association of Lighting Designers-এর সম্মানসূচক সদস্যপদ দিয়ে। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাঁকে করে Emeritus Fellow। এছাড়াও তিনি পান দীনবন্ধু পুরস্কার ও জীবনের শেষ লগ্নে কালিদাস সম্মান।
আলো কী?
তাপস সেনের জীবনে আলো ছিল শুধু কারিগরি নয়, একধরনের দর্শন। ছোটবেলায়ই তাঁর মনে আলো গেঁথে গিয়েছিল। ব্রহ্মপুত্রের ধারে আঁধার আকাশে দূরে প্রমথেশ বড়ুয়াদের গৌরীপুর রাজবাড়ির টিমটিমে আলো, কিংবা রাতের স্টিমারের সার্চলাইটে গাছপালা ও বাড়িঘরের হঠাৎ মূর্ত হয়ে ওঠা ছবি—সবই যেন তাঁর মনে স্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। তিনি নিজেই লিখেছিলেন,
“ঠাকুর্দা ভাগ্যের অন্বেষণে ঢাকার সোনারং ছেড়ে চলে এসেছিলেন ভারতের পূর্ব প্রান্তে আসামে। গদাধর নদীর পাড়ে নিজের বাড়ি করলেন। বাবা-মায়ের বিয়ের দশ বছর পর নতুন ঘরে আমি জন্মালাম।”
১৯২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। দিনটি ইতিহাসে পরে পরিচিত হয় “নাইন ইলেভেন” হিসেবে, যদিও অন্য কারণে। সেদিনই জন্ম নেন তাপস সেন, ভয়ঙ্কর ঝড়জলের মধ্যে। নবজাতক প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে। মা সুবর্ণলতার মুখে শোনা গল্প, আর জানালার বাইরের ব্রহ্মপুত্রের আলো-অন্ধকার মিলিয়ে সেই স্মৃতি যেন তাঁর সারাজীবনের অনুপ্রেরণা।
অবাক করা বিষয়, ছোটবেলায় অঙ্কে ভয় পেলেও জীবনের শেষে তিনি আলোকে বুঝতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞান দিয়ে। ফোটনের স্বরূপ, আলোর গতিবেগ, আলোককণার বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য নিয়ে লিখেছেন। ১৯৯২ সালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধ পড়লে বোঝা যায়—তিনি শুধু একজন আলোকশিল্পী নন, ছিলেন একজন তত্ত্বচিন্তক।
তাঁর কথায়:
“দীর্ঘদিন আলোছায়ার জগতে মানুষের হাসি-কান্নার পালায় কাজ করলাম, তবু আলোকে সত্যিকার অর্থে জানাই হল না।”
ইতি কমরেড
অসাধারণ সাফল্যে ভরপুর কর্মজীবন হলেও জীবনের শেষ অধ্যায়ে তাপস সেনের দিনগুলো খুব সহজ কাটেনি। শারীরিক অসুস্থতা, কাজের চাপ কমে আসা, আর তার সঙ্গে স্বভাবসিদ্ধ স্পষ্টভাষিতা অনেককেই অস্বস্তিতে ফেলত। তাপস কখনও আপস করতে শিখেননি।
১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ভরাডুবি করলেও বামপন্থীরা নিজেদের দ্বিধা ও বিভক্তির কারণে সরকার গঠনে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। বৌবাজার ট্রেড ইউনিয়ন অফিসে এক বৈঠকে হাজির হয়ে তাপস স্পষ্ট বলে দিলেন—
“আপনারা যদি মিলিত না হন, কংগ্রেস আবার ফিরে আসবে।”
কথাটি কতটা কার্যকর হয়েছিল অজানা, কিন্তু তার পরপরই দুই পক্ষের ঐক্যের মাধ্যমে বাংলায় গঠিত হয় প্রথম অকংগ্রেসি সরকার।
তাপস সেন বাম আমলেও ছিলেন একইরকম আপসহীন। বিভিন্ন নাট্যমঞ্চের দুরবস্থা, শিল্পীদের আর্থিক সংকট, সাংস্কৃতিক নীতির ব্যর্থতা নিয়ে একের পর এক চিঠি লিখেছেন সরকারের কাছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো উত্তর আসেনি, মাঝে মধ্যে দু’লাইনের আনুষ্ঠানিক জবাব এসেছে। তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গেও প্রকাশ্যে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি, এমনকি খবরের কাগজে খোলা চিঠিও লিখেছিলেন।
২০০৪ সালে অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত স্টার থিয়েটার নতুন করে চালু হলে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোনে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন—
“স্টার তো খুলল, কিন্তু পুরনো কর্মীদের পাওনা কী হবে?”
কর্তৃপক্ষ অস্বস্তিতে নিস্তব্ধ, আর তাপস সেন আবারও প্রমাণ করলেন তিনি আজীবন শিল্পী-মানুষের পাশে।
আলোর বাইরে
সময়ের সঙ্গে একে একে প্রিয় বন্ধু ও সহকর্মীরা চলে গেলেন—তাপসের ভাষায়, সবাই “এগজ়িট” নিয়ে নিলেন। বেঁচে ছিলেন মৃণাল সেন, যিনি প্রায় প্রতিদিন সকালে ফোন করে তাঁর সঙ্গে গল্প করতেন। সেটুকুই ছিল সান্ত্বনা। বাকিটা ছিল নিঃসঙ্গতা ও অন্ধকার।
ডায়াবেটিস, প্রস্টেট সমস্যা, কানে শোনা কমে আসা—এসব শরীরকে দুর্বল করে তুলেছিল। স্ত্রী গীতা ছিলেন দীর্ঘদিন অসুস্থ, মেয়ে জয়ন্তীও টানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন। ওষুধের খরচ বাড়ছিল হুহু করে। ছেলে জয়, যাকে তাপস নিজের থেকেও প্রতিভাবান বলতেন, তিনিও সুরাসক্তি ও অস্থিরতার কারণে সংসার ভেঙে ফেললেন। প্রথম স্ত্রী সুমিত্রা আলাদা হলেন ছেলে সৌমিত্রিকে নিয়ে। পরে জয় সংসারে আনলেন থিয়েটারের মেয়ে চিত্রলেখাকে। কিন্তু বছর কয়েক পরেই কিশোর সৌমিত্রি (বটাই) আত্মহত্যা করল।
এই শোক তাপসকে ভেঙে দেয়। তবুও তিনি প্রায় প্রতিদিন বেরিয়ে পড়তেন, কাজ হোক বা অকাজ, অন্তত মনের ক্ষুধা মেটাতে। তাঁর দীর্ঘদিনের সহকারী গৌতম ঘোষ একবার বলেছিলেন—
“হেমা মালিনী নাচের অনুষ্ঠান নিয়ে বিশ্ব সফরে যাচ্ছিলেন। খুব ইচ্ছে ছিল তাপসদাকে নেওয়ার। ডাক্তার অনুমতি দিলেন না।”
পারাপার
২০০৬ সালের জুন। কয়েকদিন আগে প্রিয় বন্ধু জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের শেষকৃত্য থেকে ফিরেছিলেন তাপস সেন। বাড়ি ২৬এইচ, নাকতলা লেনে। ২৮ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মেয়ে জয়ন্তী অ্যাম্বুলেন্স ডাকলেও হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাপস সেন চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন আলোর এক উত্তরাধিকার। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি দুই শহরের মাঝে ঝুলে থাকা একটি সেতুকে আলোয় সাজাচ্ছিলেন—কাজ শেষ করার আগেই বাঁশি বেজে গেল। কাজের সমাপ্তি ঘটালেন তাঁর ছেলে জয়।
আজও কলকাতা থেকে হাওড়ার দিকে যেতে ডেলি প্যাসেঞ্জাররা রাতে নদীর বুকে ঝলমলে আলোয় ভাসতে থাকা হাওড়া ব্রিজ দেখে মুগ্ধ হয়।
হলুদ আর বেগুনির আশ্চর্য মেলবন্ধন যেন এখনো বলে— আলো মানে তাপস সেন।
✍️ লেখক: সোমেশ ভট্টাচার্য
সূত্র: আনন্দবাজার
ছবি পুনরুদ্ধার: জিয়া হক
ঋণ: সুজনেষু তাপস সেন, আশিস গোস্বামী
তথ্যসূত্র: লেট দেয়ার বি লাইট (অসিত বসু), অন্তরঙ্গ আলো (প্রভাতকুমার দাস, বিষ্ণু বসু), ছায়ায় আলোয় (জয়ন্তী সেন), বহুরূপী, নাট্যরঙ্গ পত্রিকা, সোপান নাট্যপত্র, নাট্যশোধ সংস্থান