বাংলা চলচ্চিত্র জগতে বহু নায়িকা এসেছেন, আলো ছড়িয়েছেন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসে মিশে গেছেন। কিন্তু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে এক অনন্য মর্যাদার আসনে বসেন। অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যমঞ্চে সক্রিয় থেকে দর্শকের হৃদয় জয় করেছেন। তাঁর অভিনয়ে যেমন ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা, তেমনই ছিল সরলতা ও বাস্তবতার ছোঁয়া।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়: বাংলা সিনেমার স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি
শৈশব ও বেড়ে ওঠা
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, কলকাতায়। শৈশব থেকেই তিনি শিল্প ও সংস্কৃতির আবহে বড় হন। গান, আবৃত্তি, নাচ—সবকিছুতেই তাঁর আগ্রহ ছিল। তবে অভিনয়ের প্রতি তাঁর টান সবচেয়ে বেশি ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি নাট্যচর্চার সঙ্গে তিনি যুক্ত হন এবং ধীরে ধীরে বড় পর্দায় সুযোগ পান।
চলচ্চিত্রে অভিষেক
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে। পরিচালক অজয় কর ও অরুণ চৌধুরী–র ছবিতে প্রথম দিকের ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেও খুব দ্রুতই তিনি দর্শকের চোখে পড়েন। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “মেয়েদের মধ্যে” সিনেমায় তাঁর অভিনয় প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসে।
এরপর “অভয়ার সপ্ন” (১৯৬১) এবং “কাঞ্চনমালা” (১৯৬২)–তে তাঁর অভিনয় তাঁকে নতুন প্রজন্মের নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম করে তোলে।
সাফল্যের ধারা
ষাটের দশক ছিল সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সোনালি সময়। তিনি একের পর এক ছবিতে নায়িকা হিসেবে কাজ করেন এবং বাণিজ্যিক ও সমালোচক-প্রশংসিত—দুই ধারার চলচ্চিত্রেই সমান সাফল্য পান। তাঁর স্মরণীয় ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- “অমৃতকুম্ভের সন্ধানে” (১৯৬৫)
- “পলাতক” (১৯৬৩)
- “গঙ্গার জল” (১৯৬৫)
- “বাড়ি থেকে পালিয়ে” (১৯৬৬)
- “শীতল উত্তর” (১৯৬৯)
এসব ছবিতে তাঁর অভিনয় ছিল প্রখর, অথচ কোমল। তিনি সহজভাবে চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন, যা দর্শককে আকৃষ্ট করত।
উত্তমকুমারের বিপরীতে অভিনয়
বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তমকুমার ছিলেন নায়কপ্রধান নক্ষত্র। তাঁর বিপরীতে কাজ করে যেসব অভিনেত্রী নিজেদের আলাদা পরিচিতি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সাবিত্রী অন্যতম।
- “চৌরঙ্গী” (১৯৬৮) ছবিতে তিনি উত্তমকুমারের বিপরীতে এক শক্তিশালী চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেন।
- এছাড়া “মায়ার সংসার”, “চোখের বালি” প্রভৃতি ছবিতেও তাঁদের রসায়ন দর্শকদের মনে গভীর ছাপ ফেলে।
বহুমুখী চরিত্রে সাফল্য
সাবিত্রী কেবল গ্ল্যামার-নির্ভর নায়িকা ছিলেন না; তিনি নাটকীয়, সামাজিক, এমনকি কমেডি চরিত্রেও সমান স্বাচ্ছন্দ্য দেখিয়েছেন। তাঁর অভিনয়ে ছিল সংযম, কিন্তু প্রয়োজনে তিনি আবেগের বহিঃপ্রকাশও নিখুঁতভাবে করেছেন।
- মেলোড্রামা: “পলাতক” ছবিতে একজন বিপন্ন নারীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় মর্মস্পর্শী।
- কমেডি: “অপু-দুর্গার ছায়া” ধরনের হালকা ছবিতে তিনি ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত।
- গুরুগম্ভীর সামাজিক নাটক: “অমৃতকুম্ভের সন্ধানে” ছবিতে তিনি এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছান।
মঞ্চ ও ছোটপর্দা
শুধু চলচ্চিত্রেই নয়, মঞ্চ ও ছোটপর্দাতেও সাবিত্রী সমান সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।
- তিনি বহু জনপ্রিয় থিয়েটার প্রযোজনায় অংশ নিয়েছেন।
- টেলিভিশন ধারাবাহিকতেও তিনি মাতৃত্ব, প্রতিবেশী বা সমাজনেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত সংযত ও সাধারণ জীবনযাপনের মানুষ। আলো-ঝলমলে চলচ্চিত্র জগতে থেকেও তিনি কখনো অতিরিক্ত প্রচারের আলো খুঁজে বেড়াননি। তাঁর জীবনদর্শন ছিল কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা ও দর্শকের প্রতি দায়বদ্ধতা।
সম্মান ও স্বীকৃতি
বাংলা চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেছেন।
- বিএফজেএ পুরস্কার একাধিকবার।
- বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার।
- ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড (ইস্ট)–এ জীবনকৃতির সম্মান।
- এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেছে।
উত্তরাধিকার
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়-জীবন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। আজকের প্রজন্মের অভিনেত্রীরা তাঁর কাজ থেকে অনুপ্রেরণা পান। তিনি দেখিয়েছেন—অভিনয়ের শক্তি শুধু সৌন্দর্যে নয়, বরং চরিত্রে প্রাণ সঞ্চারের ক্ষমতায় নিহিত।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্রের এক স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি। তিনি ছিলেন দর্শকের প্রিয় অভিনেত্রী, সহকর্মীদের কাছে প্রেরণা, এবং বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর অভিনয় আজও বাঙালির স্মৃতিতে জেগে আছে। তিনি প্রমাণ করেছেন—একজন শিল্পীর আসল পরিচয় তাঁর নিষ্ঠা, সততা এবং শিল্পসাধনায়।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যেসব অভিনেত্রীর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় তাঁদের শীর্ষ সারিতেই থাকবেন।
